প্রায় দুই বছর ধরে ডেইলি স্টার পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক আশফাকুল হকের বাসায় গৃহ সহায়ক হিসেবে কাজ করে আসছিলেন ১৫ বছর বয়সী প্রীতি।
Published : 13 Feb 2024, 08:59 PM
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের চা বাগানের মেয়ে প্রীতি উরাংয়ের মা-বাবা উদয়াস্ত শ্রম দিয়ে জীবন চালিয়ে আসছিলেন চেনা পরিবেশে। এরইমধ্যে ঢাকায় এসে মানববন্ধনে যোগ দিতে হবে, তাও আবার নিজের মেয়ের জন্য, সেটা কখনো ভাবেননি তারা।
মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে যোগ দিয়ে তারা বলেছেন, পারিবারিক অনটনের কারণে মেয়েকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ‘নির্যাতন করে’ তাকে ‘মেরে ফেলা’ হবে, এমনটা কখনও কল্পনাতেও আসেনি।
সচেতন নাগরিক সমাজ আয়োজিত ওই মানববন্ধনে প্রীতির মা নমিতা উরাং বলেন, “আমি গরিব মানুষ, এজন্য আমার মেয়েকে পাঠিয়েছিলাম এখানে (ঢাকায়) কাজের জন্য। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি বিচার চাই। আমরা প্রীতির বিচার চাই।
“আমরা তো গরিব মানুষ, আমরা গরিব মানুষ বলে কি আপনাদের দয়ামায়া নাই। এভাবে কি গরিবের মেয়েকে ফালানো লাগে?”
গত ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টার দিকে মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের এক ভবনের ‘নবম তলা থেকে পড়ে’ মারা যান প্রীতি উরাং। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মিত্তিঙ্গা গ্রামের লোকেশ উরাংয়ের ১৫ বছর বয়সী মেয়ে প্রীতি প্রায় দুই বছর ধরে ডেইলি স্টার পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক আশফাকুল হকের বাসায় গৃহ সহায়ক হিসেবে কাজ করে আসছিলেন।
মৃত্যুর পরদিন মোহাম্মদপুর থানায় এসে মামলা করেন লোকেশ উরাং। আশফাক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারের বিরুদ্ধে ৩০৪ (ক) ধারায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ করেছেন তিনি। মঙ্গলবার দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চারদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত।
প্রীতির মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ হিসাবে বর্ণনা করে সুষ্ঠু বিচার দাবিতে মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দুটি মানববন্ধন হয়।
সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে একটি মানববন্ধনে প্রীতির পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য ও চা শ্রমিক নেতারা অংশ নেন।
প্রীতির মা নমিতা উরাং কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার মেয়ের বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই, বিচার চাই। সুষ্ঠু বিচার চাই। আমার মেয়েকে নির্যাতন করে মারা হয়েছে। আমরা বিচার চাই। সুষ্ঠু বিচার চাই।”
প্রীতির বাবা লোকেশ উরাং মানববন্ধনে বলেন, “আমার মেয়েকে পাঠিয়েছিলাম কাজের জন্য। এখানে যে এ অবস্থা হয়, এটাতো আমরা নিজেও জানি না, কীভাবে ও মারা যায়!
“তার পরেও আমাদেরকে প্রীতির বিচারের জন্য আমরা এসেছি অনেক দূরের থেকে। বিচার যেন সুষ্ঠুভাবে হয়, এটা চাই।”
প্রীতির চাচাতো বোন সবিতা উরাং বলেন, “আমরা বাগানে চা-শ্রমিক, আমরা গরিব-দুঃখী মানুষ। এ অবস্থায় আমি আমার ছোটবোনকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম।
“আমরা আপনাদের কাছে এত দূর থেকে এসেছি, আমরা সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার জন্য; শেখ হাসিনার কাছে। এটা হচ্ছে তোমাদের কাছে আমাদের দাবি।”
মানববন্ধনে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী চা শ্রমিক প্রীতি উরাং হত্যার বিচার চাই’, ‘হায় মানবতা, হায় ডেইলি স্টার’সহ বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করা হয়।
প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আরেকটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে ‘গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক’।
এ কর্মসূচিতে অন্যদের মধ্যে ১২টি জাতীয় ট্রেড ইউনিয়নের জোট শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল ওয়াহেদ, গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী আবুল হোসেন বক্তব্য দেন।
এদিন সকালে কর্মজীবী নারীর আয়োজনে গৃহকর্মীর সুরক্ষা, অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নাগরিক সমাজ ও মিরপুর গৃহকর্মী আঞ্চলিক ফোরামের সংলাপ হয়।
মিরপুরের ইউসেপ বাংলাদেশ মিলনায়তনে ওই সংলাপের শুরুতে গৃহকর্মী প্রীতি উরাংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
এই কিশোরীর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আশফাকুল হক বা তার পরিবারের বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।
ডেইলি স্টার এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমাদের জ্যেষ্ঠ সহকর্মী ও নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় এক কিশোরী গৃহ সহায়কের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত। দুর্ভাগ্যজনক এ ঘটনার জন্য আমরা গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। তদন্তে কী পাওয়া গেল, তা জানার অপেক্ষায় আছি আমরা।”
আরো পড়ুন
গৃহকর্মীর মৃত্যু: সাংবাদিক আশফাক ও তার স্ত্রী ৪ দিনের রিমান্ডে
প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাইলেন বাবা
গৃহকর্মীর মৃত্যু: সাংবাদিক আশফাক ও স্ত্রী কারাগারে
গৃহকর্মীর মৃত্যু: সাংবাদিক আশফাক ও স্ত্রীকে রিমান্ডে চায় পুলিশ