বিপুল এ লোকসানের পেছনে সুদ মওকুফ, খেলাপি ঋণ বাড়ায় সুদ থেকে আয় কমে যাওয়াকে কারণ হিসেবে তুলে ধরেছে ব্যাংকটি।
Published : 30 Apr 2023, 11:24 PM
ঋণ অনিয়মে ধুঁকতে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংক এক বছরেই ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিয়েছে।
এর আগে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো ব্যাংকের এক বছরে এত বেশি লোকসান দেওয়ার তথ্য জানাতে পারেননি ব্যাংক ও পুঁজিবাজার খাতের অনেকেই।
রোববার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে ২০২২ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদনের পর প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি ১০ টাকা ১৩ পয়সা লোকসান হয়েছে।
এ লোকসানের কারণে ব্যাংকটির পর্ষদ টানা দ্বিতীয় বছরের জন্য বিনিয়োগকারীদেরকে কোনো লভ্যাংশ না দেওয়ার সুপারিশ করেছে বলে একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিএল) জনসংযোগ বিভাগ থেকে জানানো হয়, অর্থসূচক ডটকম নামের ওই সংবাদ মাধ্যমে ২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
বেসরকারি খাতের ব্যাংকটি আগের বছর ২০২১ সালের জন্য বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি; যদিও ওই বছর শেয়ারপ্রতি ১২ পয়সা মুনাফায় ছিল ব্যাংকটি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে ন্যাশনাল ব্যাংক শেয়ারপ্রতি লোকসান দিয়েছে ১০ টাকা ১৩ পয়সা। ৩ হাজার ২১৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের ব্যাংকটির শেয়ার সংখ্যা ৩২১ কোটি ৯৭ লাখ ৩৯ হাজার ৫৭০টি। এ হিসাবে লোকসান হয়েছে ৩ হাজার ২৬১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০২১ সালে ব্যাংকটি মুনাফা করেছিল ৩৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
১৯৮৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকটি এক সময় বেশ শক্তিশালী ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি ছিল।
২০১০ সালে শেয়ারপ্রতি ১৫ টাকা ৫৫ পয়সা হিসেবে ৬৮৬ কোটি টাকার বেশি চূড়ান্ত মুনাফা করে। ওই বছর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা করও দেয় ব্যাংকটি।
এরপর থেকে প্রতি বছর মুনাফা কমতে কমতে ২০২২ সালের প্রতি প্রান্তিকেই লোকসান দেখায়। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে ১৮ পয়সা, দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৩৬ পয়সা, তৃতীয় প্রান্তিকে ৫৭ পয়সা হিসেবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শেয়ার প্রতি ১ টাকা ১০ পয়সা লোকসানের তথ্য অনিরীক্ষিত আর্থিক হিসাবে দেয় ব্যাংকটি। টাকার অংকে লোকসানের পরিমাণ প্রায় সাড়ে তিন শ কোটি টাকা।
চূড়ান্ত হিসাবে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে তা বেড়ে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা হয়েছে।
এত লোকসানের নেপথ্যে কী?
ব্যাংকটির মুনাফায় এমন ভরাডুবি কীভাবে হল, সে বিষয়ে এনবিএলের কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকম।
কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহমুদ হোসেন ও কোম্পানি সচিব কায়সার রশিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। তারা কেউ ফোন ধরেননি।
তবে প্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের বিজ্ঞাপনে সংক্ষেপে লোকসানের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে।
এতে বিপুল এ লোকসানের কারণ হিসেবে সুদ মওকুফ, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি ও সুদ আয় কমে যাওয়াকে তুলে করা হয়েছে। কী পরিমাণ সুদ মওকুফ করা হয়েছে, কেন কওকুফ করা হয়েছে সেগুলো উল্লেখ নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। মোট ঋণের মধ্যে খেলাপির হার ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। পূর্ণাঙ্গ আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ পেলে যা আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
ব্যাংকটির আয় কমার পাশাপাশি শেয়ার প্রতি অর্থপ্রবাহও কমেছে। গত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ২ টাকা ১১ পয়সা অর্থপ্রবাহ থাকলেও এবার ১৭ টাকা ২১ পয়সা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এর কারণ হিসেবে মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেওয়াকে দায়ি করা হয়েছে।
তবে কত টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে আমানত কত ছিল, এসব বিষয়েও কিছু জানানো হয়নি।
তবুও আশাবাদী সাবেক ভারপ্রাপ্ত এমডি
ন্যাশনাল ব্যাংকে দীর্ঘ সময় চাকরি করেছেন এ এস এম বুলবুল। তিনি উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকও ছিলেন। দুই বছর আগে তাকে এমডি করতে চেয়েছিল ব্যাংকটির মালিকানায় থাকা সিকদার গ্রুপ। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তা অনুমোদন করেনি।
ব্যাংকটির মুনাফায় এমন ভরাডুবি নিয়ে জানতে চাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “লোকসান একটু বড় অঙ্কের হলেও তা সাময়িক বলে মনে করছি। ঋণ ব্যবস্থাপনায় বছরের প্রথম দিক থেকেই নজর দিলে হয়ত এত লোকসান হতো না।”
দুই এক বছরের মধ্যে ব্যাংকটি ঘুড়ে দাঁড়াতে পারবে আশা করে তিনি বলেন, “সেই আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে ব্যাংকটির। এজন্য প্রয়োজন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।”
আগে থেকেই উদ্বেগ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর যে ১০টি ব্যাংককে বিশেষ তদারকির সিদ্ধান্ত নেয় সেগুলোর একটি এনবিএল।
ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরিচালক পর্ষদের ‘বনিবনা’ না হওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালের মে মাসে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে গত ২৯ ডিসেম্বর সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু ঋণ শৃঙ্খলা ফেরাতে জানুয়ারি মাসে আবার ১০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
ওই সময় বলা হয়েছিল, চলতি মূলধন, ভোক্তা, কৃষি, সিএমএসএমই খাতে শুধু ঋণ পারবে ব্যাংকটি। এর বাইরে অর্থাৎ প্রকল্প ঋণ, আমদানি অর্থায়ন বা রপ্তানি বিলের বিপরীতে কোনো ঋণ বিতরণ করতে পারবে না ব্যাংকটি।
ঢাকা স্টক এক্সেচেঞ্জে (ডিএসই) জমা দেওয়া ব্যাংকটির অনীরিক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির ঋণস্থিতি ৪১ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা।
রাখতে হয়েছে বিপুল পরিমাণ সঞ্চিতি
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো তাদের বিতরণ করা ঋণ নিয়মিত বা অশ্রেণিকৃত হলে সেটির বিপরীতে মুনাফা থেকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ, নিম্নমানের শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং সন্দেহজনক শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্জিতি সংরক্ষণ) হিসেবে কেটে পৃথক হিসাবে রাখতে হবে।
অপরদিকে খেলাপি হওয়া ঋণ মন্দ মান বা আদায় অযোগ্য বিবেচিত হলে সেটির বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন অর্থাৎ যে পরিমাণ ঋণ মন্দ মানে পৌঁছেছে সেটির সমপরিমাণ অর্থ মুনাফা থেকে কেটে রাখতে হবে।
যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ যত বেশি, সেটির তত বেশি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে এই অর্থবছরে বিপুল পরিমাণ ঋণকে খেলাপি দেখাতে হয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংককে। এসব ঋণের বিপরীতে রাখতে হয়েছে সঞ্চিতি। এর প্রভাব পড়েছে মুনাফায়।