খণ্ডিত জীবন (কিস্তি ৩)

ফয়েজ আহমেদ
Published : 22 August 2011, 06:48 AM
Updated : 22 August 2011, 06:48 AM

(কিস্তি ২ এর পরে)

ঘোড়ার ব্যবহার ছিলো স্থানীয়। আর সারাদেশের সাথে, এক এলাকা থেকে আরেকটা এলাকায় মালপত্র আনা-নেওয়ার জন্য নৌকা ছাড়া উপায় ছিলো না। আমাদের বিক্রমপুরে সারা বছরে যত ধান লাগে তার পুরাটা বিক্রমপুরে জন্মায় না। ধান আসতো বরিশাল থেকে। ব্যবসায়ীরা ছিলো। তাদের বড় বড় পালতোলা, দাঁড়টানা নৌকা ছিলো। সেই নৌকায় তারা ধান নিয়া আসতো।


বাংলার দুর্ভিক্ষ ১৯৪৩

তখন জাহাজ-স্টিমারও চলতো; কিন্তু তাতে ছিলো মানুষের চলাচল। মালপত্র আনা-নেওয়া হতো কম।

আমার চৌদ্দ-পনের বছর বয়সের সময়, ১৯৪২-৪৩ সালে আমাদের দেশে একটা দুর্ভিক্ষ হয়ে গেলো। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জাপানের বিরুদ্ধে যখন ব্রিটিশরা যুদ্ধ করে, সিঙ্গাপুর-হংকং—এই অঞ্চলে, তখন এই দুর্ভিক্ষ ঢাকায় বা বাংলাদেশে হয়। দুর্ভিক্ষের কারণ হলো—এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ধান-চাল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া। বিক্রমপুর খাদ্যে দুর্বল। বলা হয়, বিক্রমপুরে তখন নয়মাস-ই অন্য জায়গা থেকে ধান-চাল আইনা খাইতো। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিলো, কিন্তু উৎপাদনে পিছাইয়া ছিলো।

সোহরাওয়ার্দী তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। চাউল বেইচা বাংলাদেশে তখন অনেকে কোটিপতি হয়। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভুল ছিলো। বলা হয়, মহাযুদ্ধের সময় লোকজনের অ্যাট্রাকসন অন্য দিকে যাতে না যায় সেইজন্য ব্রিটিশরা দুর্ভিক্ষ কইরা দিলো। ব্রিটিশরা তো আর মারা যায় নাই! দুর্ভিক্ষে ঢাকা জেলা আক্রান্ত হলো বেশি, ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হলো বিক্রমপুর সাব-ডিভিসন।

বিক্রমপুরের নয় মাসের ধান আনতাম বরিশাল থেকে। কিনতে হইতো, কিন্তু ধানটা পাওয়া যেতো তো! দুর্ভিক্ষের একটা বড়ো কারণ মহাযুদ্ধ। শ্রীনগর একটা মেইন জায়গা। সপ্তায় দুইদিন হাট বসতো—রবিবার, বুধবার। আর সপ্তাহে প্রতিদিন বাজার বসতো। বিরাট খালের পাড়ে বিক্রমপুরের হাট–শ্রীনগর। তো সেইখানে বড় বড় চালের নৌকা, ধানের নৌকা আসতো। পরে ছোট নৌকায় কইরা বিভিন্ন জায়গায় যাইতো, সেগুলি আমরা কিনে খেতাম। যুদ্ধের সময় সরকারের একটা অর্ডার হইলো—যত নৌকা আছে বাংলাদেশে—সব চলাচল বন্ধ কইরা দাও। এবং পরে বলা হইলো, মাঝিরা কথা শোনে না সবাই সবসময়, সুতরাং সব ডুবাইয়া দাও। তখন থানার সেকেন্ড অফিসার এসে, দারোগা এসে বড়ো বড়ো নৌকা—তিনশ মণি, পাঁচশ মণি, হাজার মণি—বিরাট বিরাট নৌকা, ধান-চাউল ক্যারি করে, সব ছিদ্র কইরা দিলো। জাপানিরা আসতেছে। ব্রিটাশদের কাছে নাকি খবর আসছিলো, জাপানিরা আইসাই লোকাল যানবাহন ব্যবহার করে। আমাদের দেশের লোকাল যানবাহন নৌকা। জাপানিরা প্লেনে কইরা ঢাকায় আইসা এই নৌকায় কইরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবে। এই কারণে সব নৌকা ছিদ্র কইরা ডুবাইয়া দেওয়া হইলো। ব্রিটিশরা দেশের মানুষের কথা ভাবলো না।

যার যার বাড়ির সামনে সব নৌকা ডুবাইয়া দিলো। ছিদ্র করতে না দিলে জেলে নিয়া যায়। আমার একটা নৌকা আছে, তার দুইটা নৌকা আছে—এইগুলায় ধান-চাউল আনা হয় পিরোজপুর থেকে, বরিশাল থেকে, নানান জায়গা থেকে—দিলো ডুবাইয়া! আর ধান-চাল আমদানি হলো না। ওইটা দুর্ভিক্ষের প্রধান একটা কারণ হইয়া দাঁড়াইলো। টাকা আছে, ধান-চাউল নাই।

