আমি আমার ছোট্ট আঙুল দিয়ে মা’র পেটে একটা হাত রেখে বলার চেষ্টা করি, ‘মন খারাপ করো না মা’।
Published : 20 Apr 2024, 02:41 AM
আমার মা রোজ সকালে উঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে। ইদানিং ‘হে সখা মম হৃদয়ে রহো’ গানটি বেশি শুনছে।
আমারও ভালোই লাগে। কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগে। তবে কোনো কোনো গান শুনে মা কেঁদে ফেলে, তখন আমারও ভালো লাগে না। শরীরের চারপাশ দিয়ে সুড়সুড় করে কী যেন তরল বয়ে যায় আমার। আমি আমার ছোট্ট আঙুল দিয়ে মা’র পেটে একটা হাত রেখে বলার চেষ্টা করি, ‘মন খারাপ করো না মা’।
মা তখন তার হাত রেখে খোঁজার চেষ্টা করে, আমি কোথায় আছি। মাঝে মাঝে বাবাকে বলে, ‘শোনো, এটা বোধহয় পুতুসি’র আঙুল।’ বাবাও মাঝে মাঝে আঙুল নেড়ে আমাকে এদিক ওদিক খুঁজতে যায়। সুড়সুড়ি লাগে না বলো? আমি তখন টুক করে এখান থেকে ওখানে সরে যাই।
সাঁতার কাটা অনেকটাই শিখে গেছি। তাছাড়া মা’র হাতটা একটু নরম, বাবারটা একটু ভারি। ও হ্যাঁ, আমার নাম পুতুসি। মা আমাকে এ নামেই ডাকে। প্রথম প্রথম বুঝতাম না, ভাবতাম, ‘পুতুসি আবার কী? ওটাও কি কোনো খাওয়ার জিনিস? কেমন খেতে? আলুর মতো না তো? আলু আমার একদম পছন্দ না।’ পরে বুঝলাম, ওটা আসলে আমার নাম। মা আমাকে ওই নামে ডাকে।
অফিস থেকে মা যখন ঘরে ফেরে, তখন বাড়িতে কেবল মা আর আমি। মা তখন আমার সঙ্গে কথা বলে। বলে, ‘কেমন আছ মাম্মা? ক্ষুধা লেগেছে? ভাত খাবে? চলো আমরা ভাত খাই।’ আমার মা খাওয়া নিয়ে জোর করে না আমাকে। খাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করে, ‘খাবার মজা হয়েছে পুতুসি?’ তবে বাবা আর মা পুতুসি ছাড়াও আমার সুন্দর একটা নাম খুঁজছে। বাংলা নাম।
আমাদের বয়সী বাচ্চারা নাকি পৃথিবীতে এসেই অনেক কান্নাকাটি করে, তাই অফিসে মায়েরা আমাদের নিয়ে যেতে পারে না। আমরা হয়ত বড়দের কাজে অসুবিধা করি!
শুনেছি, আমি যখন পৃথিবীতে আসব, তখন নাকি শ্রাবণ মাস; ওই সময় নাকি খুব বৃষ্টি হয়। বাবা ফন্দি আঁটছে আমার নাম শ্রাবণ বা শ্রাবণী রাখার। তবে মা খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। মা আরেকটু ভাবতে চায়। আচ্ছা বৃষ্টি দেখতে কেমন হয়? ওটা কি খাওয়া যায়? খেতে কেমন?
আমার কাছে যদিও কাগজ বা কলম নামের জিনিসগুলো নেই, তবুও কিছু জিনিস মনে মনে টুকে রাখছি। এই যেমন, মা নাকি চকলেট, মিষ্টি খেতে ভালোবাসত; এখন আমি এগুলো খেতে চাই না বলে মা খেতে পারে না।
কিন্তু যখন আমি পৃথিবীতে আসব, যখন একটু বড় হব, তখন আমার চকলেটগুলো থেকে ভালো ভালো আর বড় বড়গুলো মাকেই দেব। মা’র সঙ্গে নীল রং দিয়ে আমিও ছবি আঁকব। আমি জেনে গেছি, মা’র প্রিয় রং নীল।
তবে মা’র মতো আমারও মাঝে মাঝে চিন্তা হয়, মা অফিসে গেলে আমি কার সঙ্গে থাকব? এখন তো মা যেখানেই যায়, আমিও সঙ্গে যাই। মার সঙ্গে অফিস যাই, বাজারে যাই, কফি খেতে যাই, বেড়াতে যাই, ট্যাপা পুতুল কিনতে যাই। কিন্তু তখন সবখানে নিয়ে গেলেও মা অফিসে আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না। কী অদ্ভুত না?
অবশ্য আমাদের বয়সী বাচ্চারা নাকি পৃথিবীতে এসেই অনেক কান্নাকাটি করে, তাই অফিসে মায়েরা আমাদের নিয়ে যেতে পারে না। আমরা হয়ত বড়দের কাজে অসুবিধা করি! কিন্তু আমাদেরও তো ইচ্ছে হয় মা’র আশপাশে থাকতে, বড়রাও তো এক সময় আমাদের মতোই ছোট ছিল, তাই না! তাহলে ওরা কি বোঝে না আমাদের কষ্ট হয়?
মাকে বলতে শুনেছি, আমি যখন পৃথিবীকে আসব তখন আমার গা থেকে সুন্দর একটা গন্ধ ভেসে আসবে। গন্ধেই টের পাওয়া যাবে আমি কোন ঘরে আছি। সে গন্ধ কাঁঠালিচাঁপার মতো নয়, গন্ধরাজের মতোও নয়; সে গন্ধ নাকি একেবারেই আলাদা। কিন্তু মা কি জানে, আমি মা’র গন্ধেই দিন-রাত ভেসে বেড়াই ছোট্ট সমুদ্রে এধার থেকে ওধার? সে গন্ধ পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। মা কি জানে, আমি মা’র সবটা জানি?