“তারা দুই-তিনটা মাস ট্রমার মধ্য দিয়ে দিয়ে গেছে…কিন্তু তাদের মানসিক চাপ নিরসনে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিইনি,” বলছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হেলাল।
Published : 28 Nov 2024, 01:29 AM
“আমাদের কলেজে ঢুকে ইচ্ছেমত হামলা চালিয়েছে। তাদের হাতে রড, রামদা ও দেশীয় অস্ত্র ছিল। আমাদের শিক্ষকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে, ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করেছে। ওরা বলাবলি করতেছিল আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে ওরা আবার হামলা করবে, আগুন দেবে। কলেজ শিক্ষার্থীরা এত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কীভাবে চালায়?”
গত ২৪ নভেম্বর সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হামলা ভাংচুরের পর কথাগুলো বলছিলেন নাহিদ হাসান নামের এক শিক্ষার্থী। ডেমরার ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের পাশাপাশি ঢাকার ডজনখানেক কলেজের শিক্ষার্থীরা ওই হামলায় অংশ নেয়।
পরদিন এর জবাব দিতে মোল্লা কলেজে যায় সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও পাশের কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। সেখানেও ব্যাপক ভাংচুর-লুটপাট চলে। আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সেদিন প্রতিপক্ষের শিক্ষার্থীরা যেভাবে লাঠি আর বাঁশ দিয়ে পিটিয়েছে, সেই দৃশ্য দেখলে শিউরে উঠবেন সুস্থ যে কোনো মানুষ।
বাসে ওঠা নিয়ে কথা কাটাকাটি কিংবা এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হলের সামনে দাঁড়িয়ে আরেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের চা পান করা- এমন সব তুচ্ছ ঘটনাকে ঘিরেও সহিংসতায় জড়াচ্ছে ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
আগাম ‘ঘোষণা দিয়ে’ শিক্ষার্থীরা প্রকাশ্যে সংঘর্ষে জড়ালেও তা ঠেকাতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সরকারের তরফে শিক্ষার্থী বিবেচনায় আইন প্রয়োগে ‘নমনীয়তার’ কথা বলা হচ্ছে।
অপরাধ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ‘শ্রেণি বিবেচনা করে’ আইন প্রয়োগে ‘বিভাজন’ দেখালে ওই নির্দিষ্ট শ্রেণির মধ্যে আরও সহিংসতার ‘স্পৃহা’ তৈরি হবে।
এখনো কোনো ঘটনাতেই ‘রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা’ নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। তবে জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা মনে করছেন, এমন সহিংসতার পেছনে ক্ষমতাচ্যুতদের ‘ইন্ধন’ রয়েছে।
মনোবিজ্ঞানীরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অভ্যুত্থান পরবর্তী যে ‘অস্থিরতার ছাপ’ দেখছেন, তা থেকে দ্রুত পরিত্রাণের উপায় খোঁজার তাগিদ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। ছোটোখাটো সমস্যা যাতে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হয়- তার উদ্যোগ নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক যেসব কর্মসূচি নিয়ে জোরালো আলোচনা-সমালোচনা চলছে, তার মধ্যে আছে গেল ১৮ নভেম্বরের রেলপথ ও সড়ক অবরোধ।
সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে মহাখালীতে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের অবরোধের মধ্যে ট্রেন লক্ষ্য করে ছোড়া ঢিলে শিশুসহ কয়েকজন আহত হয়, যার প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের কাউকে কাউকে।
পরদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি নিয়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। তবে এরপর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি শান্ত রয়েছে।
‘হাতাহাতির ঘটনা থেকে বাস ভাঙচুরের’ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০ নভেম্বর দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে আহত হয় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী।
টং দোকানে চা পানের সময় কথা কাটাকাটির জেরে ২৪ নভেম্বর রাতে তেজগাঁওয়ে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইলের (বুটেক্স) শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হন অর্ধশতাধিক।
সেদিন দুপুরে ‘সুপার সানডে' কর্মসূচির নামে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ও পাশের সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় মোল্লা কলেজসহ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা।
মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তাদের সহপাঠী ডেঙ্গু আক্রান্ত অভিজিৎ হাওলাদারের মৃত্যুর পর ‘চিকিৎসায় অবহেলার’ প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ২১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের হাতে মারধরের শিকার হতে হয়। সে কারণেই রোববার ‘সুপার সানডে’ কর্মসূচি দেওয়া হয়।
এর পাল্টায় পরদিন ‘মেগা মানডে’ কর্মসূচি দেয় সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর অংশ হিসেবে তারা ডেমরা সড়ক সংলগ্ন মোল্লা কলেজে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। প্রায় দুই ঘণ্টার সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। ঘটনার সময় মোল্লা কলেজে ভাঙচুরের পাশাপাশি লুটপাটও হয়।
কারা কীভাবে দেখছে
এসব ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও দলটির সহযোগীদের দায় দেখছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
প্ল্যাটফর্মটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসররাই এসব ঘটনা প্রবাহে উসকানি দিচ্ছে। তারা ছোট ছোট বিষয়কে বিতর্কিত করে জাতীয় ইস্যু তৈরির পাঁয়তারা করছে।
“তাদের মূল লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের বিতর্কিত করা। তারা বাংলাদেশের জনগণের সামনে শিক্ষার্থীদের ক্রিমিনাল হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। আর গণবিপ্লবকে বিতর্কিত করে এটাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রমাণ করতে তারা মরিয়া।”
শিক্ষার্থীদের মধ্যে তর্ক বা মনোমালিন্য থেকে যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, সেসব ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত’ বলে মন্তব্য করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই সহযোগী অধ্যাপক মনে করেন, আইন মানার প্রশ্নে যখন নানা ধরনের বিভাজন তৈরি হয়, তখন একই শ্রেণির ‘সহিংসতা মনোভাবাপন্ন’ অন্যদের মধ্যে স্পৃহা তৈরি করে।
“আমরা মনে করছি শিক্ষার্থীরা ভুল করছে, কিছু বলা যাবে না। সরকারের কেউ বলছেন, নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে মুখোমুখি অবস্থানে সহিংসতা বেড়ে যেত। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এমন একটা প্রশ্ন আসছে- জুলাই বিপ্লবে শিক্ষার্থীদের অবদান রয়েছে। এই ধারণাকে পুঁজি করে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহনশীল ভূমিকা পালন করছে।”
‘কোথাও সক্রিয়, আবার কোথাও নীরব’ ভূমিকায় না থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যাতে সব ধরনের সহিংসতা ঠেকায় তা নিশ্চিতের পরামর্শ দেন তিনি।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “গত দুই মাসে একটা গণপরিবর্তন এসেছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী একটা অস্থিরতার ছাপ সর্বত্রই রয়েছে, সেটা কিশোরদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে।
“তারা দুই-তিনটা মাস ট্রমার মধ্য দিয়ে দিয়ে গেছে, অনেক ঘটনা তারা প্রত্যক্ষ করেছে। এর ফলে তাদের মধ্যে একটা তীব্র মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে। কিন্তু তাদের মানসিক চাপ নিরসনে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিইনি।”
সেই চাপ কাটিয়ে উঠতে ‘পরিবার ও শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালনের’ তাগিদ দিয়েছেন এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘অস্থিরতা’ শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন ও রিসার্চের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ দেখা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যেন ‘দমনপীড়ন না’ চালিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে, সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বর্তমান সরকারের দায়িত্বশীলদের ভূমিকা রাখতে হবে।
“একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের দায়িত্বশীল ও সচেতন ভূমিকা রাখতে হবে। তাদের নজর রাখতে হবে তাদের স্বাধীনতা ভোগ করাটা যেন স্বেচ্ছাচারিতা না হয়ে যায়।”
অধ্যাপক জিন্নাহ বলেন, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ছোটখাটো সমস্যগুলো যেন সমাধান করা যায়- সে উদ্যোগ নিতে হবে।
“এক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যেন অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বৈরিতার বদলে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক স্থাপন করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।”