যারা মাথায় কইরা এদিক-ওদিক থেকে আনে তারা দশগুণ দাম হাঁকে। কিনতে পারে না। বাড়িঘর, জমি-জমা বিক্রি কইরা হয়তো কিছু কিনতে পারে বা পায় না। তখন কিছু লাশ দেখেছিলাম আমি। আমার মনে আছে, স্কুলে পড়ি, ধুতি, হাফ-প্যান্ট পরতাম। বর্ষাকাল। স্কুল বন্ধ হইয়া গেছে। বাড়িতেই লেখাপড়া। দুর্ভিক্ষের সময় খাল দিয়া লাশ ভাইসা যাইতে দেখেছিলাম।

আমরা উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবার। আমাদের বাড়িতে অনেকগুলি ব্যাপার ছিলো। যেমন চুল-দাড়ি কাটার জন্য নাপিত ছিলো। কাপড় ধোবার জন্য ধোপা ছিলো। এরা আসতো নিয়মিত। নাপিত সপ্তাহে একবার আসতো। ছেলেমেয়েদের চুল কাটতো, বড়োদের দাড়ি কাটতো, চইলা যাইতো। সবাই হিন্দু।

আমাদের বাড়ি থেকে ওদের ধান-চালের জন্য ক্ষেত দেওয়া ছিলো। পারিবারিকভাবে। লিখিত। ওই ক্ষেতে যে ফসল হইতো ওইটা তাদের। এইটাই ছিলো তাদের মজুরি। ওইখানে যে ফসল হয় তা দুর্ভিক্ষের আগেই শেষ হইয়া গেছে। ফলে দুর্ভিক্ষের সময় তাদের আর খাদ্য নাই। দুর্ভিক্ষের সময় এমন একটা দুরবস্থার মধ্যে তারা পড়লো যে আমাদের বাড়িতেও তারা আর আসতে পারে নাই শারীরিক কারণে। কিছুদিন পর্যন্ত ওরা আমাদের বাড়িতে এসে এসে চিড়া-মুড়ি-গুড়-কাঁচামরিচ খাইতো বা পোলা-মাইয়ার জন্য নিয়া যাইতো। ওরা হিন্দু বলে ভাত খাইতো না আমাদের বাড়িতে। তারপরে আর আসতে পারতো না তাদের গ্রাম থেকে। এরা সবাই না খাইয়া মারা গেলো। লোকজন আসলে আমরা কিছু সাহায্য করতাম, না আসলে দিতে পারতাম না।


…………
বিডিনিউজ২৪.কম অফিসে ফয়েজ আহ্‌মদ
…………

আমাদের প্রয়োজনীয় চাল আমাদের জমিতে হইতো। আমরা জমি বর্গা দিতাম। কর্ষা বর্গা বলা হইতো। কর্ষা বর্গায় মালিক চাইলেই অন্য কৃষককে ক্ষেত দিতে পারবে না। ওই কৃষককেই দিতে হবে। পঞ্চাশ বছর যাবত যে কৃষক চাষ করে তার ছেলে মেয়েরাই ওইটা চাষ করবে এখন। তেভাগা আন্দোলনের সময় বর্গা চাষীদের দাবী ছিলো—ধানের তিন ভাগের দুইভাগ তাদের। হাল-চাষ করা, নিড়ানি দেওয়া, কচুরিপানা থেকে ক্ষেতকে রক্ষা করা, পানি আটকে ক্ষেতকে রক্ষা করা, ধান কাটা, বাড়িতে আনা—সমস্ত কাজটা কৃষক করতো। আমরা শুধু জমির মালিক। এইজন্য কৃষক দাবী করেছিলো দুইভাগের। পরে অর্ধেকের। কিন্তু সেই দাবীও পূরণ হয় নাই। আমরা দুই ভাগের একভাগ দিতাম। তেভাগা আন্দোলনের ব্যর্থতাও দুর্ভিক্ষের একটা কারণ।

তখন বিক্রমপুরের এসডিও অশোক মিত্র। বিক্রমপুরের তখনকার বিখ্যাত ব্যক্তি ডাক্তার নন্দী। বাবুদের একটা হাসপাতাল ছিলো, ডাক্তার নন্দী সেই হাসপাতালের চার্জে ছিলো। দুর্ভিক্ষ যখন আরম্ভ হলো তখন ডাক্তার নন্দী এবং এসডিও অশোক মিত্র—দুজনে একটা কমিটি করে শ্রীনগরে একটা লঙ্গরখানা তৈরি করলো। সেই লঙ্গরখানায় গড়পরতা একটা হালকা খিচুরির মতো তৈরি করা হয়, দিনে একবার বা দুইবার সাধারণ গরিবদের খাওয়ানো হয়। কেবল বাঁচাইয়া রাখার জন্য। দুইশ-পাচশো লোক আসলো, পাতলা খিচুরির মতো তৈরি করা হলো, দুই চামচ দিলো, সেইটা খাইয়া জীবনটা রক্ষা করলো। এই ভাবে অনেক লোক বেঁচে গেছে। এই বাঁচা বা মৃত্যু সরকার ছাড়া আর কেউ দেইখা রাখতে পারে না, সরকার তা দেখলো না। প্রাইভেটলি আয়োজন করা হইলো এইটা। ওই এসডিও টাকা দিতো কিছু, ডাক্তার নন্দী দুই-পাঁচ টাকা উঠাইতো, সেইটা দিয়া লঙ্গরখানা চালাইতো।

কিন্তু এই রকম একটা দুইটা লঙ্গরখানা মানুষকে বাঁচাইতে পারে নাই। দুর্ভিক্ষের নিয়ম হচ্ছে—সমাজের তলার যে সমস্ত লোক, সাধারণ লোক—এই দর্জি, নৌকা বায়, ধান কাটে, জায়গা-জমি নাই, পরের বাড়িতে খাইটা খায়, পরের জমিতে খাটে—এই সমস্ত লোকের উপর দুর্ভিক্ষ প্রথম ছোবল দেয়। তারা রোজ আনে রোজ খায়। সেটা বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ভিক্ষ হচ্ছে ভিক্ষার অভাব। ভিক্ষাও দেয় না কেউ। তারাই আগে মারা যায়। বিক্রমপুরের এই সমস্ত লোক মইরা গেলো।


কলকাতায় দাঙ্গা

বর্ষার পরে আমি আবার স্কুলে গেলাম। যাইয়া দেখি অনেক গরিবের ছেলে আর স্কুলে আসে না। মরে গেছে। আমাদের বাড়ির নাপিত আর আসে না, ধোপা আর আসে না। মরে গেছে। আর আসে না। বর্ষাকালে লাশ ভাইসা যাইতো। খুব করুণ দৃশ্য। মাটি দিতে টাকা লাগে, পোড়াইতে টাকা লাগে। টাকাও নাই, মানুষও নাই। মাটি দেওয়া বা পোড়ানোর ক্ষমতা নাই। স্বামী মরলো, স্ত্রী মরলো তারে কলাগাছের উপরে ভাসাইয়া দিলো খালে। বাচ্চাগুলি আগে মারা গেছে। বাপ-মা তারপরে মারা গেছে। ছেলেমেয়েদের খাবার দিতে পারে নাই, নিজেরাও খাইতে পায় নাই। সবাই মইরা গেছে। অভাবের সময় ডাকাতি হয়। কিন্তু ডাকাতেরাও দুর্বল হইয়া গেছে, ডাকাতি করারও বল নাই।

দুর্ভিক্ষের পরে আবার রায়ট হইলো। তখন বড়ো একটা সামাজিক সমস্যা তৈরি হইলো। দুর্ভিক্ষের পরে আমি একদিন শ্রীনগর বাজারে গেছি। স্কুলে পড়ি, মাঝে মাঝে ঘুরতে যাইতাম বাজারে। শ্রীনগর বাজার মান্নান ভূঁইয়া বলে একজনের জুতার দোকান ছিলো। আমি যাইয়া দেখি মিটিং হইতেছে। বিষয় নাপিত। দুর্ভিক্ষে সব মইরা গেছে। একটাও সেলুন নাই। শত শত লোকের চুল-দাড়ি বড়ো হইয়া গেছে। কয়েক মাস যাবত তারা চুল-দাড়ি কাটতে পারে না। আবার ধোপাও নাই। এরা ছিলো হিন্দু সবাই। বেশির ভাগ দুর্ভিক্ষে অথবা রায়টে মইরা গেছে। বিক্রমপুরে রায়ট প্রবল ছিলো না। মূল রায়ট হইছে কোলকাতায়। এর পরেই দেশ বিভাগ হইয়া গেল ১৯৪৭ সালে। দুর্ভিক্ষে অথবা রায়টে বাইচা যাওয়া হিন্দুরা কলকাতার দিকে চলল। নাপিত, ধোপা আর দোকানদারের নিম্নশ্রেণীর কাজ আর করার কেউ নাই। বাজারে হাহাকার। প্রধানতঃ দুর্ভিক্ষই এই লোকাভাবের কারণ।

এই নিয়া মিটিং। নাপিত ধোপা বানাইতে হবে। হিন্দু নাই। ফলে মোসলমানদের বানাইতে হবে। কিন্তু মোসলমানেরা হইতে রাজি না। কারণ এইগুলা হিন্দুদের কাজ। নিম্নস্তরের কাজ মনে করা হইতো। তখন কয়েকজন গরিব মোসলমানকে টাকা দিয়া, বাজার থেকে টাকা তুইলা, কেচি-কুচি কিইনা, একটা সেলুনে জায়গা দিয়া তাদের নাপিত বানানো হইলো। টাকা দিয়া চুল-দাড়ি কাটতে বলা হইলো। কাটতে পারে না, তাতে কি। যাই হয়, চুল-দাড়ির জঙ্গল হইয়া গেছে, কাটতে তো হবে।

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: ফয়েজ আহমদ
ইমেইল: artsbdnews24@gmail.com

ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts