প্রবাসীদের গল্প কেন সব ‘ঠকে’ যাওয়ার গল্প

প্রবাসীদের কথা শুনি আর ভাবি, আহা কত সহজ সরল একটা জীবন! কত সামান্যতেই না খুশি হওয়া যায়।

মো. ইয়াকুব আলীমো. ইয়াকুব আলীসিডনি থেকে
Published : 20 March 2024, 07:54 AM
Updated : 20 March 2024, 07:54 AM

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন এবং জাতিসংঘের অর্থায়নে এক সপ্তাহের একটা প্রশিক্ষণ শেষ করে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম। বিমানবন্দরের প্রক্রিয়া শেষ করে ব্যাগটা হাতে নিয়ে সরাসরি বাইরে চলে এলাম। আসার পথে অনেকেই অনেক ধরনের সেবা দিতে চাইলো, কিন্তু আমি সেদিকে কান দিলাম না। কারণ বিমানবন্দর নিয়ে প্রচলিত গল্পগুলো সবই ঠকে যাওয়ার গল্প।

আমার ইচ্ছা হেঁটে বিমানবন্দরের সামনে থেকে সরাসরি বাসে উঠে বাসায় ফেরা। বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একজন মধ্যবয়স্ক নারী আমার পিছু নিলেন। বারবার আমাকে উদ্দেশ করে বলে গেলেন, ‘বাপ আমাকে একটা রিংগিত দিয়ে যা।’ আমার হাবভাব দেখে তার হয়তোবা মনে হয়েছে, আমি মালয়েশিয়া থেকে ফিরলাম। আমি যতই বলি আমার কাছে রিংগিত নেই, তিনি মোটেও বিশ্বাস করেন না। আমি বাসে উঠে যাওয়ার আগ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। অবশেষে আমি বাসে উঠে পড়লে তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে আবার বিমানবন্দরের দিকে রওনা করলেন।

সিডনি থেকে ঢাকা আসা-যাওয়ার জন্য আমার প্রথম পছন্দ মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স, কারণ ওদের খাবার ও আতিথেয়তা। সিডনি থেকে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর তিন চার ঘণ্টার ট্রানজিট থাকে। সেই সময়টা আমি বিমানবন্দরের মধ্যেই ঘোরাঘুরি করি, ওয়াশরুমে গিয়ে পরিচ্ছন্ন হই। ওয়াশরুমে যারা কাজ করেন তাদের চেহারা পরিচিত হওয়ায় সাহস করে বাংলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি বাংলাদেশি?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘জি, আমার বাড়ি চাঁদপুর।’

তারপর তার সঙ্গে অনেক গল্প হলো। তাদের বেতন কেমন, সুবিধা কী কী এইসব নিয়ে। ইতোমধ্যে অনেক মানুষ ওয়াশরুমে আসছেন এবং বেরিয়ে যাচ্ছেন। একজন ভদ্রলোক এসে বুঝে উঠতে পারছিলেন না সিংকের কলটা কীভাবে কাজ করে। সেটা তিনি দেখিয়ে দিলেন। সেই ভদ্রলোক যাওয়ার সময় বখশিশ হিসেবে রিংগিতের একটা নোট তার পকেটে গুঁজে দিয়ে গেলেন।