কোন ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কেমন
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির দিন রাজধানীর প্রায় সব থানাসহ সারাদেশে পুলিশ আক্রান্ত হয়। পরে বাহিনীর পুনর্গঠনে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আগের মত সক্ষমতা ফেরেনি। এর মধ্যে সারাদেশে ‘মব জাস্টিস’ প্রবণতা চলতে থাকায় পুলিশকে অনেকক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় ভূমিকাতেই দেখা গেছে।
১৮ নভেম্বর দিনভর অবরোধের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আলোচনার কথা বলে বিকাল ৪টায় কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। তবে আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ার কথা জানিয়ে সন্ধ্যা ৬টায় ক্যাম্পাসের সামনের সড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। প্রায় তিন ঘণ্টার এ কর্মসূচিতে মহাখালী-গুলশানের সড়ক ব্যবহার করতে না পারায় চরম দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।
সেদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘দর্শকের’ ভূমিকায় থাকলেও পরদিন কলেজটির সামনে, আমতলীসহ আশপাশের সড়কে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্যদের অবস্থান করতে দেখা যায়। একইসঙ্গে রাওয়া ক্লাবের সামনে থেকে মহাখালী রেলগেট পর্যন্ত সড়কে দেখা গেছে সেনা সদস্যদের। রেললাইনের পাশ দিয়ে পুলিশের অবস্থান দেখা গেছে।
ওই দিন বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার বলেছিলেন, “আমাদের পর্যাপ্ত ফোর্স মোতায়েন রয়েছে। কোনো অবস্থাতেই তাদেরকে আজ সড়কে নামতে দেওয়া হবে না। সড়ক অবরোধ করার চেষ্টা করলে পুলিশ অ্যাকশনে যাবে।”
জনভোগান্তি ঠেকাতেই এই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন তিনি।
২০ নভেম্বর ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি যোগ দিতে হয় সেনাবাহিনীকেও। সিহিংসতার জেরে পরে বন্ধ হয়ে যায় দুই কলেজের অ্যকাডেমিক কার্যক্রম।
ঘটনার দিন ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আলম বলেছিলেন, “প্রথম দিকে পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করছিল। একপর্যায়ে পরিস্থিতি এমন সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠল যে শিক্ষার্থীদের হতাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা গেল। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়।”
গত অক্টোবরের শেষ দিকে সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষকে অপসারণের দাবি জানিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। ওই ঘটনা নিয়ে কলেজটি দীর্ঘ ২০ দিন বন্ধ রাখার পর ১৯ নভেম্বর অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়, যার পরদিনই শিক্ষার্থীরা সংঘাতে জড়ান।
এই সংঘাতের সূত্রপাত প্রসঙ্গে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, “১৯ নভেম্বর দুপুরে ঢাকা কলেজের সামনে থেকে সিটি কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী পাবলিক বাসে উঠতে গেলে তাদের সঙ্গে বাগবিতন্ডায় জড়ায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তাদেরকে মারধর করা হয়।
“এর জেরে পরদিন সকালে দুই কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজের বাস ভাংচুর করলে ঘটনাটি দুপুরের দিকে সংঘর্ষে রূপ নেয়।”
বাস ভাংচুর ও শিক্ষার্থীরা আহত হলেও কারও তরফ থেকে মামলা করা হয়নি জানিয়ে ২৬ নভেম্বর পুলিশের নিউ মার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার তারিক লতিফ বলেন, “সেদিনের ঘটনাটি এই দুই কলেজের ধারাবাহিক ঘটনারই জের। এর পেছনে সিরিয়াস কোনো ইস্যু পাওয়া যায়নি।”
সংঘর্ষের পর সিটি কলেজ ও ঢাকা কলেজের ক্লাস স্থগিত ছিল। গত রোববার থেকে ঢাকা কলেজের ক্লাস শুরু হয়েছে। আর বুধবার থেকে সিটি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষ ও অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ের ক্লাস শুরু হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হবে আগামী ১ ডিসেম্বর।
২৪ নভেম্বর রাতে তেজগাঁওয়ে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইলের (বুটেক্স) একদল শিক্ষার্থী সংঘাতে জড়ায়। ঘটনাস্থল তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার কাছাকাছি হলেও আকস্মিক এই সংঘর্ষে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ সাড়া দিতে পারেনি ‘সক্ষমতার অভাবে’। পরে পুলিশের সঙ্গে সেনাবাহিনী যোগ দিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এই সংঘর্ষের সূত্রপাতের কারণ অনুসন্ধানের বিষয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, “সেদিন ঢাকা পলিটেকনিকের চারজন শিক্ষার্থী বুটেক্সের আজিজ হলের সামনে চায়ের দোকানে চা-সিগারেট খাচ্ছিল, আড্ডা দিচ্ছিল। তারা দৃষ্টিকটূ এমন কিছু করছিল দেখে আজিজ হলের শিক্ষার্থীরা তাদেরকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। তখনই তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও দুই-তিনজনের মধ্যে সামান্য হাতাহাতি হয়।
“এরপর ঢাকা পলিটেকনিকের চার শিক্ষার্থী সেখান থেকে বেরিয়ে লতিফ হলসহ পার্শ্ববর্তী তাদের আরও দুইটি হলে খবর দেয়। তখন একযোগে ঢাকা পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা বুটেক্সের আজিজ হলে গিয়ে হামলা চালিয়ে শিক্ষার্থীদের মারধর শুরু করে ও ভাংচুর করে।”
পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, “প্রথমে আক্রান্ত আজিজ হলের শিক্ষার্থীরা একটু দূরে থাকা তাদের অন্য হলগুলোর শিক্ষার্থীদের খবর দিলে তারা একযোগে ঘটনাস্থলে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া থেকে শুরু হয়ে ঘটনাটি সংঘর্ষে রূপ নেয়।
“বুটেক্সের আজিজ হলের পাশাপাশি ঢাকা পলিটেকনিকের বাকি হলগুলো। পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা প্রথম বুটেক্সের হলে হামলা করলে তাদের অন্যান্য হলগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের যেতে কিছুটা সময় লেগে যায়। এর মধ্যে আজিজ হলের শিক্ষার্থীরা বেশি হামলার শিকার হয়েছে, আহতও হয়েছেন তারাই বেশি।”
এই সংঘর্ষের সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো যোগসাজশ রয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা এমন কিছু পাইনি। যেকোনো ঘটনাকে রাজনৈতিক ট্যাগ দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে আমাদের। এই সংঘর্ষটি একান্তই তুচ্ছ একটি কারণ থেকে হয়েছে।”
এ ঘটনায় ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি জানিয়ে ডিএমপির শিল্পাঞ্চল জোনের সহকারী কমিশনার রব্বানী হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তদন্ত করে ঘটনার বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।
ঢাকা পলিটেকনিকের লতিফ হলের শিক্ষার্থীরা বুটেক্সের লতিফ হলের সামনে গেলে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কথা-কাটাকাটির জেরে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।”
গত ২৪ নভেম্বর দুপুরে ‘সুপার সানডে' কর্মসূচির নামে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ও পাশের সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় মোল্লা কলেজসহ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এই হামলায় সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা জড়িত ছিল- এমন অভিযোগ তুলে ওইদিনই শিক্ষালয়টিতে হামলা চালায় সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরে সেন্ট গ্রেগরী বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
পরদিন ‘মেগা মানডে’ কর্মসূচি দেয় সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর অংশ হিসেবে তারা ডেমরা সড়ক সংলগ্ন মোল্লা কলেজে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। প্রায় দুই ঘণ্টার সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। ঘটনার সময় মোল্লা কলেজে ভাঙচুরের পাশাপাশি লুটপাটও হয়।
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার ছালেহ উদ্দিন বলেন, “পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী কয়েকটি কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষার্থীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের দিকে আসছিল। আমরা যাত্রাবাড়ী মোড়ে সীমিত ফোর্স নিয়ে তাদের ইন্টারসেপ্ট করতে ব্যর্থ হই।
“তারা আমাদের ওভারকাম করে কলেজের দিকে চলে আসে। আমাদের পুলিশ ফোর্স ছিল সীমিত, আর তারা ছিল সংখ্যায় কয়েক হাজার, যারা ছাত্র এবং অন্যান্য সাধারণ মানুষের বেশে আসছে।”
‘সুপার সানডে’ ও ‘মেগা মানডে’র নামে সহিংস কর্মসূচির বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) বলছে, ৩৫টি বিভিন্ন কলেজ শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে ইউনাইটেড কলেজ অব বাংলাদেশ (ইউসিবি) নামে ফেইসবুকে একটি ফোরাম সক্রিয় রয়েছে।
অপরদিকে ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা কলেজ, মিরপুর বাংলা কলেজ ও সরকারি কবি নজরুল কলেজ মিলে সাত কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের একটি জোট রয়েছে।
