দুই বছরে ব্যাংকটি লোকসান করেছে ৪ হাজার ৭৫৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকারও বেশি।
Published : 28 Apr 2024, 11:03 PM
আগের বছরের তুলনায় অর্ধেকে নামাতে পারলেও আবার বিপুল লোকসান গুনল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক (এনবিএল)।
খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়া ব্যাংকটি গত ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরে লোকসান ছিল সোয়া তিন হাজার কোটি টাকা।
বড় ঋণ খেলাপি হয়ে পড়া, ঋণের বিপরীতে সুদ আদায় করতে না পারা ও নগদ টাকার সংকট মেটাতে ধার করা সুদের অর্থ পরিশোধ গিয়ে দুই বছরে পৌনে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান করল সবচেয়ে বেশি পরিশোধিত মূলধনের ব্যাংকটি।
শনিবার ব্যাংকটির পরিচালক পর্ষদের বৈঠকে ২০২৩ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করা হয়। এরপর রোববার ঢাকা ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জের বোর্ডে এই তথ্য প্রকাশ হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৩ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকের শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে চার টাকা ৬৫ পয়সা।
৩ হাজার ২১৯ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের ব্যাংকটির শেয়ার সংখ্যা ৩২১ কোটি ৯৭ লাখ ৩৯ হাজার ৫৭০টি। এই হিসাবে লোকসান দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৯৭ কোটি ১৭ লাখ ৮৯ হাজার টাকা।
আগের বছরে ব্যাংকটির সমন্বিতভাবে শেয়ার প্রতি নিট লোকসান হয় ১০ টাকা ১৩ পয়সা। টাকার অঙ্কে লোকসান ছিল ৩ হাজার ২৬১ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
অর্থাৎ দুই বছরে ব্যাংকটি লোকসান করেছে ৪ হাজার ৭৫৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকারও বেশি।
এই লোকসানের কারণে বিনিয়োগকারীদেরকে লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। আগের দুই বছরও তারা কোনো লভ্যাংশ পায়নি।
রোববার এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরও ৩.৫৭ শতাংশ বেড়েছে। তবে অভিহিত মূল্য ১০ টাকার চেয়ে ৪৩ শতাংশ কমে এখন শেয়ারদর ৫ টাকা ৭০ পয়সা।
বিপুল পরিমাণ লোকসানের কারণ কী- এই প্রশ্নে ন্যাশনাল ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘পুরনো দায়ের কারণে ব্যাংক এখন লোকসান গুনছে। যারা ব্যাংকের টাকা নিয়েছে তারা অর্থগুলো ফেরত দিলে সমস্যাটি কেটে যায়। টাকা ফেরত দেওয়া তাদের দায়িত্ব।”
তিনি জানান, অনেক শিল্পগ্রুপই ঋণের অর্থ ফেরত না দেওয়ায় আয়ের তুলনায় সুদ ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে নগদ টাকার সংকট চলছে। টাকা ধার করতে গিয়ে বেশি সুদ দিতে হচ্ছে অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে।
সৈয়দ ফারহাত বলেন, ‘‘আমরা সব প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছি অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য। যারা যোগাযোগ করেছেন তাদের সঙ্গে আলোচনা করছি। আমরা তাদের বলেছি, ব্যাংকের পাশে থাকলে আমরাও তাদের দিকটি দেখব।”
২০২৩ সালের ৯ মাসে ব্যাংকটি সুদ বাবদ আয় করে এক হাজার ২৭৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এই সময়ে আমানতকারী ও ধরা করা অর্থের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করে দুই হাজার ২০৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
শুধু ৯ মাসেই সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংকটি লোকসান গুনে ৯৩১ কোটি ৪৭ লাখ টাকার। ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে ব্যাংকটি লোকসান হয়েছিল ৩৮৬ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিতরণ করা ৪২ হাজার ২৬০ কোটি টাকার মধ্যে খেলাপি ১৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। খেলাপির হার ৩১ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
ব্যাংকটিতে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা।
নগদ অর্থের সংকটে বাড়ছে ধার
২০২৩ সালে শেয়ার প্রতি নগদ অর্থের প্রবাহ ছিল ঋণাত্মক এক টাকা ৮৪ পয়সা। আগের বছরে যা ছিল ঋণাত্মক ১৭ টাকা ২১ পয়সা। ২০২১ সালে তা ইতিবাচক হিসেবে ছিল ২ টাকা ১১ পয়সা।
বড় ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়া ও ঋণ গ্রহীতাদের কাছে থেকে অর্থ আদায় করতে না পারায় সুদকে আয় খাতে নিতে পারেনি ন্যাশনাল ব্যাংক।
ডিএসইকে দেওয়া তথ্যে উল্লেখ করা হয়, নগদ অর্থের চাহিদা মেটাতে উচ্চ সুদে অর্থ ধার করতে হয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংককে। এটি লোকসানের পাল্লাকে আরো ভারি করেছে।
ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা উন্মোচন ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে পরিচালক পর্ষদের ‘বনিবনা’ না হওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালের মে মাসে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
আট মাস পর ওই বছরের ২৯ ডিসেম্বর সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল। পরে জানুয়ারি মাসে ১০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
চলতি মূলধন, ভোক্তা, কৃষি, সিএমএসএমই খাতে শুধু ঋণ পারবে ব্যাংকটি। এর বাইরে অর্থাৎ প্রকল্প ঋণ, আমদানি অর্থায়ন বা রপ্তানি বিলের বিপরীতে ঋণ বিতরণ করতে পারবে না ব্যাংকটি।
ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ ফরহাত আনোয়ার বলেন, ‘‘ঋণ বিতরণ করতে না পারায় স্বাভাবিকভাবেই আয় কমে গেছে। এখন স্বল্প সুদের আমানত সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। স্বেচ্ছা খেলাপিদের তালিকা করা হচ্ছে। সেই তালিকা ধরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সবার সহযোগিতা পেলে ব্যাংকটি খুব দ্রুত মুনাফায় চলে আসতে পারবে বলে আশা করছি।’’
প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণ নিয়মিত বা অশ্রেণিকৃত হলে তার বিপরীতে মুনাফা থেকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ, নিম্নমানের শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং সন্দেহজনক শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ) হিসেবে কেটে পৃথক হিসাবে রাখতে হবে।
খেলাপি হওয়া ঋণ মন্দ মান বা আদায় অযোগ্য হলে তার বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন অর্থাৎ যে পরিমাণ ঋণ মন্দ মানে পৌঁছেছে তার সম পরিমাণ অর্থ মুনাফা থেকে কেটে রাখতে হবে। যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ যত বেশি তাকে তত বেশি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে।
অর্থ আটকে যাওয়ায় ব্যাংকটি প্রয়োজনীয় প্রভিশনও সংরক্ষণ করতে পারছে না। গত সেপ্টেম্বরে শেষে খেলাপির বিপরীতে ব্যাংকটির ১৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু ব্যাংকটি এ খাতে ঘাটতি ছিল ১৩ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর শেষে আরও বেড়েছে।
১৯৮৩ সালে ১৮ উদ্যোক্তা পরিচালক শুরু করেন ন্যাশনাল ব্যাংক, যাদের মধ্যে ছিলেন একেএম আবু তাহের, আবু তাহের মিয়া, জয়নুল হক সিকদার, খলিলুর রহমান ও মোয়াজ্জেম হোসেন।
২০০৯ সালে পরিচালনা পর্ষদে ব্যাপক বদলের মাধ্যমে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের কাছে। এরপর একে একে অন্য পরিবারের পরিচালকরা পর্ষদ থেকে বাদ পড়েন। জয়নুল হক সিকদারের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরা পর্ষদে আসেন।
এক যুগের বেশি সময় ধরে চেয়ারম্যান থাকার পরে জয়নুল হক সিকদারের ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যু হলে তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন গত ডিসেম্বর পর্যন্ত।
এক বছর পর ২০২২ সালের অগাস্ট পর্ষদ থেকে সরে যেতে হয় উদ্যোক্তা পরিচালক ও হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেনকে। একই পরিবারের মাবরুর হোসেনও বাদ পড়েন। এর মাধ্যমে ব্যাংকটিতে সিকদার পরিবারের কর্তৃত্ব আরও নিরঙ্কুশ হয়।
এ পরিবারের বাইরে পরিচালক হিসেবে তখন ছিলেন উদ্যোক্তা পরিচালকদের মধ্যে কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকটির পরিচালক ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন।
বাবার মৃত্যুর পর ব্যাংক ও পারিবারিক ব্যবসার উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার ও কন্যা পারভীন হক সিকদার।
সন্তানদের বিবাদ সামাল দিতে অনেকটা ব্যর্থ হন মনোয়ারা হক সিকদার। পারিবারিক দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের উপরও। পরিচালক পর্ষদে সিকদার পরিবারের চার পরিচালক থাকায় বিবাদ স্পষ্ট হয়ে উঠে।
এর মধ্যে ঋণ নিয়ে অনিয়ম এবং সিকদার পরিবারের সদস্য পরিচালকদের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে প্রায় দেড়শত কোটি টাকার অর্থপাচার ও ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ হয়।
ব্যাংকটির দুরবস্থা আরও বাড়তে থাকার মধ্যে নিয়ম ও বিধি ভাঙাসহ বিভিন্ন কারণ তুলে ধরে গত ডিসেম্বরে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে সাজানো হয় নতুন পর্ষদ। দীর্ঘদিন পর সিকদার পরিবারের বাইরে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার।
প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পরে ন্যাশনাল ব্যাংকে সারা দেশে ২২১টি শাখা ও ৬০টি উপশাখা রয়েছে।
আরও পড়ুন
একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত ‘এখনই না’, সময় নেবে এনবিএল: চেয়ারম্যান