করোনাভাইরাস প্রকোপ সবে কমে এসেছে। এমন সময় একবার দেশে যেতে হলো। সে এক বিশাল ঝক্কির ব্যাপার। কত রকমের টেস্ট আর তার কাগজ যে হাতের মধ্যে রাখতে হয়েছিল! আর কত রকমের যে ফরম পূরণ করতে হয়েছিল! মালয়েশিয়া বিমানবন্দরে কি একটা ফরম যেন দিল, সেখানে সবই ইংরেজিতে লেখা। আমি দ্রুত আমার ফরমটা পূরণ করে ফেললাম। তারপর একজন প্রবাসী আমাকে বললেন, ‘ভাই আমারটাও পূরণ করে দেন।’ আমি তারটা হাতে নিতেই আমার সামনে মানুষের একটা বিশাল লাইন হয়ে গেল। তারা সবাই মালয়েশিয়ায় কাজ করেন। এখন দেশে যাচ্ছেন। আমি বিমানে উঠার আগে দ্রুত যতজনেরটা পারি পূরণ করে দিলাম। তখন বাকিরা আফসোস করতে লাগলো। আমি বললাম, ‘আপনারা বিমানে আমার কাছে এসেও পূরণ করে নিতে পারেন।’ পরে বিমানে বসে সেই ফরম পূরণ করে দিলাম। ফরমটা পূরণ করে দেওয়ার পর তারা আমার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার যে হাসি দিচ্ছিলেন, সেটা ছিল অমূল্য। মনটা নিমেষেই ভালো হয়ে গেলো।  

একবার কোন এক সপ্তাহে ঝটিকা সফরে দেশে যেতে হলো। মালয়েশিয়া গিয়ে গেইটের সামনে বসে আছি। একে একে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে। তাদের প্রায় সবাই মালেশিয়ায় শ্রমিকের কাজ করেন। সবার পোশাক-আশাকই চটকদার। মাথায় বাহারি চুলের কাট। চোখে রোদচশমা। কানে কর্ডলেস হেডফোন। হাতে ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল। সারাক্ষণই তারা দেশের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছেন। প্রত্যেকের মুখই দেশে স্বজনের কাছে ফেরার খুশিতে উদ্ভাসিত। কতবার করে যে বলছেন, ‘সব কাজ শেষ করে বসে আছি, একটু পর বিমানে উঠবো।’ হয়তোবা তখন দেশ থেকে তার বাবা, মা, নতুন স্ত্রী কিংবা ছোট্ট সন্তান বিমান দেখতে চাইছে। তিনি তখন মোবাইলের ক্যামেরা ঘুরিয়ে বিমান দেখাচ্ছেন। আমরা নিজে শত কষ্টে থাকলেও প্রিয়জনকে সবসময়ই হাসিমুখ, সুখি চেহারা দেখাতে চাই, যেন তারা কষ্ট না পায়।

বিদেশ থেকে কার জন্য কী নিয়ে যাচ্ছেন তার তালিকা বলছেন প্রবাসীরা। সেটা নিয়ে আসতে গিয়ে বিমানের লোকদের সঙ্গে কত বাকবিতণ্ডা হয়েছে তার বর্ণনা দিচ্ছেন। প্রবাসীদের কথা শুনি আর ভাবি, আহা কত সহজ সরল একটা জীবন! কত সামান্যতেই না খুশি হওয়া যায়। ঢাকা বিমানবন্দরে চেক-ইনের জন্য একটু আগেভাগেই আসতে হয়। ভেতরে ঢুকে দেখি অনেক মানুষ একই ধরনের টিশার্ট ও ক্যাপ পরে দলবেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে একদল পিঁপড়া জটলা পাকাচ্ছে। পাশে থেকে কে একজন বললেন, এরা সবাই মালয়েশিয়া যাচ্ছে।

তারা চেক-ইন কাউন্টারের সামনে পিঁপড়ার সারির মতো দাঁড়ালেন। এই কাউন্টারের কাজ শেষ করে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পার হয়ে বিমানে উঠতে হয়। সেখানে গায়ের বাড়তি কাপড়, বেল্ট, জুতো, মানিব্যাগ, মোবাইল, ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি সব বের করে ট্রেতে রেখে গেইট পার হতে হয়। আমরা যখন গেইটের কাছে গেলাম, তীব্র একটা দুর্গন্ধ এসে নাকে লাগলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে ধরতে পারলাম, এটা ঘামে ভেজা মোজার গন্ধ। মোজার দুর্গন্ধে গেইটের বিমানের স্টাফদের সবারই নাক কুঁচকানো। তারা হদিস করতে পারছেন না গন্ধটা কোথা থেকে আসছে। আমি জানালাম, এটা মোজার গন্ধ। যেহেতু গেইটে জুতো খুলে আলাদা রাখতে হচ্ছে সেহেতু মোজার গন্ধটা ছড়ানোর সুযোগ পেয়েছে।    

একবার বিমানে আমার সিট পড়েছিল টয়লেটের কাছাকাছি। বিমান ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মোটামুটি তাই আমার সামনে লাইন লেগে গেল। একে একে সবাই টয়লেটে যাচ্ছেন। হঠাৎ দেখি এক ভদ্রলোক টয়লেটের দরজা খুলে নাক মুখ সিঁটকে ফেললেন। তার আগেই একজন টয়লেট থেকে বের হয়েছেন। কিন্তু টয়লেট করে হয়তোবা ফ্ল্যাশ করেননি। তাই অপরিষ্কার টয়লেট দেখে তার মুখের এই অভিব্যক্তি। একটু পর বিমানবালা এসে টয়লেটের ভেতরে ঢুকে পরিষ্কার করলেন, তারপর তিনি ঢুকলেন। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে একজন করে টয়লেট থেকে বের হওয়ার পর বিমানবালা টয়লেটে ঢুকে পরিষ্কার করেন, তারপর পরেরজন ঢুকেন। এতে বেশ বড় জটলা তৈরি হয়ে গেল। তখন আসল ঘটনা বুঝলাম। আমাদের শ্রমিক ভাইয়েরা টয়লেটে গিয়ে ছোট হোক বড় হোক টয়লেট সেরেছেন, কিন্তু ফ্ল্যাশ করেননি। কারণ তারা জানেন না, কোন বোতামে চাপ দিয়ে ফ্ল্যাশ করতে হয়।

এমনিতেই বিমানের টয়লেটগুলো খুবই ছোট আকৃতির। আর তার মধ্যে এতো রকমের বোতাম যে তারা ভয়ে কোনো বোতাম না চেপে বের হয়ে আসাটাকেই নিরাপদ মনে করেছেন। আমার শুধু অবাক লাগে, তাদেরকে যেসব এজেন্সি বিদেশে নিয়ে এসেছে তারা সামান্য একটা টয়লেট ট্রেনিং তো দিতেই পারতো। কারিগরি প্রশিক্ষণ বা ভাষার প্রশিক্ষণের কথা না হয় বাদই দিলাম। গ্রামের এইসব গরীব মানুষদের কাছ থেকে দরকারের তুলনায় তিনগুণ চারগুণ অর্থ নিয়ে তাদের বিদেশে পাঠিয়েছেন। এইটুকু উপকার করতে তো বেশি কিছু লাগার কথা নয়। বিমানের টয়লেটের কয়েকটা ছবি তুলে, কোন বোতামটা কোথায় থাকে, সেটা দেখিয়ে কোনটাতে চাপ দিতে হবে বলে দিলেই উনারা পারতেন। কারণ আমাদের শিখতে সময় লাগে না।   

বাংলাদেশে বছরখানেক সাভার উপজেলার সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছিলাম। তখনকার একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেলো। একদিন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক এসে আমাদের অফিসের দরজায় জুতো খুলছেন দেখে বললাম, ‘জুতো খুলতে হবে না, ভেতরে আসুন।’ ভেতরে আসার পর জিজ্ঞেস করলাম, ‘বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি?’ তিনি বললেন, ‘স্যার, আমি মিডলইস্টে কাজ করি। আমার হাতে লেখা পাসপোর্ট। এখন ওরা মেশিন-রিডেবল পাসপোর্ট বানাতে বলেছে। তার আবেদনপত্র জমা দিতে হবে। তাই কিছু কাগজপত্র সত্যায়িত করা দরকার।’

আমি তাকে বসতে বলে কাগজগুলো বের করতে বললাম আর জিজ্ঞেস করলাম, মূল কপিগুলো এনেছেন কিনা? আমি সাধারণত মূল কপি একঝলক দেখেই সত্যায়িত করে দিই। স্বাক্ষর করতে করতে বললাম, ‘দেশের অর্থনীতি তো টিকিয়েই রেখেছেন আপনারা। আপনাদের রক্ত পানি করা পয়সাতেই আমাদের বেতন হয়।’

এটা শুনে তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। আমি একটু বিড়ম্বনায় পড়ে গেলাম। তিনি বেশকিছুটা সময় নিলেন ধাতস্থ হতে। স্থির হয়ে যেটা বললেন তার সারমর্ম এমন- উনি খুব সকালে সাভারের একটা ইউনিয়ন থেকে উপজেলায় এসেছেন, এই আশায় যে সেখানে তো অনেক প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা আছেন, তাদের কাউকে না কাউকে দিয়ে সত্যায়িত করিয়ে নেবেন। একটা উপজেলাতে অনেকগুলো প্রথম শ্রেণির পোস্ট থাকে। তাদের যে কেউই সত্যায়িত করে দিতে পারেন। তিনি সকাল থেকে প্রায় প্রতিটা অফিসেই গেছেন। কেউ গল্প করছেন, বলেছেন অন্য জায়গায় যেতে। কেউ চা খাচ্ছেন, বলেছেন পরে আসতে। অবশেষে তিনি আমার কাছে এসেছেন। আমি সত্যায়িত করে দিয়ে বললাম, হিসাবরক্ষকের কাছ থেকে সিল দিয়ে নিতে। একটু পর তিনি আবার আমার কক্ষে ফিরে এলেন। হাতের একটা কাগজে তার বাড়ির ঠিকানা লেখা। তারপর বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে যেতে হবে। অবশ্য আমি শেষ পর্যন্ত তার বাসায় যেতে পারিনি।  

আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখন দেশের একটা মোবাইল কোম্পানিতে কাজ করি। আমাদের অন্যতম সাবকন্ট্রাক্টর চীনা কোম্পানি ‘হুয়াইয়ে’, তাদের সঙ্গে কাজ করতে সাইটে গিয়ে একদিন ইংরেজিতে নির্দেশনা দিচ্ছিলাম। কিন্তু ওদের মুখের ভাব দেখে বুঝলাম, ওরা আমার কথা বুঝতে পারছে না। একটু পর তারা ম্যানেজারকে ডেকে নিয়ে আসলো। তিনি এসে আমাকে বললেন, ‘আপনার যা দরকার আমাকে বলেন। আমি ওদের বুঝিয়ে দিচ্ছি। ওরা শুধু ওদের কাজটাই জানে, ভাষাটা জানে না।’

শুনে আমি খুবই অবাক হলাম। পাশে রাখা ল্যাপটপের স্ক্রিনে উঁকি দিয়ে দেখি, সেখানে মাই কম্পিউটার, রিসাইকেল বিন এই কথাগুলো চীনা ভাষায় লেখা। তখন আমি হাতেকলমে দক্ষ জনশক্তির সঙ্গে পরিচিত হলাম। ভারত ও চীন তাদের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করেছে। দেশের পাসপোর্ট করাসহ সরকারি কাজগুলো সহজ করে দিয়েছে। আর বিদেশে পাঠানোর আগে সেই কাজের উপর একটা ছোট প্রশিক্ষণ দিয়ে দিচ্ছে, যাতে করে কাজটা ঠিকঠাক করতে পারে। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের চাহিদা বিশ্বজুড়ে। তারা যেন না ঠকে, কর্মের সঠিক বিনিময় পায়, প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত না হয়- এইটুকুই প্রত্যাশা আমাদের।