খণ্ডিত জীবন (কিস্তি ৫)

ফয়েজ আহমেদ
Published : 11 Sept 2011, 05:17 PM
Updated : 11 Sept 2011, 05:17 PM

(কিস্তি ৪ এর পরে)

১৯৪০-এর দশকে শ্রীনগরে ছিলো পোস্ট অফিস, থানাসহ আরো কিছু সরকারী অফিস। আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজন শ্রীনগর বাজারে যাইতো, বাজার করতো, খবরাখবর পাইতো। ৪২-৪৩ সালে কংগ্রেসের ভারত ছাড় আন্দোলন বা মুসলীম লীগের রাজনীতির খবরাখবর শ্রীনগর বাজার গিয়াই গ্রামের লোকজন পাইতো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বা বিশ্বযুদ্ধের খবর আসতো। রায়ট-দুর্ভিক্ষের খবরও পাওয়া যাইতো। তখন তো টেলিফোন আছিলো না, টেলিগ্রামের যুগ ছিলো তখন। শ্রীনগর বাজারের পাশ দিয়া টেলিগ্রামের তারের লাইন ছিলো। হয়তো কারো পোলা-মাইয়া কোলকাতা থাকে, অথবা কোন আত্মীয় থাকে—তারা খবরাখবর দেওয়া-নেওয়া করতো টেলিগ্রামের মাধ্যমে। ঠিকভাবে পৌঁছাইতে পারলো কিনা, অসুস্থ্য হইলে বা মারা গেলে টেলিগ্রাম করা হইতো। টেলিগ্রামের বার্তা খুব ছোট থাকতো। অক্ষর অনুযায়ী টাকা দিতে হইতো। এই কারণে লোকে অল্প কথায় সাইরা ফালাইতো।


ধানমণ্ডির বাসায় ফয়েজ আহ্‌মদ, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১১

আমাদের বাড়িতে দেশ-বিদেশের খবর পাইতাম বেশিরভাগই পত্রিকায়। বাবা 'সওগাত', 'আনন্দবাজার পত্রিকা'র গ্রাহক হইছিলো। 'মাসিক মোহাম্মদী'ও ছিলো। ডাকে আমাদের বাড়িতে আইতো। আমরা পড়তাম। পাক্ষিক 'সওগাত'-এর সম্পাদক ছিলেন নাসির উদ্দিন সাহেব। 'সওগাত'-এ নজরুল ইসলাম লিখতেন। এইগুলা আমি যখন পড়তে শুরু করি সেই রকম সময়েই নজরুল ইসলাম অসুস্থ্য হইয়া পড়ে। আমি একবার বাড়িতে না বইলা কোলকাতা চইলা গেছিলাম। তখন মানুষজনরে জিগাইয়া জিগাইয়া নজরুলের বাড়িতে গেছিলাম। তখন নজরুলের বউ আর নজরুল—দুইজনই অসুস্থ্য। আমি কয়েক মিনিট খাড়াইয়া দেখলাম, পরে চইলা আসলাম। কোন কথাবার্তা হয় নাই কারো সাথে। ছোটদের জন্যও 'সওগাত' আছিলো। সেইটার নাম ছিলো 'শিশু সওগাত'। এই পত্রিকায় আমি কবিতা পাঠাইয়া দিছিলাম ডাকে, 'সওগাত'-এর কোলকাতার ঠিকানায়। 'শিশু সওগাত'-এ ছাপা হইছিলো সেইটা। সেইটাই আমার প্রথম ছাপানো লেখা।

যাই হোক, এইসব পড়ার ফল হইলো আমি তখনই রাজনীতি নিয়া কিছু কিছু চিন্তা করতাম। আমার বাবার মধ্যেও এক ধরনের সচেতনতা আছিলো। তারে থানা মুসলীম লীগের প্রেসিডেন্ট হইতে কইছিলো। বাবা রাজি হয় নাই। পরে এই এলাকার প্রেসিডেন্ট হইছিলেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী'র বাবা কফিল উদ্দিন চৌধুরী।

শ্রীনগরে কংগ্রেস বা মুসলীম লীগে লোক বেশি ছিলো না। কাজকর্মও চোখে পড়ার মতো কিছু ছিলো না। আমার চিন্তা-ভাবনা মনে হয় কংগ্রেস-এর মতো ছিলো অনেকটা। কংগ্রেস-এর ভারত ছাড় আন্দোলনের কথা পত্রিকায় পইড়া আমিও মনে মনে ভারত ছাড় আন্দোলন করতাম। তখন তো স্কুলে পড়ি, আমরা পাঁচ/ছয় জন বন্ধু একসাথে চলাফেরা করতাম। হিন্দু-মোসলমান মিলাইয়া। আমরা একবার চিন্তা করলাম কি করা যায়? এই যে ইংরেজের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলতাছে, এইখানে আমাদের করণীয় কী আছে—দেখা যাক। আমরা পোলাপান মানুষ, সিক্স-সেভেনে পড়ি, আমরা ঠিক করলাম যে আমাদের কিছু করতে হবে। আমরা চিন্তা-ভাবনা কইরা ঠিক করলাম যে, কিছু না পারি, ব্রিটিশদের এই টেলিগ্রামের তার কাইটা দিমু। বিরাট ক্ষতি করছি–আসলে নিজেদেরই, কিন্তু আমরা বুঝি নাই যে কতোটা ক্ষতি হবে। আমরা সিদ্ধান্ত করলাম—টেলিগ্রাম তার কাইটা দিলে ইংরেজরা বিপদে পড়বে। এইটা ইংরেজদের টেলিগ্রাম তার, শ্রীনগরে একটা সাব-স্টেশন, শ্রীনগর থেকে মুন্সীগঞ্জ, তারপর ঢাকা—কত টেলিগ্রাম আসা যাওয়া করে ব্যক্তিগতভাবে, সেইটা আমরা চিন্তা করি নাই।

আমরা পাঁচ-ছয় জন একদিন স্কুল থেকে ফিরে শ্রীনগর বাজারেই রইয়া গেলাম। ওইখান থেকে পুরি-টুরি কিইনা খাইলাম। সন্ধ্যা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। সন্ধ্যা হইলে, অন্ধকারে তার কাটা যায়। সন্ধ্যা হইলো। তখন আমরা শ্রীনগর বাজার থেইকা এক ফার্লং দূরে, গ্রামের ভিতর দিয়া আইছে তারটা, ওইখানে গিয়া তারটা কাইটা দিলাম। কিছুই না বুইঝা। এতে আরো ক্ষতি হইছে আমাদের-ই, আমার মতে। সেইটা হইলো সাধারণ লোকে আর টেলিগ্রাম করতে পারে না, ওইটা দিয়া ইংরেজরা তো তেমন কিছু করে না। সাধারণ লোকে—অমুকে মারা গেছে, অমুকের ওষুধ আনো ঢাকা থেইকা, অমুকে কোলকাতা পৌঁছাইলো কিনা—এই তো খবর। কিছুই আর করতে পারে না। সরকারও সারাই করে নাই, আন্দোলনের অনেক পরে সারাই করছে ওই লাইন। তারটা আমরা কেচির মতো পাওয়া যায়, কী যেন নাম—ভুইলা গেছি, ওইটা দিয়া, চঙ্গা আইনা, উইঠা কাইটা দিছিলাম। ওইটাই তখন আমরা মনে করছি আমাদের কৃতিত্ব। কিন্তু সাধারণ লোকের এতো দুর্ভোগ। আমরা তখন বুঝতে পারি নাই যে এইটা সাধারণ লোকের জীবনযাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এইগুলা করছি। বুঝদার কোন নেতা আছিলো না। আমি-ই মাতুব্বরী করতাম। নেতা না থাকায় ইংরেজের ক্ষতি করতে গিয়া নিজেদেরই ক্ষতি কইরা ফেললাম।

এ ছাড়াও করছি, মাছের ঘাট ছিলো, সেই জায়গায় করছি। শ্রীনগর থানায় খাল দিয়া মাছ আসে। নৌকায় ঘাটে আসে। ঘাটে মাছ বিক্রি হয়, আবার বাজারে উইঠা বিক্রি হয়। ওইখানে যাইয়া আমরা বাধা দিছি। বাধা দিছি, লাভ হয় নাই কিছু। বাধা দিছি যে ইংরেজদের কোন কাজকর্ম করতে পারবা না। পুরাই বেহুদা, ভুল—ভুল তত্ত্ব আর কি। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি পলিটিক্যাল কিছু লোক ছিলো, তারা পালাইয়া গেছে। পুলিশের ভয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে। হিন্দু-মোসলমান, তারা নাই কেউ। কোন লিডারশিপ ছিলো না। আমরা নিজেরাই লিডার। তার জন্য ভুল-ত্রুটি হইছে।

এই সব আন্দোলন, দুর্ভিক্ষ, মহাযুদ্ধ, রায়ট চলতে চলতে ১৯৪৭ আইসা পড়লো। ৪৭-এ ভারত আর পাকিস্তান যখন হইলো তখন আমি ঠ্যাং ভাইঙ্গা বিছানায়। বাম পাও ভাঙ্গা, প্লাস্টার দেওয়া ছিলো। শুইয়া আছি দোতলায়। আমরা তো খবরাখবর রাখতাম। আমি ফলো করতাম, একটা আগ্রহ ছিলো। অন্যদের সেইটা ছিলো না। একটু অ্যাডবান্স ছিলাম আর কি। খবর পাইছিলাম যে পাকিস্তান হইছে। কিন্তু গ্রামের মানুষজনের চেহারায় পাকিস্তান হওয়ার কোন ছাপ দেখি নাই। পাকিস্তান হইলো কি হইলো না, ইংরেজরা চইলা গেছে কিনা—এইগুলা নিয়া গ্রামের মানুষ মাথা গামাইতো না। আমাদের গ্রামের মানুষজন এইগুলা কিছু টের পায় নাই। কোন মিছিল, মিটিং বা আনন্দ-উল্লাস—ব্রিটিশ চইলা গেলো—তাও হয় নাই। দেশ যে স্বাধীন হইলো—সেইটা বুঝলোই না গ্রামের মানুষ। দুই-একজন হয়তো কিছু বুঝতো, নিজে নিজে চেষ্টা কইরা, নিজের আগ্রহে।

গ্রামের মানুষ স্বাধীনতা বোঝে নাই, বুঝলো একটু পরে। আমাদের ওইখানে রায়ট না হইলেও দুর্ভিক্ষ হইছে। বহু হিন্দু-মোসলমান মইরা গেছে। বাঁইচা থাকা হিন্দুরা পাকিস্তান হবার পরে ভারতে চইলা যাইতে থাকলো। পাকিস্তান হইছে, হিন্দুরা মনে করলো এইটা মোসলমানের জায়গা, মোসলমান বেশি, আমরা থাকতে পারবো না, তাই চইলা গেলো। প্রচার হইয়া গেলো যে, পাকিস্তান মোসলমানদের দেশ। হিন্দু বড়োলোকরা তো আগেই কোলকাতায়। সেইখানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, বাড়ি আছে। তারা আর ফেরে নাই। মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং একেবারে সাধারণ হিন্দু—তারা এইবার যাওয়া আরম্ভ করলো।
তখনো রাস্তাঘাটে বাধা হয় নাই। গোয়ালন্দ স্টীমার ঘাট বন্ধ হয় নাই। স্টীমারে চইড়া ওপাড়ে নামলেই রেল পাওয়া যায়। এইভাবে চইলা যায়। একজন যাবার সময় আরো তিনজন নিয়া যায়। ভিটা-বাড়ি বেইচা সবাই চইলা যাইতেছে। আর মোসলমানরা সেইগুলা অল্প দামে কিইনা রাখলো। এইভাবে মোসলমান অনেকেই অনেক জমির মালিক হইছে!

তখন গ্রামের মানুষ টের পাইলো যে দেশ স্বাধীন হইছে। হিন্দু সব চইলা গেছে। নাপিত নাই, ধোপা নাই, মুচি নাই। কৃষি কাজের জন্য কাস্তে লাগে, লাঙলের ফলা লাগে—কামার এইগুলা বানায়। মাটির হাড়ি-পাতিল বানায় কুমার। এরা সবাই হিন্দু, চইলা গেছে, যাইতেছে! নিচু কাজ বইলা মোসলমানরা এইগুলা করতে রাজি হইলো না। মোসলমানরা চাইলেও তো পারবে না, তারা তো জানেই না এই সব কাম! মোসলমানরা খালি শার্ট-প্যান্ট বানাইতে জানতো। দর্জি। তাদের বলা হইতো খলিফা। আর কিছু মোসলমান পারে না। মোসলমানরা যে মিষ্টি খায়—হেইডাও বানাইতো হিন্দু ময়রা। হেও চইলা গেছে। সব দোকান বন্ধ। এই রকম অবস্থায় সবাই বুঝলো যে দেশ স্বাধীন হইছে।

আগে সব মোসলমান পাকিস্তান চাইছিলো। আমরা কিছু ইয়াং ম্যান ভাবতাম একটু অন্যভাবে। কিন্তু বয়স্ক লোক মানেই পাকিস্তান। তারা এইবার বুঝলো বিপদ। কংগ্রেস নাই, হিন্দুরা চইলা গেছে, মোসলমান দুই-একজন থাকলে মুসলীম লিগে যোগ দিছে, বেশিরভাগ নিষ্ক্রিয় হইয়া গেছে। মুসলীম লীগ-ই আছে, কামার-কুমার-ধোপা-নাপিত নাই। সমাজ ভেঙে পড়ার উপক্রম। এইগুলা অচ্ছুৎদের কাজ মনে করা হইতো, মোসলমানেরা করতো না।

[চলবে…]

পরের কিস্তি: কিস্তি ৬

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: ফয়েজ আহমদ
ইমেইল: artsbdnews24@gmail.com

ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts