খণ্ডিত জীবন (কিস্তি ১০)

ফয়েজ আহমেদ
Published : 26 Oct 2011, 04:47 PM
Updated : 26 Oct 2011, 04:47 PM

(কিস্তি ৯-এর পরে)

শেখ সাবের সাথে আমরা ছিলাম মাত্র মাস খানেক। থাকার পরে একদিন সকালবেলা আবার সেই নাজির জমাদার আইসা উপস্থিত, ভোর সাড়ে আটটায়। আইসা শেখ সাবরে বইলা গেলো—আপনার রিলিজ হইয়া গেছে। আপনি রেডি হন, ঘন্টাখানেক পর অফিসার আইসা আপনাকে রিলিজ কইরা দিবে। এই কথা শেখ সাবরে বলায় সে খুশি। এখন আমরা যারা নাকি বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে আইছিলাম, সে আইসোলেট হওয়ায়, তারা আইসোলেট হইয়া গেলাম এবার! এবং সে রিলিজ হইয়া গেলো। তাকে রিলিজ করার জন্য যখন আয়োজন চলছে ৯ টার দিকে, তখন তাঁর বালিশ, তোশক, লেপ, তাঁর কাছে কিছু বই-পুস্তক ছিলো—তাঁর স্যুটকেসের ভিতরে সেগুলি নেওয়া, তাঁর গামছা বা লুঙ্গি বা পাজামা—এগুলি সাজাইয়া দেওয়া, আমরাই সাহায্য করলাম।


হরিণ এবং শেখ মুজিবুর রহমান, ছবি: অজানা

তখন উনি বললেন, তোরা যার যার সেলে যা, খাওয়ার বন্দোবস্ত কর, আমি যাওয়ার সময় তোগো ডাকমুনে, আমাকে যখন নিতে আসবে। আর আমাকে কইলো, তুই বয়, তোর লগে কতা আছে। কইলো, তুই জেলে যে দুই-তিন বছর রইলি, তাতে লেখস নাই কিছু? কইলাম, হ্যাঁ আমি তো লেখছি, আমার কাছে ম্যানুস্ক্রিপ্ট আছে তো! কয়, ওগুলি আমাকে দিয়ে দে। তুই পরে নিতে পারবি না। আমি হম্বি-তম্বি কইরা জেল গেট দিয়া পার হইতে পারমু—নিয়ম হইলো আইবির কাছে দেখাইতে হয়—ওইগুলি আমাকে তাড়াতাড়ি কইরা আইনা দে। আমার বিছানার মধ্যে ঢুকাইয়া দে।

আমার সেল তাঁর রো-তেই ছিলো। আমি আমার তিনটা খাতা আইনা তাঁকে দিলাম। তিন বছরে আমি যা লিখছি। এবং সে বালিশ কাইটা, বালিশের তুলার ভিতরে আমার তিনটা ম্যানুস্ক্রিপ্ট ঢুকাইয়া দিলো। ঢুকাইয়া সিলাইয়া দিয়া রাইখা দিলো। আমাকে কইলো, এগুলি বান্ধো।

তাঁকে নিতে আইলো দশটার দিকে। সে চইলা গেলো সবাইর কাছে থেকে বিদায় নিয়া। আমরা তো কেউ আর তাঁর সাথে বিদায় দিতে যাইতে পারবো না, আমরা সেল গেটে তাঁকে বিদায় দিলাম। অন্য লোকজন আইসা স্যুটকেস, বিছানা—এগুলি নিয়া গেলো, সে-ও চইলা গেলো। আমরা চিন্তায় ছিলাম—ধরা পড়লো কিনা।

সন্ধ্যার সময় জানা গেলো—না ধরা পড়ে নাই, শেখ সাব ঠিক মতো তাঁর বাড়িতে পৌঁছাইছেন। এবং এভাবে আমার খাতাগুলি বের হইয়া গেলো জেল থেকে। শেখ সাব আমার ইমিডিয়েট বড় ভাইয়ের ঠিকানা নিয়া গেছিলেন আমার কাছ থেকে—ঢাকায় থাকেন উনি। টেলিফোন নাম্বার, ছিলো আমার কাছে—এই টেলিফোন নাম্বার আমি দিছিলাম; বললাম, আমার ভাইকে আপনি টেলিফোন কইরা দিয়েন, সে আইসা ম্যানুস্ক্রিপ্ট নিয়া যাবে।

তাই সে করছে। যাইয়াই টেলিফোন করছে, আমার ভাই যাইয়া রাতের বেলা নিয়া গেছে। ওই ম্যানুস্কিপ্টটার নাম ছিলো রিমঝিম। রিমঝিম ছাড়াও দুইটা ছিলো। এই তিনটা পরে পাবলিশড হইছে। আরো বছরখানেক পরে আমার রিলিজ হইছে। এই এক বছর ম্যানুস্ক্রিপ্ট তিনটা আমার ভাইয়ের কাছে ছিলো। রিলিজের পরে আমি ভাইয়ের ওইখানে গেলাম। সেইখানে একদিন বাংলা একাডেমীর রাব্বী সাহেব এবং আদারস্—আরো দুই তিনজন আমার কাছে আসলো। বললো, জেলখানায় ছিলেন এদ্দিন, জেলেখানায় কিছু লিখছেন কি না? লেইখা থাকলে আমরা ইন্টারেস্টেড। আমি কইলাম, হ্যাঁ কিছু লিখছি। ম্যানুস্ক্রিপ্ট আছে আমার কাছে, ফ্রেশ কইরা লেখা হয় নাই। আমি তখনো দেখি নাই—কী অবস্থায় আছে ওগুলা। তখন খুইলা দেখা হইলো স্যুটকেস—কী অবস্থায় আছে। দেখা গেলো, সব ঠিকঠাক আছে–ম্যানুস্ক্রিপ্টের খাতা। রাব্বী সাহেব বললেন, আমাদের দেন, আমরা ছাপাবো। আমি পাণ্ডুলিপি তাঁর হাতে তুলে দেই।

কিছুদিন পরে সে জানাইলো—বাংলা একাডেমীতে একটা কম্পিটিশন হইতেছে, পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা। এতে আমরা টাকা দেবো, আর বইটা পাবলিশ কইরা দেবো। আপনে সাবমিট করেন দয়া কইরা। তখন আমি ওই খাতা সাবমিট করলাম, ফ্রেশ কইরা লেইখা। আমারটা ফার্স্ট হইয়া গেলো! আমি পাণ্ডুলিপির পুরস্কারটা পাইলাম, বাংলা একাডেমী থেকে। কিছু টাকা দিলো, আর আমার বইটা ওরা ছাপাইলো। ওইটার নামই হচ্ছে—'রিমঝিম'।

এই 'রিমঝিম'টা শেখ সাব না নিয়া আসলে আমার পক্ষে অরিজিনাল ম্যানুস্ক্রিপ্ট বের করা কঠিন হইতো। বের হওয়ার সময় আইবি থাকে জেলগেটে। তারা রাইখা দেয়। তারা কয়, এইটা আমরা পইড়া দেখবো—দেশদ্রোহিতামূলক কোন লেখা, নাকি ভালো লেখা। যদি দেখি ভালো লেখা, এইটা আমরা ফেরত দিয়া দেবো। আর ফেরত দেওয়া হয় না। আইবির কথা সত্য নয়; তারা লেখা আর ফেরত দেয় না।

আমি যে প্রাইজটা পাইলাম, এইটার মূল কারণ–শেখ সাব জেল থেকে আমার পাণ্ডুলিপি বাইর কইরা আনছিলো। এইটা ছিলো বাংলা একাডেমীর প্রথম পাণ্ডুলিপি পুরস্কার।

জেলে দুর্যোগ ও বিড়ম্বনার শেষ নেই। কখন যে আপনি কোন বিড়ম্বনায় পড়বেন তার ঠিক নেই। জেলের ডাক্তার, কর্মচারী-কর্মকর্তা, জেলার—এমনকি জমাদার পর্যন্ত আপনার দুষমন হতে পারে। সরকারী কর্মচারীরা মনে করে, আমরা দেশদ্রোহী, রাষ্ট্রবিরোধী—সেই কারণে আমাদের শাস্তির কোন সীমা নেই। অনেক শাস্তি কোর্টে দেয় নাই—কিন্তু জেল বিধানের শাস্তি থেকে বাঁচার উপায় নাই।

অনেক সময় জেলের বাইরে নিয়ে গিয়ে আইনের বাইরে শাস্তি দেয়া হয়—সিকিউরিটি প্রিজনারদের ব্যাপারেই এমন অলিখিত বিধান প্রয়োগ করা হয়। যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া কারাভোগী কারো উপর নির্যাতন করা যাবে না। সে কারণে কর্তৃপক্ষ আমাদের শাস্তি প্রয়োগের জন্য প্রায়ই জেলের বাইরে নিয়ে যেত। নির্যাতনটা বাইরে করা হতো আইন বাঁচাতে।


তুবা'র পেছনে ফয়েজ আহ্‌মদ, ধানমণ্ডি, ২৬ অক্টোবর ২০১১

একবার জেলখানার বাইরে থেকে আমাদের নামে ডাক এলো—সরদার ফজলুল করীম, পরে শহীদুল্লাহ কায়সার, ফয়েজ আহমদ ও আর এন সৈয়দ। এ চারজন প্রথম ডাকে জেলের বাইরে যেতে বাধ্য হয়। সবার শেষে লালবাগ সেল থেকে কঠোর ইন্টারোগেশনের পর আমাদের পুনরায় ঢাকা জেলে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু তরুণ আর এন সৈয়দ নামের ময়মনসিংহের এক যুবকের উপর নির্যাতন হয়। তাকে জেলে সুস্থ অবস্থায় প্রেরণ করা যায় নাই। স্ট্রেচারে করে তাকে জেলে ফেরত পাঠানো হয়। তাকে জেল হাসপাতালে রাখার পর জেল-ওয়ার্ডে প্রেরণ করা হয়। পরে তরুণ সৈয়দ অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করে।

এইভাবে মন্থর মৃত্যু আমাদের অনেককে গ্রাস করেছে। আমি একবার রাগ সামলাতে পারিনি। তার পরিণতিতে মৃত্যুমুখী হতে চলেছিলাম। ডা. মকবুল নামক এক ছোকরা ডাক্তারের সিকিউরিটি ওয়ার্ড দেখার দায়িত্ব পড়েছিলো। সে সাত দিনের জায়গায় পনের দিনে একবার বন্দী রোগীদের দেখতে আসতো। তার সাথে কিছু ওষুধ ও একজন বন্দি চাপরাশি সর্বদা থাকতো। বন্ধু নিরাপত্তাবন্দী বিনোদ দাশগুপ্ত আমাদের ওয়ার্ডেই থাকে। তাঁর ক্রনিক পেটের অসুখ সারে না। কিন্তু মকবুল ডাক্তারও ওষুদ দেয় না।

এক সময় ঢাকার সিভিল সার্জন ছিলেন প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল আমিন সাবের আত্মীয়। তিনি ছিলেন একান্ত সৎ ব্যক্তি। তিনি মাসে একবার জেল ভিজিটে আসেন। তাঁর কাছে বন্ধু বিনোদের কথা বলা হলো। তিনি জেলের বাইরে থেকে ওষুধ কেনার প্রেসক্রিপসন করলেন। ১৫ দিন হয়ে গেছে, সে ওষুধ আর কেনা হয় না।

ডা. মকবুল সেদিন আমাদের ওয়ার্ডে এসেছিলেন। এই ব্যাপারে আমি খুব চটে ছিলাম। সিভিল সার্জন লেখার পনের দিন হয়, ওষুধ দেয়া হয় না। ডাক্তারকে বললাম, বিনোদের ওষুধ কোথায়? সিভিল সার্জন লিখে দিলেন তবুও ওষুধ নেই কেন? ডাঃ মকবুল ক্ষেপে গেল আমার উপর এবং বললো যে, আপনি কেন মাথা ঘামাচ্ছেন? ওষুধ বিনোদ বাবুর। এ কথা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে গেলো। ঝাপিয়ে পড়লাম ডাক্তারের উপর। জেলখানায় তৈরি শক্ত স্যান্ডেল দিয়ে ডাক্তারের উপর আক্রমণ। ফণি মজুমদার, শহীদুল্লাহ কায়সার ডাক্তারকে ধরে রাখলেন এবং বন্ধু মোহাম্মদ সুলতান পাহারাদার সেপাইর হাত থেকে পাগলাঘন্টার বাঁশি নিয়ে নিলো। ডাঃ মকবুল সে যে মার খেলো তা আর ভোলার নয়। তিনি অন্যদের সাহায্য নিয়ে আমাদের ওয়ার্ড থেকে পালালেন।

তখন আলোচনা শুরু হলো—আমাকে কিভাবে জেল কর্তৃপক্ষের হাত থেকে বাঁচানো যায়। দুদিন পর আমার অফিস কল এলো। অর্থাৎ ডা. পেটানোর দায়ে আমার জেলকোর্টে বিচার হয়েছে। আমাকে ডাকা হয় নাই। সেই বিচারে জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে ছয় মাসের নির্জন কারাভোগের আদেশ দেন।

এই ছয় মাস আমি একটা নির্জন বন্দিশালায় একান্তই একা বাস করেছি। কেবল দেয়াল বেয়ে একটা বিড়ালি আসতো যেতো। ১ নং খাতা থেকে আমার তিন বেলার খাবার আসতো। ছয় মাস সিপাই ছাড়া কোন মানুষের মুখ দেখি নাই। কোন চিঠিমাত্র ছিলো না—একা ছয় মাস।

(চলবে)

—–

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: ফয়েজ আহমদ
ইমেইল: artsbdnews24@gmail.com

ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts