Published : 23 Jan 2024, 07:20 PM
‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে’– যশোরবাসীর জন্য ভৈরব পাড়ে বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এই নান্দনিক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। মনোরম পরিবেশে মানুষ বিনোদনের জন্য এখানে আসবে, শিশু-কিশোররা খেলা করবে, স্বাস্থ্য-সচেতন মানুষ হাঁটাহাটি করবে, পথচলতি মানুষ প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেবার সুযোগ পাবে, পাড়ে বসে নির্মল বাতাস উপভোগ করবে। নদের পাড় বাঁধিয়ে ঘাট তৈরি হয়েছে যাতে মানুষ নদের পানির পরশ পায়। এহেন নান্দনিক পরিবেশে তারা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন গুরুতপূর্ণ দিন এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবে।
আনন্দ আয়োজনের তালিকা এখানেই শেষ নয়। আরো কত শত সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে লিখে শেষ করা কষ্টকর। যশোরসহ এতদাঞ্চলের নদের পাড়ের সকল মানুষের দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রামের ফল হিসেবে সরকার ভৈরব সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। সংস্কার কাজ শেষে আরো অনেকের স্বপ্নপূরণে এখন নদের পাড়কে নান্দনিক করা হচ্ছে। সামগ্রিক অবস্থা দেখে গ্রামবাংলার একটা প্রবাদের কথা মনে আসছে, ‘দা-য়ে যদি ধার না থাকে, তবে হাতলে জোর থাকতে হবে।’
যশোরবাসীর স্বপ্নের বহতা নদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে করা পুনঃখননের দশা বেহাল, তাই এমন নান্দনিক পরিবেশ করে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে নেয়ার চেষ্টা মাত্র। ঠিক যেন হাতলের জোর বাড়ানোর চেষ্টা।
ভৈরব পাড়ের মানুষ নিকট-অতীতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল বহতা নদ আবার প্রবাহিত হবে আপন গতিতে, আপন মহিমায়। কিন্তু দীর্ঘ এক দশকের অপেক্ষার পর নদ সংস্কার হলো ঠিকই কিন্তু তা বহতা হলো না। আসলে বর্তমান সময়ে সাধারণ মানুষ কি চায় তা কোথাও-ই বিবেচ্য নয়, তার চাইতে বড় বিষয় কিংবা বলা যায় একমাত্র বিষয় ক্ষমতা বলয়ে থাকা দায়িত্বপ্রাপ্তরা জনকল্যাণে কি ভাবছে। তাইতো ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষেরা নদ সংস্কারের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে নদ সংলগ্ন এলাকার মানুষের পানি নিষ্কাশন ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রকল্পে রূপান্তর করে ফেলে। তাইতো ২৭২ কোটি টাকা ব্যয় করে ভৈরব নদে যে সংস্কার হলো তাতে সংস্কারকারীরা আপন কর্মনৈপুণ্যে প্রচণ্ড খুশি হলেও সাধারণ মানুষ হতাশ। আসলে মানুষ ভাবে কী, আর উন্নয়নের নামে হয় কী?
নদ সংস্কারের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। ভাগ ভাগ করে যে কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে তার পরিণতি হিসেবে দু-পাড়ের মানুষ অতীতের নদকেই ফিরে ফিরে দেখছে। সাধারণ মানুষ জানে আজকে কোনোরকমে কচুরিপানাহীন দৃশ্যমান সংস্কার পাড়ের মানুষকে দেখানো হলেও ভৈরব নদের বিপণ্ন অতীতে ফিরে যেতে খুব বেশিদিন সময় লাগবে না, লাগতে পারে না।
দেশের ছোট ছোট নদ-নদীগুলোকে বহতা দেখতে চায় না ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা মানুষেরা। কারণ বহতা নদী দখল করা সমস্যা। অপরদিকে চিরকালের বন্ধুদেশ এক তরফা পানি প্রত্যাহার করে দেশ ও জাতি যে উপকার করেছে তার চাইতে হাজার গুণ বেশি উপকার করেছে শক্তিশালী ক্ষমতাবানদের। অনেকেই আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানকে নদ-নদীর বর্তমান অবস্থার কারণ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। ব-দ্বীপের গঠন প্রণালী চলমান থাকায় অনেক নদী হারিয়ে যাবে, পথ পরিবর্তন করবে এসব অস্বীকার করার কোনো কারণও নেই। তবে দেশের নাগরিক হিসেবে ক্ষমতাবানদের নদীর প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখা ভিন্ন করার কিছু আছে বলে বোধের মধ্যে আসে না। দেশের শত শত নদ-নদী এপর্যন্ত দখলে চলে গিয়েছে শুধু নয়, অনেক বড় বড় নদী আস্তে আস্তে দখলে চলে যাচ্ছে প্রতিদিন।
জবাবদিহিতাহীন, দায়বদ্ধতাহীন সমাজে এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তা উপর দেশে যেখানে নদ-নদীর কোনো একক মালিকানা নেই, যার যখন যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করা যায় সেখানে তো সবাই সোনায়-সোহাগা। সাধারণ মানুষের কথা বলার কোনো অধিকার নেই আর শক্তিশালীরা নদীকে হজম করার কাজে নিবেদিত তাই স্বার্থের বাইরে তারা কোনো কথা বলে না।
দেশের নদ-নদীগুলো একক মালিকানা এ বদ্বীপের প্রাণ-প্রকৃতির স্বার্থে খুব জরুরি। নদীকে নদী বলে চেনার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। দেশে এখন সবাই নদীকে নিজেদের মতো ব্যবহার করতে ব্যস্ত, তাতে নদীর কি হলো তা দেখার ন্যূনতম প্রয়োজন কেউ বোধ করে না। একজন মনের মাধুরী মিশিয়ে নদী শাসন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে কাজ করে তো, আর একজন যাকে মন চায় তাকে নদী দান করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত, একজন জলযান পরিচালনা করে নদী দূষণ করছে, অন্যজন নদীকে ভাগাড়ে পরিণত করার কাজ সম্পন্ন করছে। এমনকি দেশের সাধারণ মানুষ শক্তিশালী ক্ষমতাবানদের অপকর্ম দেখে নিজেরাও নদীর প্রতি অন্যায় করতে বিচলিত হচ্ছে না।
অনেকে বলবেন সরকার নদী রক্ষা কমিশন তৈরি করেছেন সারাদেশের নদ-নদী দেখভাল করার জন্য। কিন্তু নখদন্তহীন কমিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে বছরের পর বছর ধরে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে, করেই চলেছে। আগামী একশত বছরেও একাজ শেষ হবে বলে সাধারণ জনগণ মনে করে না। মোদ্দা কথা হলো সুপারিশকারী প্রতিষ্ঠান তৈরি করে কোনো লাভ হবে না, প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতা দিয়ে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। নদ-নদী সংক্রান্ত কোনো কর্মকাণ্ডই কমিশনের অজান্তে করা যাবে না, কিংবা করা হবে না এমন একটা কমিশন যদি দেশে থাকত, তাহলে ভৈরব নদ সংস্কারের ফল সাধারণ জনগণ হাতে-নাতে পেতে পারত। তাই বদ্বীপকে বাঁচাতে, নদ-নদীকে বাঁচাতে, নদী রক্ষা কমিশনকে ক্ষমতা দিয়ে, গুরুত্ব দিয়ে, দায়িত্ব দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
দেশে আজ মেগা প্রকল্পের শেষ নেই। জনকল্যাণে সরকার এসব মেগা প্রকল্পে আত্মনিয়োগ করেছে। তাই ভুলে ভরা শত শত পরিকল্পনার এ-দেশে ভৈরব সংস্কারের মতো একটা ছোট, মাত্র শত কোটি টাকার প্রকল্প কারই বা নজরে পড়ে। এই ধরণের প্রকল্পগুলো সাধারণভাবে মাঠে থাকা অনুরাগীদের, সমর্থকদের জন্য বিশেষ উপহার মাত্র। মাঠ গরম রাখার জন্য, জনগণের কাছে উন্নয়ন বোঝানোর জন্য, সরকার যে জনগণের কথা ভাবে তার প্রমাণ দেখানোর জন্য দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় এমন অনেক প্রকল্প করা হয়ে থাকে, এখনও হচ্ছে। শুধু ভৈরব সংস্কারের মধ্যে এমন প্রকল্প সীমাবদ্ধ নেই, আরো বহু নদ-নদীর ভাগ্যে এমন সংস্কার জুটেছে কিন্তু সংশ্লিষ্টরা এর থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। আর আমাদের জবাবদিহিতাহীন, দায়ব্ধতাহীন সমাজে অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণের কোনো কারণ বা প্রয়োজন আছে বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তাই জনগণ জানে এবং মানে এসব প্রকল্প নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো। উৎসে পানির ব্যবস্থা হলো না কিন্তু মোহনা দিয়ে জোয়ারের পানি এসে নদে জোয়ার–ভাটা খেলার স্বপ্ন মানুষকে দেখানো হলো, কী বিচিত্র আমাদের দায়িত্ববোধ, কী বিচিত্র আমাদের পরিকল্পনা। ভাবতে অবাক লাগে দায়িত্ববান কোনো মানুষ এমন স্বপ্ন দেখতে পারে, কিংবা দেখাতে পারে। এই সেদিন, ভৈরব পাড়ের কথিত নান্দনিকতা দেখতে গিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে ছড়া কাটতে শুনলাম, ‘ভাটিতে কাটিয়া নদীকে করিবে ড্রেন, জনতা কহিবে আহা কী রাজার ব্রেন।’ একজন সাধারণ কিশোরের মগজে যে কথাটি আসছে, আমাদের বিশেষজ্ঞদের কথাটি মাথায় নেই, এটা কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য। তাইতো নিঃশঙ্ক চিত্তে বলা যায়, ভৈরব পাড়ের মানুষ আশায় বুক বাঁধলেও সেই আশার গুড়ে বালি পড়বে তা নিশ্চিত। যদিও আগামী সাক্ষী দেবে স্বপ্নের সফলতার, তবে বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে সহজেই বলা যায় শুধুমাত্র আইওয়াশের জন্যই সংশ্লিষ্টরা নান্দনিক ভৈরব উপহার দিতে এত আগ্রহী হয়েছেন ।
দেশের সাধারণ মানুষ দলবদ্ধ নয়। দলবদ্ধ না হতে পারার কারণে বুদ্ধি ও বাহুবলে যে শক্তিশালী, তাদের অনুগত থাকতে বাধ্য হয় তারা। ফলে দেশের সর্বত্রই শক্তিশালীদের আনুগত্যভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠেছে। এতে করে সাধারণ মানুষদের মধ্যে ব্যক্তিসত্তা ও মর্যাদাবোধ গড়ে উঠতে পারেনি। আমাদের স্বাধীনতা বা মহান মুক্তিযুদ্ধ এই সমাজকে ভেঙ্গে সাধারণ মানুষকে বের করে আনতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জীবন উৎসর্গকারী মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের অঙ্গীকার রক্ষায় এগিয়ে এসে সমাজ ভাঙ্গার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে আজ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ শক্তিশালী ক্ষমতাবানদের রূপকথার রাজপুত্র বিবেচনায় আনুগত্য প্রকাশ করে চলেছে। এ বিবেচনাই চলমান জীবনধারার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। তাই রাজার অনুসারীরা জনগণের জন্য যা করে সেটাই কল্যাণকর, সেটাই মঙ্গলজনক, সেটাই সঠিক, এর অন্যথা হবার বা ভাববার কোনো সুযোগ নেই।
ভৈরব সংস্কারের ক্ষেত্রেও এই বিষয় ঘটেছে। ভৈরব পাড়ের মানুষ বহতা নদের জন্য যতই আন্দোলন সংগ্রাম করুক না কেন রাজার অনুচরেরা যা দেবেন তাহাই রাজার প্রসাদ, তাহাতেই জনগণের মঙ্গল, এ বিবেচনা, এ ভাবনাই উত্তম, একমাত্র মঙ্গলকারক। শুধুমাত্র ভৈরব পাড়ের মানুষ বিভিন্ন স্থানে এমন নান্দনিক পার্ক গড়ে তোলার দাবি তুলে রাজার অনুসারীদের সহযোগিতা করতে পারে। যতকিছুই হোক রাজন্যবর্গকে খুশি রাখা জনগণের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব তা অস্বীকার করা যাবে না কোনোভাবেই।