পরপর দুইদিনের হামলাতেই সংশ্লিষ্ট কলেজ ছাড়াও তাদের জোটভুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছে, বিভিন্ন ভিডিও বিশ্লেষণ করে এমনটিই দাবি করেছে পুলিশ।
উত্তরণের পথ কী
সবশেষ ‘সুপার সানডে’ ও ‘মেগা মানডে’ কর্মসূচি পূর্বঘোষিত হলেও সংঘাত ঠেকাতে ব্যর্থতার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম বলেন, “ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৬ বছরে পুলিশকে এমনভাবে সাজিয়েছে যে, এটার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সময় প্রয়োজন।
“দু-একজন বড় পদের কর্মকর্তাকে চাইলেই সরানো যায়, কিন্তু এত বড় বাহিনীতে হাজার হাজার পুলিশ কর্মকর্তা তাদের তো চাইলেই সরানো যায় না।”
তিনি এও বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি শিক্ষা উপদেষ্টাও এমন ঘটনা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা দ্রুতই ওনার সঙ্গে বৈঠকে বসব।”
সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম বলেন, “ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুগুলো সমাধান করেই প্রথমে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রত্যেকটা ক্যাম্পাসের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। আর সর্বোপরি ছাত্রসমাজের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করতে পারলে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা কমে আসবে, শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসবে।”
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “একা বা অল্প কয়েকজনের মধ্যে এই (সহিংসতা) প্রবণতা দেখা গেলে সেটিকে প্রকৃতপক্ষে রোগ বলা যায়।
“কিন্তু এখন যেটি হচ্ছে- সেক্ষত্রে তাদের উপর সামাজিক প্রভাব রয়েছে, তারা হয়তো কাউকে দেখে এমন ধ্বংসাত্মক আচরণে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এটিকে সামাজিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে।”
এসব সহিংসতা অন্যদের মধ্যে নিরাপত্তার আশঙ্কা তৈরি করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অভিভাবক, শিক্ষক ও প্রশাসনকে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। অতীতেও বিভিন্ন কলেজে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে; কিন্তু সেক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা দেখা যায়নি।
“অতীতের কোনো ঘটনাকে বিচার না করলে ধরে নিতে হবে- একই ধরনের বা কাছাকাছি ধরনের ঘটনা আবার ঘটবে।”
জোরালোভাবে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যাতে অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়, সেই পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কমিটি থাকার পরও কেন সহিংসতা থামানো যাচ্ছে না, এমন আলোচনার মধ্যেই মঙ্গলবার থেকে ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন শুরু হয়েছিল। যখন এক পর্যায়ে সরকার অসহযোগিতা করতে শুরু করল, তখন কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়- তখনো শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে বিভাজিত করার চেষ্টা আগেও ছিল, এখনো আছে।
“শিক্ষার্থীদেরকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে পতিত স্বৈরাচার। ন্যাশনাল মেডিকেলে যখন শিক্ষার্থীরা সহপাঠীর নির্মম মৃত্যুর বিষয়ে আন্দোলন করছিলেন, তখন সেখানে একটি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। আবার সোহরাওয়ার্দী কলেজও মেডিকেল কলেজের পক্ষে ছাত্রদের উপর হামলা করে। সেখান থেকেই সূত্রপাত হয়। এইসব বিষয়ে আমাদের মনে হয়েছে একটি গ্রুপ ছাত্রদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে। মূলত উদ্দেশ্যই তাদের- ছাত্রদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা।"
[জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি অনুপম মল্লিক আদিত্য এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন]
পুরনো খবর
'মেগা মানডে': সংঘাতে রণক্ষেত্র মোল্লা কলেজ, আহত শতাধিক
দলে দলে এসে ন্যাশনাল মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী কলেজে তাণ্ডব
ঢাকা পলিটেকনিক ও বুটেক্সের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ, উত্তেজনা
'হাতাহাতি থেকে বাস ভাঙচুর': ঢাকা ও সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ
তিতুমীরে 'ক্লোজডাউন' কর্মসূচির মধ্যে পুলিশ প্রবেশ নিয়ে 'উত্তেজনা'