Published : 24 Jul 2011, 07:08 PM
আমাদের বাড়িতে পড়াশুনার একটা মিনিমাম পরিবেশ ছিলো। বাবায় লেখাপড়া জানতো বইলা গ্রামে একমাত্র আমাদের বাড়ি যেইখানে লেখাপড়ার একটা পরিবেশ ছিল। অনেক সময় মাস্টার রাখা হইত বাড়িতে। আমরা—চাচাতো ভাই, আমার ভাই একসাথে পড়তাম। গ্রামে ধর্মশিক্ষার ব্যাপার ছিলো। গ্রামের লোকজন নানারকম কথাবার্তা বলতো। সেইজন্য আমাদের বাড়ি ধর্মীয় ব্যাপারে সজাগ ছিলো। বাবা আমাদের ছেপাড়া পড়ার জন্য হুজুর ঠিক কইরা দিয়েছিলেন। আমাদের গ্রামের শব্দ হচ্ছে ছেপাড়া। ছেপাড়া মানে অধ্যায়। ত্রিশটা টুকরা, যেমন ত্রিশ ছেপাড়ায় কোরান শরীফ হয়।
প্রাইমারি স্কুল ছিলো না আমাদের গ্রামে। মাদ্রাসা দিয়াই পড়ালেখা শুরু হইতো। স্কুলে যাওয়ার জন্য মাদ্রাসা একটা ধাপ। আমাদের গ্রামে যে মাদ্রাসা, ছোট মাদ্রাসা, সেই মাদ্রাসায় যিনি প্রধান ছিলেন—তাঁর নাম গণি মাওলানা। গণি মাওলানা সাহেবের অসাধারণ কণ্ঠস্বর ছিলো। এবং অবিশ্বাস্য সুন্দর আজান দিতে পারতেন তিনি।
একদিন বাবার সাথে গণি মাওলানার কথাবার্তা ঠিক হইলো যে আমি পরদিন থেকে মাদ্রাসায় যাবো। বাংলা, ইংরেজি, অংকে হাতেখড়ির আগে মাদ্রাসা দিয়া আমার পড়া শুরু হইলো। আমাদের বাড়ির নিয়ম এইটা। প্রধান নিয়ম হচ্ছে—আমরা কোরান শরীফ শেষ করবো। তারপর জেনারেল স্কুলের জন্য পাঠ্যপুস্তকে চইলা যাবো।
ভোর সাতটায় মাওলানা সাহেব আসতেন মাদ্রাসায়, পড়াইতে। আমরা ভাইবোনরা মাদ্রাসায় যাইতাম সকালে। মেয়েরা আসতো মাথায় ঘোমটা-টোমটা দিয়া। আমরা এক ঘণ্টা পড়তাম আমাদের বাংলায়–বাংলা হইলো বৈঠকখানা। এই বৈঠকখানায়ই ছিলো মাদ্রাসা। ভাই বোন মিইলা পড়তাম। চাচাতো ভাই, খালাতো ভাই—যারা যারা গ্রামে ছিলো।
আমি কোরান শরীফ ত্রিশ ছেপাড়া শেষ করছি। একবার রিডিং দেওয়া। অর্থ বুঝতাম না কোনো। একটা অক্ষরও হয়তো আমরা অর্থ বুঝলাম না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইম্পর্ট্যান্ট দুই-একটা জায়গায় হয়তো তাঁরা ব্যাখ্যা দিতেন—এই জায়গাটায় এই আছে। মওলানা আমাদের নামাজও শিখাইছেন। বাড়িতে মাওলানাই নামাজ-টামাজ পড়াইতেন। কিন্তু বাবা আমাদের নামাজে নিয়ে যেতেন না।
কোরান শরীফ সাধারণত তিন মাসে পড়া শেষ হয়। আমার কতদিন লাগছিলো এতদিনে আর মনে নাই। কোরান শরীফ পুরাটা পড়া শেষ হবার পরে আমার হাতেখড়ি হইলো। তখন আমার প্রাইমারি স্কুলে যাবার পালা। কিন্তু আমাদের গ্রামে তো প্রাইমারি স্কুল নাই। এই কারণে গণি মাওলানা সাহেবই সকাল ১০টা থেকে ঐ মাদ্রাসায়ই প্রাইমারি স্কুলের পড়া পড়াইতেন। কোরান শরীফ শেষ করার পরে একদিন সকালে আমাকে বলা হইলো স্কুলে যাইতে। আমি খেয়ে টেয়ে আসলাম, সকালবেলা যাবো দশটায়। আমি তাড়াতাড়ি করে হাফ-প্যান্ট গেঞ্জি পরা অবস্থায়, চুল-টুল না আঁচড়াইয়া কয়েকটা বাংলা বই-টই নিয়া মাদ্রাসায় গেলাম–যে মাদ্রাসা সকাল দশটায় স্কুল হইয়া যায়।
আমারে দেইখা, যেই মাওলানা আমারে এতো চেনেন, সেই মাওলানাই ক্ষেইপা গেলেন আমার উপরে। বললেন, তুমি আইছো, আজকে তোমার আসার কথা, তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, কিন্তু এইভাবে কেন?
আমি বললাম, কীভাবে?
উনি বললেন, 'মাদ্রাসায় কেউ হাফ-প্যান্ট পইরা আসে না। লুঙ্গি অথবা পায়জামা পরে। গেঞ্জি গায়ে দেওয়া, চুল উস্কখুষ্ক, এইভাবে তুমি মাদ্রাসায় এসছো!'
আমি বললাম, 'ঠিকই তো আছে। আমি তো হাফ-প্যান্ট গেঞ্জি পরেই তো ছিলাম এতক্ষণ। আসার সময় স্যান্ডেল পাই নাই। আমি সেইভাবে চলে আসছি!'
আমি তক্ক করাতে উনি ক্ষেইপা গেলেন। মাওলানার সাথে তক্ক-টক্ক করা যাবে না। সকালে মাদ্রাসায় আরবি পড়তে যাবার সময় লুঙ্গি পইরা যাইতাম আমরা। কিন্তু এখন তো আমি স্কুলে আসছি, এই কারণে হাফ-প্যান্ট। তো আমি তক্ক করায় মাওলানা সাহেব ক্ষেইপা গিয়া আমারে বেত দিয়া বাড়ি দিছেন। আমি হঠাৎ কইরা তাঁর বেত ধইরা ফালাইছি, আমার গায়ে লাগে নাই! তিনি আমার কাছ থেকে বেতটা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলেন। আমি আর বেত ছাড়ি না। আমি বললাম, 'আমাকে মারেন কেন? হাফ-প্যান্ট পইরা আসছি, কালকে আমি লুঙ্গি পইরা আসবো!' তখন আমি ঐ বেতটা তাঁর কাছ থেকে টান দিয়া নিয়া গেলাম। নিয়া আমি বাড়িতে চলে আসলাম। ঐ একদিনই। আমি আর ঐ মাদ্রাসায় স্কুল করি নাই।
……….
ফয়েজ আহমদের বাবা গোলাম মোস্তফা চৌধুরী
……….
বাবার কাছে তিনি এই কথাগুলি সব রিপোর্ট করছিলেন। নালিশ করছিলেন যে, 'এই ছেলে বেআদব।' বাবা আমারে বললেন, তুমি বেত নিয়া আইসা ভালো কাজ করো নাই। আমি পরে শুনছি যে আমার বাবা মাওলানা সাহেবকে বলছেন, 'ও তো বাচ্চা মানুষ, একদিন না হয় ভুল কইরা গেছে, হাফপ্যান্ট বাদ দিয়া কালকে লুঙ্গি পইরা যাইতো, আপনে তারে শাসন কইরা বলতে পারতেন—কালকে থেকে যেন লুঙ্গি পইরা আসে। কিন্তু আপনে তারে মারবেন কেন?'
পরে আমি আর আমাদের গ্রামের মাদ্রাসায় না গিয়া 'ষোলঘর' একেএসকে হাই স্কুলে ভর্তি হবার প্রিপারেশন নিলাম। একে মানে অক্ষয়কুমার, এসকে হইলো শশীকুমার—দুই বন্ধু। এই স্কুলে ক্লাস সিক্স থেইকা শুরু। আমি তখন বাড়িতেই পড়তাম, মাস্টার রাইখা পড়তাম। বাবাই পড়াইতেন মেইনলি। ষোলঘর স্কুল দেড় মাইল দূরে। বর্ষাকালে নৌকায় যাইতাম। পরে আমার পড়ালেখা এই স্কুলেই হয়।
মাওলানা সাহেবের সাথে পরে আমার খুব ভালো সম্পর্ক হয়। তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। মিলাদ শরীফ পড়াইতেন। মাসে কয়েকটা টাকা পাইতেন আমাদের বাড়ি থেকে।
মাওলানা আর মাদ্রাসার কথায় আমার এক ভাইয়ের কথা মনে পইড়া গেলো। আমার এক চাচতো ভাই, বয়স আমার থেকে বেশি–বহুদিন পরে, তাকে আমরা জীবনে প্রথম দেখলাম। আমরা জানতাম না যে এই রকম একজন চাচতো ভাই আছে। সে থাকতো নোয়াখালি। আমার চাচায় তাঁর বড় ছেলেকে—আগে প্রতিজ্ঞা করছিলো যে–আমার বড় ছেলেকে ধর্মের নামে উৎসর্গ করলাম। অ্যাকচুয়াল ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়া সে আসবে, সে আলীয়া মাদ্রাসায় পড়বে, ধর্মের লেখাপড়া করবে। এই ছিলো ব্যাপারটা। সে নোয়াখালিতে একটা বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার জন্য মাসে ৫/৬ টাকা দিয়া থাকতো। ঐ জায়গার মাওলানা তাকে পড়াইতো। এইরকম অনেক বাড়ির লোক নোয়াখালী যাইয়া পড়তো সেই আমলে। নোয়াখালীর আরবী মাস্টার। আমার চাচায় তাকে উৎসর্গ করছিলো–সে ইসলামের লেখাপড়া করবে, নামাজ রোজা করবে, গ্রামের লোকেরে পড়াবে, নামাজ রোজা শিখাবে–এই আর কি, এই আশা কইরা পাঠায়ছিলেন।
তো ঐ ছেলে–কত ইন্টারেস্টিং লাইফ তার–আমরা যখন নাকি স্কুলে পড়ি, তখন তার সাথে আমার প্রথম দেখা! বৎসরে একবার আইতো সে, নোয়াখালী থেইকা। আগে তো আমরা জানতাম না, খেয়াল করতাম না। তারপরে একবার আইলো। সে যখন নাকি আলীয়া মাদ্রাসার একটা স্তরে কী যেন একটা পরীক্ষা আছে—ওগুলি পরীক্ষা দিয়া, পাশ-টাস কইরা, মেট্রিকের সমতুল্য আইছে–(মেট্রিকের সমতুল্য কোনটা আমি জানি না।) তখন সে একবার আসছিলো। আইসা দেখে তার ছোট ভাই, আপন ছোটো ভাই (তারা দুই ভাই) লেখাপড়া শিখছে, আধুনিক লেখাপড়া শিখছে, স্কুলে যায় আমাগো লগে, এবং তারা আরবি ফারসি পড়ে নাই। ওই যে আমাদের এক মাওলানা পড়াইতো—ওইটাই, আর পড়ে নাই, স্কুল কলেজে না। তো এইটা দেইখা তার মন-টন খুব খারাপ হইয়া গেলো–যে সে তো এই বাড়ির কেউ না! সে এই বাড়িতে সব চেয়ে বড় ছেলে–সে হঠাৎ উপলব্ধি করলো যে–এইটা কী—আমি তবে কী হইতাছি? আমি মাওলানা হইতাছি আর আমারই ছোট ভাই, সে কলেজের টিচার, দারোগা-পুলিশ বা সরকারী কর্মচারী হইতাছে, মডার্ন ম্যান হইতাছে। এইডা সে টের পাইলো–সে আইসা। সে তখন গোঁ ধরলো যে আমি আর যাবো না, সে দাখিল-টাখিল একটা পাশ করছে, সে বললো যে–না আমি মাওলানা হবো না। আমার ভাইরা মডার্ন লেখাপড়া করবে আর আমি মাওলানা হবো–কীয়ের লাইগা? এই কইরা সে গ্রামে রইয়া গেলো। ভারি ইন্টারেস্টিং স্টোরি, সুন্দর স্টোরি। তারপরে–আনোয়ার তার নাম, খুব সুপুরুষ, দেখতে শুনতে খুব পরিষ্কার। তারপরে তাকে বলা হইলো, ঠিক আছে, তুমি আইয়া ভর্তি হও, তুমি আর যাইবা না? শেষ পর্যন্ত ঢাকায় আইনা তাকে ভর্তি করা হইল। তখন মাদ্রাসার ডিগ্রিগুলোকে অ্যাডজাস্ট করার জন্য ইক্যুইভ্যালেন্ট লেভেল আছে, সেই অনুযায়ী সে ভর্তি হইয়া আইএ পাশ করলো। দুই বছর পাউছাইয়া গেলো সে, ছোট ভাইয়ের থেইকা। বিএ পাশ করলো, এমএ-ও পাশ করছে। তো এমএ পরীক্ষা দিতে যাইয়া… এমএ পরীক্ষার আগে–তাঁর বয়স হইয়া গেছে বেশি, তুলনামূলক হিসাবে এবং সে বিয়া না করলে তো ছোট ভাইয়েরা বিয়া করতে পারে না! আমাদের বাড়িতে বিএ পাশ করার পরে চাকরি-বাকরি পাওয়ার পরে বিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু তাকে বিএ পাশ করার পরেই বিয়ে দেওয়া হইলো, এইজ নষ্ট হইতাছে! তারপরে তার বিয়া হইলো, সে তখন এমএ পড়ে, এবং সে ফজলুল হক হলে থাকতো। তারপর সেইখান থেইকা সে পরীক্ষা দিয়া এমএ পাশ করলো। এমএ পরীক্ষা দিয়া সে বিভিন্ন ইন্টারভিউ দিলো। তার অধিকার হইয়া গেছে এই জেনারেল এডুকেশনে আসাতে। তারপর সে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে জয়েন করলো এবং মডার্ন লাইফে চইলা গেল! এক আশ্চর্য ঘটনা—সে আরবি পড়ছে… কিন্তু আর পড়লো না! তার কয়েকটা বছর নষ্ট হইছে। আমার বাবা আমাদের কাউরে এইরকম উৎসর্গ করে নাই। আমার বাবা মডার্ন ছিলো, আমার চাচা ছিলো ঐরকম। আমার এক চাচাই ঐ রকম ছিলো। সে ছেলে উৎসর্গ কইরা দিলো আল্লার নামে, কাণ্ডজ্ঞানহীন। বাবায় গালিগালাজ করলো, সবাই গালিগালাজ করলো, শুনলো না-ই। তারপরে ছেলে বিদ্রোহ করলো, যে আমি আর আরবি পড়বো না, আমি তো পড়ছিই! তখন একটা প্রোভিন্সের ভিতরে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাইয়া লেখাপড়া হইতো।
এখন আর উনি নাই, মারা গেছেন। ওনার ছেলে মেয়ে আছে জনা পাঁচ-ছয়। ছেলে-মেয়েরা সবাই মোটামুটি ভালো জায়গায় আছে, দুই-তিনজন এমএ পাশ করেছে। আমারই চাচতো ভাই-বোন। একটা বাড়িতেই তো বিপ্লব হইয়া গেলো! আমার চোখের সামনে ঘটলো এইগুলা।
আমি অবশ্য কোনো বিপ্লব করি নাই, একটা স্কুলে যাইতাম, দেড় মাইল দূরে, লেখাপড়া করতাম, লেখাপড়ার কোনো বাধা ছিলো না, এইটাই বড় কথা।
পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই আমরা পাইতাম না, বেশিরভাগ সময়ে পাইতাম না। তো আমি একবার জোগাড় করলাম 'শিশু সওগাত' আর 'সওগাত'। আমাদের বাড়িতে আইতো, আর বঙ্কিমচন্দ্রের কিছু কিছু বই, শরৎচন্দ্রের বই—এই দুই একজনের বই আর নজরুলের দু-একটা বই আমাদের বাড়িতে আইছিলো, আমরা পড়ছিলাম। এবং তার ফলেই শরৎচন্দ্রের কয়েকটা উপন্যাস আমি পড়ছি। আর কিছু গল্প, আর বঙ্কিমচন্দ্রের কয়েকটা উপন্যাস—দুর্গেশনন্দিনী ইত্যাদি আমি পড়ছিলাম। আমার মতো আমাদের বাড়িতে খুব কম লোকেই এগুলি পড়ছে। আমার পরে ভাই ব্রাদারেরা–চাচতো ভাইরা–তারা পড়ছে, আমার আগে আর পড়ে নাই কেউ। একটা বিশেষ সার্কেলের মতো ছিলো—ইসলাম, মুসলিম, বৌদ্ধ ধর্ম, ইসলামী সাহিত্য, সংস্কৃতি, তারপর আরব দেশ থেকে আরব দেশের বই, তারপরে পারসিয়ান বই—আমাদের বাড়িতে আনা হইতো। পাশের দেশ হইয়া বই আইতো আমাদের এখানে। এই শেখ সাদী, শেখ নবী এদের কবিতার বই আসতো, চটি বই। ফার্সি তো আরবি হরফে লেখা, আমি পড়তে পারতাম। কিছু কিছু পড়ছি আমি, কিছু কিছু কবিতা মুখস্ত আছে আমার। দুই-তিনটা আমার মনে আছে এখনো। বিখ্যাত কয়েকজন কবি–রুমী, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদীর অনেক কিছু মুখস্ত ছিলো আমার। একটাও মনে নাই এখন! আমার বাবায় পড়তে পারতো। বাবায় পইড়া আমারে পড়তে দিতো এবং সে আমাকে পড়াইতো। তার ফলে কিছু কিছু ফার্সি কবিতা আমার মুখস্ত হইছিলো, এখন আর মনে নাই।
ফয়েজ আহমদ
তখন যাত্রা, গানের পালা, নাটক খুব নিয়মিত ছিলো। আমিও করছিলাম। সিরাজুদ্দৌলা নাটকে দুই মিনিটের পাঠ আমাকে দিছে। আমাদের ওইখানে একটা বাজার আছে—শ্রীনগর, সেইখানে পূজা-পার্বনের সময় তারা এগুলা করে—জমিদার এইগুলা করে, মাঝে মাঝে জমিদার টাকা-পয়সা দেয়। এছাড়া বাজার থেকে চাঁদা উঠাইয়া যেমন সিরাজুদ্দৌলা আমি করছি, মনে আছে আমার, তারপরে রায়চাঁদ-কেদারচাঁদ করছি; টিপু সুলতান করছি। এই নাটকগুলো করছি আমি, তবে ছোট ছোট পাট। এগুলা হইতো শ্রীনগর থানায়, আমার বাড়ি থেকে আধ মাইল দূরে।
আমার বাবা বিশেষ বাধা দিতো না, কিন্তু রাত-বিরাতে একটু অসুবিধা বোধ করতো। তো আমাদের বাড়িতে একটা চাকর ছিলো, তাকে নিয়ে আমি যাওয়া আসা করতাম। ও আমার লগে থাকতো।
নাটক করছি, তারপরে নৌকা বাইচ করছি, তার পরে গাজীর গান আর বিবির গান ছিলো। এইগুলিতে আমরা গেছি। পাট-টাট করি নাই, কিন্তু গেছি। এইগুলা রাইতে হইতো, তাই স্কুল পালাইতে হয় নাই। স্কুল পালাইয়া আমি কোলকাতায় গেছি, নানান জায়গায় গেছি কিন্তু নাটক বা গানের জন্য স্কুল পালাইতে হয় নাই।
পালাইয়া আমি একবার গেছি উলুবেড়িয়া, আমার ভাইয়ের কাছে। আমার বড় ভাই থাকতো রাচিতে, ওইখানে বাড়ি থেকে পালাইয়া গেছি আমি, তারপরে কোলকাতা গেছি। বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিছি, বই কিনতে নিছি, নিয়া পালাইয়া গেছি! মিথ্যা বলি নাই, কিন্তু কীয়ের লাইগা টাকা লাগবে তা বলি নাই। তো দুইবার-তিনবার চাইয়া আমি হয়তো মাসে দশ টাকা পাইলাম বা আট টাকা পাইলাম। তাতেই তো হইয়া যায়। ৬ মাইল হাঁইটা গেলে স্টিমার ঘাট, স্টিমার ঘাট থেকে গোয়ালন্দ গেলে ছয় আনা-আট আনা ছিলো তখনকার দিনে, স্টিমার ভাড়া। ওখান থেকে এক ট্রেনে চলে গেলাম। সকাল ছয়টায় নামাইয়া দিলো। যাতায়াত খুব সস্তা ছিল, খুব সস্তা।
আমাদের বাড়ি থেকে গোয়ালন্দ দিয়া যাইতে হয় কোলকাতায়, একমাত্র পথ, আর কোনো পথ নাই। পদ্মা নদীর ভিতর দিয়া বড় বড় জাহাজ আছে, পাঁচশ-হাজার মানুষ নিতে পারে। সেই জাহাজে গোয়ালন্দ যাইয়া নামতে হয় সন্ধ্যায়। ঐখানে ট্রেন দাঁড়াইয়া আছে, রাত ৮টায় ছাড়ে, ভোর ৬টায় নামাইয়া দেয় কোলকাতায়। এর থেকে ভালো খবর আর কী আছে, নাই তো কিছু!
আর আইবার সময় ভাইরা টাকা দিছে। আমি ভাইদের কাছে গেলে তারা চিঠি লেইখা বাবা-মায়রে জানাইতো যে আমি তার কাছে আছি। পালানোর জন্য বাবা-মা খুব রাগ-টাগ করতো না; বাড়ি ফেরার সময় আমি এটা-ওটা নিয়া আসতাম—খাবার জিনিস, বাবার ওষুধপত্র ইত্যাদি।
সম্পাদনা: রেজাউল করিম
লেখকের আর্টস প্রোফাইল: ফয়েজ আহমদ
ইমেইল: [email protected]
—
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts