খণ্ডিত জীবন (কিস্তি ৪)

ফয়েজ আহমেদ
Published : 4 Sept 2011, 06:20 PM
Updated : 4 Sept 2011, 06:20 PM

(কিস্তি ৩ এর পরে)

১৯৪৫ সালে আমি টেন-এ পড়ি। এই সময় দুই-তিন মাস বাড়ির সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিলো না। আমি পালাইয়া ঢাকা আইসা ব্রিটিশ বিমান বাহিনীতে যোগ দিছিলাম। বাড়ি থেকে বোনের বাড়ি, মুন্সীগঞ্জ। সেইখান থেকে আমার ফেরার কথা বাড়ি, আমি না বইলাই চইলা আসছি ঢাকায়।

…………
বিডিনিউজ২৪.কম অফিসে ফয়েজ আহ্‌মদ
…………
আমার বড় বোনের স্বামী উকিল। তারা মুন্সীগঞ্জ থাকতো। আমাদের বাড়ির নিয়মে, বছরে দুই একবার আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। শুকনার দিনে পানি নাইমা যায়। তখন পুকুরে মাছ ধরা হয়। বাড়িতে তরি তরকারী হয়। বেগুন, আলু, কাঁচা মরিচ, ধনিয়া পাতা, মুলা এগুলি আমাদের কোলায় হয়। আমাদের বাড়ির গায়ে তিন কাঠা জমি, সেই তিন কাঠায় এইগুলা হয়। যারা কাজ করতো তাদের দিয়ে বাবায় বেগুন চারা, মরিচ চারা, ধনিয়া কিনে দিতো আর তারা তা লাগাত। শীতকালে দু'তিন মাসের মধ্যে বেগুন হয়, আলু হয়, লাল শাক হয়; দুই মাসের মধ্যেই হয়ে যায়। বড় কুমরা—লাল-লাল মিষ্টি কুমরা, আবার চাল কুমরাও হয়। কোন কোন ঘরে চালের উপর দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া হয়। এইগুলো আমি চাক্ষুষ দেখছি, আমাদের বাড়িতে ঘটছে এগুলি।

চাল কুমরা মোরব্বা বানায় আর লাল কুমরা তো তরকারী হিসাবে খায়। লাউ, চাল কুমরা, মিষ্টি কুমরা, আরও জানি কি কুমরা আছে, তার পরে ধনিয়া পাতা হইতো। ডাটা হইতো এক ধরনের, সেইটা অনেক বড় হয়, বড় হইলে ওই ডাটা থেকে পাতাটা তুলে নিয়ে শাক হিসাবে খাওয়া হয়। আবার পুরা ডাটাই তুলে নিয়ে তরকারী হিসাবে খাওয়া হয়। মোটের উপর, দু/তিন মাস আমাদের বাড়িতে তরি তরকারীর প্রাচুর্য থাকতো। খাইতে বইসা ক্ষেত থেকে ধনিয়া পাতা, কাঁচা মরিচ আমরা আইনা খাইছি, এই রকম আর কি। তরি তরকারী আর পুকুরের মাছ–এই গুলি বাবা তার বড় মেয়ের কাছে পাঠাইতো। এই দুইটা বড় বোয়াল, তারপরে একটা আইর মাছ, বড় গজার মাছ, তারপরে ২০টা বড় কই–এগুলোর এক একটার দাম এখন ২০০ টাকা, মাগুর মাছ–এগুলো লোক দিয়া পাঠিয়ে দিতাম। এছাড়া তেলও থাকতো। সরিষা আর তিল এই দুইটা জিনিশ আমাদের ক্ষেতে হইত। এইগুলির ভাগ আমরা কিছু কিছু পাইতাম, সেইগুলি বাবায় রেখে দিত। এই দুইটাকে, তিল-সরিষা–এইগুলির কল আছে তেল বাহির করার, নগদ তেল বাইর করতাম, ঐ তেল আমরা খাইছি, ঐটাই পিওর সরিষার তেল। সরিষা ছাড়া তেল হয়, তা আমরা জানতাম না। তখন সয়াবিন তৈল–শব্দটাই শুনি নাই, এতো কালকের কথা! সরিষার সাথে তিল দিয়ে মিক্স করে তেল বানানো হইতো। যেমন ওয়ান-ফোর্থ তিল দিল, বাকিটা সরিষা দিল। এই দুইটা মিক্স করে তেলটা বাইর করে। এইগুলা পাঠাইতো। কাজের লোকের মাথায় ডালা, ডালার মধ্যে এইসব দিয়া দিতো বাবায়। আর লগে আমারে পাঠাইতো। আমি যাইতাম, আমি আছিলাম তখন পাহারাদার আর কি।

আমি খুব ফুর্তিতে থাকতাম যে বোনের বাড়ি যাবো। তো আমাকে বলা হতো কালতে সকালে মাছ, তরি তরকারী দুই ঝুরি শিং মাছ, পুঁটি মাছ, মাগুর মাছ, গজাল, বোয়াল, শৌল, এইগুলি নিয়ে বোনের বাড়ি যাইতে হবে। গ্রামীণ কামলা বা মুটে–দুই জনের মাথায় এইগুলি, আর সঙ্গে আমি। বোনের বাড়ি গেলে আমার বোন অনেক খাওয়াইতো তারপরে আসার সময় ওদের দুজনকে কিছু টাকা দিত। এতে ওরা খুব খুশি হতো।

আমি দুই-তিন দিন পরে আসতাম। আসার সময় আমার বোনে আমাকে পাঁচ টাকা দিত। তখন আমার ফিরতি খরচা এক টাকা লাগে। তো বাকিটা থাকতো, আমি খুব খুশি। সেবার আমি বোনের বাড়ি তিনদিন থাইকা বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বাইর হইলাম। কিন্তু বাড়ির দিকে না যাইয়া চইলা গেলাম মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাট। বিভিন্ন জায়গার লঞ্চ যাওয়া আসার পথে মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাটে ঘাট দেয়। মুন্সীগঞ্জে ঘাট দিয়া কোন কোন লঞ্চ নারায়ণগঞ্জে যায়, কোন কোন লঞ্চ ঢাকায় যায়, কোনটা আসে, কোনটা চাঁদপুর যায়, বরিশাল যায়। তো আমি লঞ্চঘাটে আইসা দেখি একটা লঞ্চ ঘাটে লাগাইছে, নারায়নগঞ্জ যাবে। মুন্সীগঞ্জ থেকে নারায়নগঞ্জ নিয়মিতই লঞ্চ চলতো। যারা ঢাকার প্যাসেঞ্জার তারা নারায়ণগঞ্জে নাইমা তারপর তারা বাসে ট্রেনে কইরা ঢাকা যাইতো। আমি নারায়ণগঞ্জে আইসা পড়লাম। তারপর ট্রেনে ঢাকা। তখন রেল স্টেশন ছিলো ফুলবাড়িয়া, কমলাপুর নেওয়া হয় পরে। আমার এক চাচাতো ভাই ছিলো ফজলুল হক হলের ছাত্র। আমি তার কাছে গিয়ে উঠলাম, সে খুব খুশি। বললো যে আমার সাথে থাকবি। একটাই বেড, তার লগেই ঘুমাইতে হবে।

রাতের বেলা আমার ভাইয়ের রুমে ৪/৫টা ছেলে আসা যাওয়া করে। কেউ নোট নিতে আসে, কেউ নোট দিতে আসে, কেউ আড্ডা দিতে আসে। অন্য রুম থেকে আর কি। তো দুইজন ছেলে এসে আমার ভাইকে জিজ্ঞেস করলো যে, কি করো? আমার ভাই বললো যে বিএ পরীক্ষা দিব। তারা বললো ধুর কিসের বিএ পরীক্ষা, চল আর্মিতে লোক নিতেছে, এখনই চইলা যাই। দুই দিন আগে পরে তো চাকরি করতেই হবে, তো এখনই চাকুরিতে ঢুকি আর্মিতে গেলে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাবার পর আমরা একটা বড় চাকুরি পাব। চলো যাই গা আমরা আর্মিতে। আমার ভাই জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করলো যে কেমনে যাবো, আমি কিছু চিনি না, জানি না পথঘাট, কোথায় গিয়ে বলবো যে আমাকে নাও! আমি বিছানার মধ্যে শুয়ে শুয়ে শুনলাম যে ভাইয়ের সাথে আলাপ করতেছে। ঐখানে রিক্রুটমেন্ট হইতেছে, বনানী বইলা একটা জায়গাতে। আজকের বনানী তখন ছিলো জঙ্গল। বনানী ছিল শালগাছ, বটগাছ, ঝোপঝাড়ে ভরা। তারা আমার ভাইরে বললো যে ঐখানে যেতে পারলে চাকরি শিউর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে ঢাকার বনানীতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রিক্রুটমেন্ট করার জন্য বিশাল ক্যাম্প বসাইছিলো। এয়ার ফোর্স আছে, ড্রাইভার থেকে আরম্ভ করে সব শ্রেনীর লোক তারা নেয়। সব তো মইরা যাইতেছে সিঙ্গাপুরে, জাপানে ক্ষতি হইতেছে। যুদ্ধ করার জন্য ব্রিটিশদের লোক দরকার। ব্রিটিশরা ভয় পাইতেছিলো যে জাপান ভারত আক্রমণ করবে। ভারতকে রক্ষা করতে হইবে। অথবা আর যেসব জায়গায় ব্রিটিশরা যুদ্ধ করতেছে—সব জায়গায়ই লোক দরকার ছিলো।

রাতে ওই আলাপ আলোচনা শুইনা আমি ঘুমাইয়া পড়লাম। উঠলাম ভোররাতে, ঘুম থেকে উইঠাই স্যানডেল পইড়া রওনা দিলাম–কোথায় বনানী, খুঁইজা বাইর করতে হবে। তো ওরা বইলা গেছিলো যে যাইতে কোন অসুবিধা নাই, এইখান থেকে ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনে গিয়া ট্রেনে উঠলে বনানী নিয়া নামাইয়া দেবে। বনানীতে এখন যে কামাল আতাতুর্ক রোড, তার মুখে, তার প্রায় উল্টাদিকেই বনানী রেল স্টেশন ছিলো, সেইটা এখনও আছে। তবে এখন আর ট্রেন দাঁড়ায় না।

সেই ভোররাতে হল থেকে বাইরাইয়া আমি ট্রেনে গিয়া উঠলাম, বনানীতে নামবো। ট্রেন দেখি একেবারে ভরা। ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট, ইউনিভার্সিটির বাইরের লোক–যারা যারা শুনছে, সবাই বনানী যাইতেছে। ট্রেনে ইসমাইল বইলা আমার বয়সি ১৬/১৭ বছরের এক ছেলের সাথে দেখা। আমি তো কথা বলুইনা লোক, আমি কথা বার্তা বলি, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর দেই। আমার সাইডে যে বইছে তারে আমি জিজ্ঞেস করলাম যে আপনে কেডা? সে উর্দুতে কইলো যে আমি বনানী যামু। উর্দুতে বলে যে 'বনানী যায়ে গা'। আমি বললাম যে, 'হাম ভী যায়ে গা'। কথা বলতে বলতে ইসমাইল আর আমি দুইজনে মিলে বন্ধু হয়ে গেলাম। নামার সময় বনানী গিয়ে দেখলাম হাজার খানেক লোক নামলো ট্রেন থেকে। তার মধ্যে আমরা হইলাম সবচেয়ে কম বয়সী। ট্রেন থেকে নাইমা কোনদিকে যাইতে হবে আমরা জানি না। আমরা লোকজনের পিছে পিছে যাইতে থাকলাম। লোকজন যেদিকে হাঁটা দেয়, সবাই কয়, আগের জন যেদিকে যাবে, আমিও সেই দিকে যাবো। কেউ চিনে না তো, সবাই একজনের পিছনে আর একজন চলছে। যাইতে যাইতে ছাপড়া টাইপের কয়েকটা লম্বা ঘর পাওয়া গেল। টিনের দোচালা, পাশেও টিনের বেড়া। চাইর পাশে জঙ্গল। সেইখানে থাইমা গেল সবাই। আমরাও থাইমা বইসা পড়লাম। তার পর বইসা চানাচুর আর চিনা বাদাম খাইতে থাকলাম। ওইখানে বেলা ১২টার দিকে আর্মির লোকরা আসে। ক্যাপ্টেন, কর্ণেল– এরা ফুল ড্রেসে। তাদের দল আছে আবার, আলাদা আলাদা—সেনা, বিমান বা নৌবাহিনী। প্লেনে কইরা আমরা একদিন ঢাকার উপর ঘুরছিলাম। আমি আর আমার বন্ধু ইসমাইল। এয়ার ফোর্সের প্লেনে ঘুরছি, ৫টাকা দিয়ে। ঘুরাইয়া আবার নামাইয়া দিলো। সাধারণ লোকদের যুদ্ধে আকৃষ্ট করার জন্য এইভাবে প্লেনে কইরা ঘুরাইতো। আমরা দুই দোস্ত–ও ঢাকাইয়া, নারিন্দা ওর বাড়ি, মেট্টিক পাশ আর আমি ক্লাস টেনে পড়ি, পরীক্ষা দেই নাই। বইসা বইসা আমরা ঠিক করলাম যে আমরা এয়ারফোর্সে যাবো। তখন ৩টার দিকে আমাদের কল পড়লো যে, 'এয়ার ফোর্স লাইন আপ'। মানে এয়ার ফোর্সে যারা যারা যাবে তারা আসো। তো আমরা দৌঁড়াইয়া যাইয়া সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। ইউনিফর্ম পরা লম্বা এক লোক ঘুইরা ঘুইরা সবাইরে দেখলো, তার সাথে আরো দুইজন লোক আইলো হাপ প্যান্ট পড়া, লেংটির মতো। পরে জানছি, লম্বা সাদা লোকটা আমেরিকান আর তার আন্ডারে ইন্ডিয়ান আছে দুই তিনজন। আমেরিকান লোকটা আমাদের কাছে আইসা বললো, 'কাম অন, কাম অন।' আমাদের নিয়া গেলো ঘরের মধ্যে, দোচালা লম্বা ঘর, তার মধ্যে অফিস। মানে আমরা প্রাথমিক সিলেকশনে পাশ করলাম, তখনও আসল সিলেকশন হয় নাই। আমরা টোটাল হইলাম ৩৬জন, সেই রিক্রুটমেন্টে প্রাথমিকভাবে চান্স পাইলাম।

আমরা ওইখানে বসে আছি। চানাচুর চীনা বাদাম–এগুলো খাইতেছি, দুপুরে আর কিছু খাই নাই। হঠাৎ দেখলাম খুব দৌঁড়াদৌঁড়ি। মনে হইল এখনি বোমা পড়বে, তা না হলে কর্নেল সাহেব আসবে। কর্নেল সাহেব হেডকোয়াটার থেকে এই অফিসে আসে এবং এইখানে যে কাজগুলি আছে, সেগুলি করে। এখন একটা কাজ হলো রিক্রুটমেন্ট করা তো রিক্রুটমেন্ট করবে। ৪টা থেকে ৫টা অথবা ৩টা থেকে ৪টা—এই রকম। দেখলাম আসলেই কর্নেল সাহেব আসলো। তারপর আসল ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য ডাক পড়লো। আমাকে ডাকছে আমাকে ৫/৬ জনের পরে। আমার বন্ধুর আমার আগে হইয়া গেছে। বন্ধু বললো, আমার না হইলে সে-ও যাবে না। তো আমি তো পইড়া রইছি। এক সময় আমাকে ডাকলো। ডাকছে পরে আমি বুক সোজা করে হেঁটে গেলাম। ঐ চালা ঘরের ভিতরেই রুম আছে। সেই রুমে যাইয়া দেখি ঐখানে টেবিলের উপর পা উঠাইয়া দিয়া এক লোক শোয়ার মতো কইরা চেয়ারে বইসা আছে। বুঝলাম, সেই লোক-ই হচ্ছে কর্নেল সাহেব। আর সব অস্থির, বাঙালি, মাদ্রাজি, আমেরিকান–এরা সবাই অস্থির ঐ কর্নেল সাহেবের হুকুম তামিল করার জন্য। কর্নেল সাহেব আমাকে ডাক দিলো আমার নাম ধইরা। তার হাতে লিস্ট, সেইখানে আমার নাম লেখা। প্রাথমিক সিলেকসনের পরে নাম লেইখা নিছিলো। ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেবে কর্নেল সাহেব।

আমি গিয়া কর্ণেল সাহেবের টেবিলের সামনে খাড়াইলাম। টেবিলের উপরে পাঁ নাচাইতেছিলো সে। ইচ্ছা হইছিল পাঁ-টার মধ্যে একটা চিমটি দিয়ে পাঁ-টা সরাইয়া ফালাই। হাটু পর্যন্ত বুট, তার উপরে পরনে খালি একটা লেংটির মতো প্যান্ট আর দুই তিনটা রিভলবার, আর একটা গেঞ্জি গায়ে দেওয়া। চিমটি আর দিলাম না, সে প্রশ্ন করা শুরু করলো। বাড়ী কোই, নাম কী, কেন আসছো, কি লেখা পড়া করছো–এইগুলা। আমাকে এইগুলো জিজ্ঞেস করছে আর আমি বলে দিছি সব ঠিক মতো। কর্ণেল সাহেব মনে হইলো খুশি হইছে। সব ইংরাজিতে জিগায়, আমিও ইংরাজিতে জবাব দিছি। লাস্ট প্রশ্ন করলো, 'হাউ ডিড ইউ গেট হিয়ার?' আমি এই ইংরাজি তো আগে শুনি নাই, আমি শুনেছি 'হাউ ডিড ইউ কাম হিয়ার?' আমি তো আর 'গেট হিয়ার' শুনি নাই। আমি উত্তর দিতে পারতেছি না। দুই-তিন বার জিগাইলো, আমি চুপ কইরা আছি। তখন কর্ণেল সাহেব গেছে খেইপা, যে ছেলেটা সব পারলো এইটা পারে না কেন! তো বার বার কয় 'হাউ ডিড ইউ গেট হিয়ার?' রাগে পাঁ নামাইয়া সোজা হইয়া বসলো সে। পাঁ নামাইয়া দিয়া আমার মুখে দিকে আগাইয়া হাত বেকা কইরা, ফ্লোরের দিকে দেখাইয়া কয় 'হাউ ডিড ইউ গেট হিয়ার?' তখন আমি বুঝছি—এটার বাংলা হইল, 'কেমনে আইলা?' তখন আমি বললাম 'বাই ট্রেন।' তারপর সে খুব খুশি এবং আমি সিলেক্ট হইলাম।

আমারে রুমের বাইরে পাঠাইয়া দিলো। আমি যাইয়া বন্ধুর পাশে বসলাম। পরে আমাদের সবাইকে, যারা যারা সিলেক্ট হইছে, তাদের বললো পরের দিন ১০টায় যাইতে। যাইতে কইলো এয়ারপোর্টে। আমার বন্ধুরেও একই কথা কইছে। এখন যেইটা পুরাতন এয়ারপোর্ট ওইটাই তখন একমাত্র এয়ারপোর্ট, তেজগাঁও-এ। এখনো দুইটা হ্যাঙ্গার আছে। একটা ভাইঙ্গা ফালাইছে। একটা গোল, আরেকটা দোচালা, অনেক বড়ো, টিনের, ভিতরে বিমান রাখে। ওইখানে যাইতে কইলো পরদিন দশটায়।

আমরা দুইজন তখন বনানী আইসা ট্রেনে কইরা নারিন্দা আইসা পড়লাম। আমার ওই বন্ধুর বাড়ি। আমার ভাইর কাছে আর যাই নাই। ওই বন্ধুর বাড়িতে থাকতাম, খাইতাম। ওর মা বাবা খুব ভালো মানুষ। ও আর আমি একসাথে আসা যাওয়া করতাম। ওরা খাঁটি ঢাকাইয়া।

……….
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মারক চট্টগ্রামের 'ওয়ার সিমেট্রি'
……….

পরের দিন ১০টায় আমরা একসাথে গেলাম। আমরা দুই বন্ধু একসাথে বাইর হইতাম। একসাথে নাস্তা খাইতাম দুই বন্ধু। জগন্নাথ কলেজের সামনে, বাহাদুর শাহ পার্কের ওইখানে গাড়ি আইসা দাঁড়াইয়া থাকতো। ট্রাক, মিলিটারি ট্রাক আছে, পিছে বেঞ্চ, বেঞ্চে হয়তো ১০জন, ১০জন—বিশজন বইলো আর বিশজন দাঁড়াইয়া আইলো। সেই ট্রাকটা সদরঘাট পর্যন্ত যাইতো আর আসতো। আমাদের নিয়া যাইতো এয়ারপোর্ট, আবার দিয়া যাইতো। পথে পথে তাদের লোকদের উঠাইতো, নামাইতো।

আমরা যাবার পরে আমাদের লাইনে খাড়া করাইলো। একটু লেকচার দিল ৫মিনিট এক টিচার, হাফ-প্যান্ট পরা। তার পর বললো এই যে একটা কইরা খাতা দিলাম, এর ভিতরে অনেকগুলি নাম আছে, এই নামগুলি তোমরা মুখস্থ করো। নামগুলি সব প্লেনের পার্টসের নাম। দিল, আমরা নিয়ে নিলাম। মুখস্থ করতে আরম্ভ করলাম। আমি শেষ পর্যন্ত ৭৭টা পার্টসের নাম মুখস্থ করছি। অনেকগুলা এখনো মনে আছে। আরো পার্টস আছে। সব নাম আমার মুখস্ত হওয়ার আগেই হঠাৎ সকাল বেলা একদিন, ১৯৪৫-এর আগস্টের ৭/৮ তারিখের দিকে একটা হৈ চৈ পইড়া গেছে আমাদের ঐ এলাকায়। আমরা চিন্তা করলাম, কি ব্যাপার! দেখি আমরা যুদ্ধে জিতছি, আমরা মহাযুদ্ধে জিতছি, জাপানিরা হারছে—এইটা প্রচার করা হইলো। আসলে তা না, ৮ই আগস্ট কয়েকটা পয়েন্টে সারেন্ডার করছিল জাপানিরা। তারপর আমাদের যে গুরু, শিক্ষক, সেই ভদ্রলোক রিয়েল লাইফেও তিনি শিক্ষক; রিয়েল লাইফে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে একটা স্কুলে সে শিক্ষক, পড়ায়। কিন্তু যুদ্ধের সময় সুস্থ্য-স্বাভাবিক সব যুবকের কম্পালসরি যুদ্ধে যাইতে হয়। আইন আছে। সেই জন্য টিচিং ছাইড়া এই ভদ্রলোক যুদ্ধক্ষেত্রে আসছে। আইসা সে হইছে সার্জেন্ট। সার্জেন্ট অ্যাপেল পি। নামটা এখনো মনে আছে। সার্জেন অ্যাপেল পি খুব ভালো ভালো লোক ছিলো, এইটা স্বীকার করতে হবে। তো অ্যাপেল পি আমাদের ডাক দিয়া বললো, 'যুদ্ধ শেষ।' জাপানিরা হারছে, আমাদের এখন এই অবস্থায় আর সোলজার দরকার নাই। সুতরাং তোমরা বাড়িতে চলে যাও। কালকে তোমরা আসবা। আইসা তোমাদের বেতন আর একটা সার্টিফিকেট নিয়া যাবা।

আমার যত দূর মনে পড়ে, আমার পাইছিলাম একশ কত টাকা যেন। আর্মিতে আমার চাকরি শেষ হইয়া গেলো। আগে আমাদের লিখিত দিতে হইছিলো যে, আমরা থাকবো, আমি চাকুরি করতে চাই।' প্রায় তিন মাস ছিলাম এয়ারফোর্সের চাকরিতে। প্রায় ৪মাস বাড়িতে যাই না, কেউ জানে না কোথায় আছি। এখন চাকরি শেষ হওয়ার পরে তো দেখি বিপদ—কই যাই? মাইরের ভয়ে আমি আর বাড়ি যাই নাই। আমি গেছি বোনের বাসায়, মুন্সীগঞ্জ। বেতনের টাকা দিয়ে বোনের জন্য কাপড়, ভাগিনা-ভাগনীর জন্য কাপড়—এইগুলো নিয়ে গেছি। বাড়িতে যাই কেমনে, তিন/চার মাস ধরে বাড়ির সাথে কোন যোগাযোগ নাই, তারা খুব খোঁজাখুঁজি করছে। যেই ভাইর কাছে এসে ফজলুল হক হলে এসে রইছি, যার বিছানায় ঘুমাইছি সেও জানে না। আমি তো হল থেকে বেরিয়ে রিক্রুটমেন্ট হওয়ার পরে ঐ বন্ধু সাথে তার বাড়িই চইলা গেছি। আমার বাড়ি যাইতে ভালো লাগতো না। সেবার আমার পড়ালেখায় এক বছর লস হইলো। সবকিছুর উপরে ছিলো ওড়ার বাসনা–সেইটাই হইলো।

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: ফয়েজ আহমদ
ইমেইল: artsbdnews24@gmail.com

ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts