Published : 01 Aug 2011, 10:05 PM
(দ্বিতীয় কিস্তির পরে)
বাড়ি থেকে পালাইয়া যাওয়া ছাড়া মোটামুটি রেগুলার স্কুলে যাইতাম। আমাদের ষোলঘর হাইস্কুল ছিলো ছয় মাইলের মধ্যে একমাত্র। যদিও সাবডিভিশন অনুযায়ী চিন্তা করলে তখনকার দিনে সবচেয়ে বেশি স্কুল ছিলো বিক্রমপুরেই। তার একটা প্রধান কারণ আমার কাছে মনে হইছে, ওখানে কোনো কোনো জায়গায় ছিলো হিন্দুরা মাইনরিটি, কোনো কোনো জায়গায় হিন্দুরা মেজরিটি। কিন্তু হিন্দুরা যারা নাকি ভালো অবস্থার লোক ছিলো অর্থনৈতিকভাবে, তারা দান-দক্ষিণা করতো। তার মধ্যে স্কুল-কলেজ করা একটা। আর কয়েকটা জমিদার ছিলো বিক্রমপুরের ভিতরে–এই জমিদাররা পিপলের কোনো কাজে আসে নাই।
……………
বিডিনিউজ২৪.কম অফিসে ফয়েজ আহ্মদ
……………
যেমন শ্রীনগরের জমিদার, সে অ্যান্টি-পিপল ছিলো। সে স্কুল-কলেজ করার বিরুদ্ধে ছিলো, করতে দিতো না বরং। আমি যে স্কুলে পড়ছি তার নাম সংক্ষেপে ষোলঘর হাইস্কুল। এইটা এর আসল নাম না। গ্রামের নাম ষোলঘর, তাই লোকে বলে ষোলঘর হাইস্কুল। এটার নাম হচ্ছে একেএসকে হাইস্কুল। আগেই বলছিলাম একেএসকে হইল অক্ষয়কুমার ও শশীকুমারের আদ্যক্ষর। এঁরা ছিলো দুই বন্ধু, গরিব কায়স্থ। স্কুল করা-টরা ইত্যাদি পাবলিক কাজ করার ব্যাপারে উৎসাহী।
তারা নিজেদের জমানো টাকা দিয়া হাইস্কুল করলেন, শ্রীনগর থেকে অদূরে। শ্রীনগরের জমিদার বাড়ির কাছাকাছি তো করাই যাবে না। জমিদাররা কোনো স্কুলই করতে দেয় না। যে, ছোটলোকে লেখাপড়া শিখবে, এটা তারা চান না। সেই জন্য শ্রীনগরের বাইরে দেলভোগ বাজারের (দেলভোগ হচ্ছে আরেকটা বাজার, শ্রীনগরের জমিদারদের সাথে ঝগড়া কইরা এই বাজার করা হইছিলো।) হাফ মাইল দূরে ষোলঘর গ্রামের শেষ প্রান্তে ওই দুই বন্ধু জায়গা কিনে স্কুলটা করলেন। দেখা গেলো, শ্রীনগরের জমিদার—যার লক্ষ লক্ষ টাকা—তারা একটা প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত করে নাই। কিন্তু দুই বৃদ্ধ বন্ধু—যাদের জায়গা-জমি নাই-ই প্রায়, যা আছে তা বিক্রি কইরা স্কুল দিছেন। সেই জন্য স্কুলটার খুব সুনাম হইয়া গেলো।
এই সুনাম জমিদারদের বিরুদ্ধে গেলো। জমিদাররা বহুবার চেষ্টা করছে যাতে এই স্কুলটা প্রতিষ্ঠিত না হয়। যখন একবার এই স্কুলটা প্রতিষ্ঠিত হইয়া গেলো এবং খুব সুনাম, সেই সময় রাতের বেলা কেরোসিন তেল ঢাইলা, লাঠিয়াল বাহিনী পাঠাইয়া পোড়াইয়া দিল স্কুল। টোটাল পোড়াইয়া দিলো, একটা কাগজও ছিলো না। এইটা ১৯৩০-এর দিকের ঘটনা। তখন আবার ওই দুই বৃদ্ধ ভিক্ষায় নামল। তাদের যা ছিলো সব বিক্রি করলো। এবং তারা এইবার তাদের নিজেদের ঘর ভাইঙ্গা দিলো। দুইজনই নিজেদের ঘর ভাইঙ্গা স্কুলঘর বানাইলো আবার, আর ভিক্ষা করলো। বহু লোক তাদের টাকা দিলো। দ্বিতীয়বার তৈরি করার পরে আমি ভর্তি হইলাম। জমিদারের এই রকম নির্যাতনের মধ্যে ছিলাম আমরা। এইখানে কোনো হিন্দু-মোসলমান নাই, এইটা নির্যাতনের প্রশ্ন।
জমিদারদের সাথে আমাদেরও ঝামেলা ছিলো। আমরা পরে 'চৌধুরী' হইছি, আগে তো ছিলাম 'মিয়া', তারও আগে ভূঁইয়া। আমাদের পূর্বপুরুষ গমীরউদ্দিনের নাম জানা যায়। সে ঢাকায় ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তরে কাজ করতো, কেরানিগিরি। তার একটা অ্যাডভান্টেজ হইলো সে যেহেতু ওইখানে কাজ করে এবং রেভিনিউ বিভাগে কাজ করে—রেভিনিউ বিভাগের নাম ছিলো তখন 'সেরেস্তা'। তো, সেরেস্তায় যারা কাজ করে তাদের প্রমোশন-ট্রমোশন হয়।–একসময়, প্রমোশন হইয়া বা সেরেস্তায় তার উপরের লোকজন মারা-টারা গেলে সেরেস্তাদার হইয়া গেলো। সেই সময় আমাদের তালুকদারি বা জমিদারি যা-ই বলি, শুরু।
তখন 'সূর্যাস্ত আইন' চালু ছিলো। খাজনা দেবার সময় যেদিন শেষ সেইদিন সূর্যাস্তের মধ্যে খাজনা না দিলে সেই জমিদারি বা তালুক মালিকের হাতছাড়া হইয়া যাইতো। তারপর সেই জমি নিলাম হইতো। গমীরউদ্দিন এইরকম নিলামে বেশ কিছু তালুক কিনছিলো। অনেক সময় জমিদারদের লোককে ঘুষ দিয়াও খাজনা দিতে দেরি করাইতো। জমিদাররা টেরই পায় না। জমিদাররা তো কোলকাতায়। জমিদারি থেইকা খাজনা নিয়া, টাকা-পয়সা কোলকাতা নিয়া যাইতো। কোলকাতায় বাড়ি-ঘর করছে, কিন্তু নিজের এলাকায় একটা প্রাইমারি স্কুলও করে নাই। পোলাপান সবাই কোলকাতায় পড়ে। আমার দাদাও কোনো স্কুল করে নাই। সে খালি ছোট মাদ্রাসা করছে গ্রামে। সেই মাদ্রাসায়ই আমরা আরবী পড়ছি, কিছু বাংলাও পড়ানো হইতো অবশ্য, আগেই বলছি। তো, ঘুষ নিয়া জমিদারের পেয়াদারা ডেটটা এক্সপায়ার কইরা দিতো। তারপর যারা এর পিছনে আছে, ঘুষ দিছে, তারা নিলামে সেই জমি কিনা নিতো। এইভাবে অনেক জমি ঢাকা থেকে যখন কেনা হইতো তখন ক্ল্যাশ করতো অথবা জমিদাররা চাইতো না কোনো জমি অন্য কেউ কিনুক। কেউ কিনলে তার উপর চাপ দিতো যে তুমি আমার কাছে পুনরায় বিক্রি কইরা দাও। আমরা অনেক চাপে ছিলাম এই রকম ভাবে।
আমি তখন জন্মগ্রহণ করি নাই, আমার দাদায় তখন জমিজমা দেখাশুনা করে, বাপ-চাচারা লেখাপড়া করে। আমার দাদার নাম চান মিয়া। উত্তরাধিকারসূত্রে অনেক কিছু পাইছে, নিজে করছে, সেইজন্য লোকে বলতো 'চান্দের মতো কপাল'। তাই তার নাম হয় চান মিয়া। উনি হঠাৎ কইরা জমিদারির গায়ে গায়ে একটা তালুক কিনা ফালাইলো। তখন গণ্ডগোল লাইগা গেলো। সেই জমি জমিদার আমাদের দখল করতে দেয় নাই, ঢুকতেই দেয় নাই। এইটার মধ্যে আম বাগান ছিলো দুইটা, খালের পাড়ে। সেই বাগান শেষ পর্যন্ত ঘুরতে ঘুরতে আমার নামে আসলো, আমি তখন স্কুলে পড়ি। কিন্তু ওই আম বাগান থেকে আমরা আম খাইতে পারতাম না। জমিদার যখন জানলো তখন বললো, দখল দেবো না। তালুকদারির মালিকানা আমাদের, সুতরাং খালের পাড়ের আম বাগান আমাদের কিন্তু জমিদার আমাদের দিবে না। দখল কইরা রাখছে। বলে, আসো, তোমাদের শায়েস্তা করব। সে কয় যে 'আমার কাছে বিক্রি করো।' এইভাবে লাগতো ঝগড়া। এবং আমরা বিক্রি করতাম না যখন তখন তার লাঠিয়াল দিয়া আমাদের বাড়ির লোকজনকে ওইখান থিকা তাড়াইয়া দিতো। আম তারাই খাইতো। শেষে রেওয়াজ বদল করে জমিদারের সঙ্গে মীমাংসা করা হইল। সেই দুইটা আমবাগান ছাইড়া দিয়া আমাদের এলাকায় জমিদারের দুইটা বড় চাষের জমি আমরা নিছিলাম, উপায় তো নাই। এত কোনো ক্ষতি হয় নাই বিশেষ, কিন্তু প্রেস্টিজের প্রশ্ন! নাইলে মারামারি করতে হয়, লাঠিয়ালরা মাথা ফাটাইয়া দিতো, এগুলা তখন কালচারের অংশ ছিলো—মাথা ফাটাইয়া দেওয়া।
শ্রীনগরের জমিদার ছিলো হিন্দু। হেমেন্দ্রকুমার। তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপ ছিলো। হিন্দু-মোসলমান সবারই। জমিদার বাড়ির সামনে দিয়া যাওয়ার সময় দুইটা কাজ করা যাইতো না। একটা হইলো—জুতা পায়ে দিয়া যাওয়া যাবে না, আরেকটা—ছাতা মাথায় যাওয়া যাবে না। জুতা খুইলা হাতে নিয়া যাইতে হবে আর ছাতা বন্ধ কইরা যাইতে হবে। কিন্তু আমাদের গ্রামে হিন্দুপাড়া আছিলো। তাদের সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক ছিলো। আমি যাইতাম, খাইতাম। একসাথে স্কুলে যাইতাম, আমার অনেক হিন্দু বন্ধু আছিলো। কিন্তু হিন্দু বা মোসলমান—কোনো মেয়েবন্ধু ছিলো না। আমাদের স্কুল বয়েজ স্কুল। মেয়েদের কোনো স্কুল নাই। তখনো মেয়েদের পড়ালেখা শুরু হয় নাই। আমাদের বাড়িতে কিছু লেখাপড়া করছে আমার বোনেরা, তাও আরবী পড়া, তারপরে অল্প কিছু বাংলা। কিছু চিঠিপত্র লেখা, বাজারের লিস্টি লেখা, একটু হিসাব করতে যাতে পারে সেইজন্য কিছু কিছু পড়ানো হইতো। মাস্টার রাইখা আর আমার বাবায় বোনদের কিছু পড়াইছিলো।
পাশের গ্রামের এক হিন্দু ডাক্তার আছিলো আমাদের পারিবারিক ডাক্তার। তার নাম ডা. বর্ধন। খুব মোটা-সোটা লোক ছিলেন তিনি। একটা ঘোড়া আছিলো তাঁর, ঘোড়ায় চইড়া রোগী দেখতে যাইতেন। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি কোথাও রোগী দেখতে আসলে আমাদের বাড়িতে আসতেন, বাবার সাথে গল্প করতেন। আমরা তারে চা খাওয়াইতাম। তার ছেলে ছিলো—ঠিক মনে নাই সম্ভবত হেমন্ত বর্ধন। সে ছিলো আমার বন্ধু। পরে ন্যাশনাল থিকা ডাক্তার হইছিল। কংগ্রেসের রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় উপমহাদেশের লক্ষ লক্ষ ছাত্র যোগদান করছিল। এর মধ্যে মেডিকেল ছাত্র ছিল বহু। আন্দোলনের শেষে আর তারা তাদের পড়াশোনায় ফিরা যাইতে পারে নাই। ব্রিটিশ সরকার স্কুল-কলেজ থিকা তাদের নাম কাইটা দেয়। তখন স্থানীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে ঢাকা কোলকাতা বোম্বে ভারতময় বিভিন্ন জায়গায় কতগুলি মেডিকেল স্কুল হয়। সেই স্কুলগুলিতে কংগ্রেস করা ডাক্তাররা পড়াইতো। এগুলিরে 'ন্যাশনাল স্কুল' বলতো তখন। পরবর্তীতে এই ন্যাশনাল স্কুলগুলিরে রেকগনাইজ করা হয়। মিটফোর্ড কিন্তু তখন ভিন্ন স্কুল।ওইটা ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চলতো। ঢাকায় বাহাদুর শাহ পার্কের উল্টাদিকের গির্জার পাশে একটা বড় বিল্ডিংয়ে ন্যাশনাল স্কুল করা হইছিল। আমার সেই বন্ধু ন্যাশনাল স্কুল থিকা পাশ করে। পার্টিশনের পরে তারা আর ইন্ডিয়া যায় নাই। ঢাকায় থাইকা গেছিল। এবং ঢাকার বিখ্যত ডাক্তার এমএন নন্দীর অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজে যোগদান করে সে। আমার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল আরো বহুদিন। পার্টিশনের পরে একবার বর্ষাকালে তার বিয়েতে গ্রামেও গেছিলাম। ১৯৭১ সালের মে মাসে যখন বিক্রমপুর থিকা ৭/৮ জন সহ কোলকাতায় রওনা দেই আমরা তখন হেমন্ত তার স্ত্রী ও এক ছেলে এক মেয়েকে আমাদের সাথে দিয়ে দেয়। আমরা আগরতলা হয়ে কোলকাতায় যাই। হেমন্ত পরে কোলকাতায় তার স্ত্রী ছেলেমেয়ের সাথে দেখা করে। হেমন্তের স্ত্রী আর ফিরা আসে নাই। কিন্তু ডা. নন্দীর মৃত্যুর পরেও সে কিছুদিন ঢাকায় প্র্যাকটিস করতো। পরে কোলকাতা চইলা যায় এবং ওইখানেই মারা যায়।
তো, সেই সময় ঘোড়া ছিলো। আমি ঘোড়ায় চড়ছি বহুবার। ঘোড়া ব্যবহার করা হইতো বোঝা বওয়ার কাজে, মেইনলি। কমিউনিকেশন বলতে ছিলো নৌকা। কিন্তু শুকনার সিজনের ছয়মাস তো সব জায়গায় নৌকায় যাওয়া যায় না। পানি নাই। অনেক ব্যবসায়ী আছিলো যারা এক বাজার থেকে আরেক বাজারে মালপত্র নিয়া যাইতো ব্যবসা করতে। সপ্তায় হয়তো চারটা/পাঁচটা বাজারে যায় তারা। তখন কুলিদের দিয়া বা ঘোড়ায় কইরা মালপত্র নিয়া যাইতো।
সম্পাদনা: রেজাউল করিম
খণ্ডিত জীবন: (কিস্তি ৩)
লেখকের আর্টস প্রোফাইল: ফয়েজ আহমদ
ইমেইল: [email protected]
—
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts