খণ্ডিত জীবন (কিস্তি ৬)

ফয়েজ আহমেদ
Published : 17 Sept 2011, 01:31 PM
Updated : 17 Sept 2011, 01:31 PM

(কিস্তি ৫-এর পরে)

আমার স্কুল লাইফে একটা গ্রামীণ জীবন ছিলো আমাদের বিক্রমপুরে। আমাদের এই গ্রামীণ জীবনে বর্ষার সিজন ছিলো অনেকটা অভিশাপের মতো, বিশেষ কইরা চলাফেরার বেলায়। আবার বর্ষা না হইলে ধানও হইবে না! এতো বৃষ্টি হইতো কোন কোন বছর যে ধানও নষ্ট হইয়া যাইতো। তবে সাধারণভাবেই অনেক বৃষ্টি হইতো। বৃষ্টির পানির সাথে পাল্লা দিয়া ধান গাছও বড়ো হইতে থাকতো। এক বারে অনেক বৃষ্টি হইলেই খালি ধান গাছ লগে লগে বাড়ার সময় পাইতো না; তখন ধান নষ্ট হইতো। বৃষ্টির সিজনের চার-ছয় মাস পুরা বিক্রমপুরই কয়েক হাত পানির নিচে চইলা যাইতো। বাড়িগুলা খালি ছোট ছোট দ্বীপের মতো জাইগা থাকতো।


শিশুদের সাথে ফয়েজ আহ্‌মদ, ১৯৫২-৫৪, ঢাকা বেতার-এর 'সবুজের মেলা' অনুষ্ঠানে

আমাদের কাছেই পদ্মা নদী। পদ্মায় বহু বাড়িঘর খাইয়া ফেলতো। বর্ষার সিজনে ভাঙন আরো বাইড়া যাইতো। একদিকে ভাঙতো অন্যদিকে চরও পড়তো। কতো মানুষ ঘরবাড়ি হারাইয়া ঢাকার দিকে আইসা পড়তো! বহু মানুষ চরেও বাড়ি-ঘর বানাইয়া থাকতো। পদ্মা ইন্টারেস্টিং নদী। একদিকে মাইনষের সব খাইতো, আবার পদ্মার ইলিশের কোন শুমার আছিলো না। জেলেরা ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের নৌকায় পদ্মায় জাল ফালাইতো। ইলিশের জাল। ইলিশের নৌকায় গেছি আমি। ইলিশের জালের নিচের দিকে ইটের টুকরা, পাথর বাইন্ধা নদীতে ফালাইতো। আর উপরের দিকে থাকতো পানির চাইতে হালকা বিভিন্ন জিনিস, ভাসাইয়া রাখার জন্য। উজানের দিক দিয়া পানি নামতেছে সাগরের দিকে, আর ইলিশের ঝাঁক সাগরের দিক দিয়া আসতেছে। ডিম ছাড়তে ছাড়তে আসে। ইলিশ চলে স্রোতের উল্টা দিকে। ইলিশ মাছ এতো সুন্দর আর নিরীহ! টেস্টেও অন্য মাছের লগে ইলিশের কোন মিল নাই। ইলিশের কোন বদনাম নাই; কাউরে কামড়ায় না, গুতা দেয় না। মানুষ নদীতে নামলেও কিছু করে না। জালে ধরা পইড়া যায়, আর মানুষ খাইয়া ফালায়। খাইবে না ক্যান? ইলিশের টেস্ট আর ঘ্রাণের তো কোন তুলনা নাই। আমাদের বিক্রমপুরে মাছ বলতেই ইলিশের নাম আইসা পড়তো।

বর্ষার সিজনে ইলিশ পড়তো বেশি। ইলিশ খাওয়া যাইতো, কিন্তু আমাদের গ্রামীণ জীবনে বর্ষায় আর কিছু করার থাকতো না। স্কুলে যাওয়াও খুব কঠিন হইয়া যাইতো। তখন রাস্তাঘাট ছিলো না বেশি, কোন পাকা রাস্তা নাই। গরু-মহিষের চলাচলের কারণে রাস্তায় কাদা হইতো অনেক। বর্ষায় আমরা ঘরের মধ্যে আটকা পইড়া থাকতাম বেশিরভাগ সময়। প্রায় ছয় মাস কোন আনন্দ-ফূর্তি করা যাইতো না।

বর্ষার সিজনের শেষে, শুকনার দিনে গ্রামে বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুরু হইতো। চলতো মোটামুটি আরেক বর্ষার শুরু পর্যন্ত—বৈশাখী মেলা পর্যন্ত। গ্রামে বিয়া-শাদী হইতো শুকনার সিজনে। বিয়ায় গান-বাজনা হইতো। আর হইতো যাত্রা। আমি রেগুলার যাইতাম, পালাইয়া! আমগো বাড়ির কালচারে যাওয়া নিষিদ্ধ। এইগুলা ছিলো ছোটলোকের–যাত্রা, গুণাইবিবি, গাজীর গান ইত্যাদি। আমগো বাড়িতে মনে করা হইতো এইগুলা নিচু শ্রেণীর লোকের আনন্দ-আমোদের কালচার। তাই পোলাপানের যাওয়া ছিলো নিষিদ্ধ। ফলে আমাদের বাড়ির ছেলেরা বা আমাদের পাশের ভূঁইয়া বাড়ির ছেলেরা—আমরা যাইতে পারতাম না। মেয়েদের তো প্রশ্নই ওঠে না। তবুও আমরা গোপনে যেতাম আসরে—সংস্কৃতির প্রসার এভাবেই হয়ে থাকে।

৪০-এর গোড়ার দিকে একটা গান খুব ফেমাস হইয়া গেলো—গুণাইবিবি। গুণাইবিবি ফেমাস হবার কারণ ছিলো ওইটার মধ্যে সেক্স মিশ্রিত ছিলো। স্টেজে ওপেনলি কথাবার্তা কইতো সেক্স নিয়া। ওপেনলি বা ইনডাইরেক্টলি সেক্সের কথা কইতো, আর সবাই খুব আনন্দ পাইতো। যেমন হয়তো কইতো—ওরে গুণাই, তোরে লইয়া যামু আইজকা বন-জঙ্গলে, অমুক জায়গায়…। এই সমস্ত কথা-বার্তায় খুব উস্কানি লাগতো। গুণাইবিবি এইভাবে ফেমাস হইয়া গেলো। ছোটলোকরা গুণাইবিবি নিয়া আলাপ করতো, বড়োলোকরা আলাপ করে না, কিন্তু গোপনে যায়। মাথায় চাদর পেচাইয়া, নাক-মুখ ঢাইকা। এমন প্রবল হইলো গুণাইবিবি যে বিক্রমপুর, শ্রীপুর, ঢাকা জেলা, ফরিদপুর, গোয়ালন্দ, নারায়ণগঞ্জ, নরসংদি এলাকা—এই সমস্ত জায়গায় গুণাইবিবি প্রচলিত হইয়া গেলো। সেক্স আছে তো, অঙ্গভঙ্গিও খারাপভাবে করে। এইটা এমন জনপ্রিয় হইয়া গেলো কয়েক বছর যে এইটা প্রতিরোধ করার কর্মসূচী শুরু হইয়া গেলো। যুবক সমাজ নষ্ট হইয়া যাইতেছে, মুরুব্বিরা অ্যালাউ করতে পারে না।

গুণাইবিবি মুরুব্বিদের আতংক হইয়া উঠলো। তারপরে এর বিরুদ্ধে কিছু কিছু মোল্লা, মুরুব্বি দাঁড়াইলো যে সেক্স প্রকট হইয়া গেছে, এইটারে বন্ধ করা উচিত। কিন্তু মোল্লা-মুরুব্বিদের এই চেষ্টা তেমন কার্যকর হইতে পারে নাই। অথবা এমনো হইতে পারে যে কার্যকর হবার আগেই ৪২/৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ আইয়া পড়লো, দুর্ভিক্ষে এই আনন্দ কমতে আরম্ভ করে।

গুণাইবিবি বা অন্যান্য পালায় মাইয়াদের পাট আছিলো কিন্তু কোন সত্যিকার মাইয়া ছিলো না। পোলারা মাইয়া সাইজা অভিনয় করতো, মাইয়াদের অঙ্গভঙ্গি করতো। যাত্রার অভিনয়ে মাইয়া আসে অনেক পরে। তবে হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান করার কিছু দলে দুই একটা মেয়ে ছিলো, নিতাই-গোবিন্দ ইত্যাদি করতো তারা–বাড়িতে যাইয়া যাইয়া গান বাজনা করতো।

এছাড়াও দুর্ভিক্ষের আগে পরে বিক্রমপুরের কিছু কালচারাল দিক ছিলো—সঙ্গীত, একক নৃত্য এবং নাটক। বৈরাগীরা একক নৃত্য করতো প্রধানত। তারা বাড়ি বাড়ি যাইতো। চাল টাল দিয়া তাদের সাহায্য করতো। বাড়ির মহিলারাও বেড়ার ফাক দিয়া দেখতো সেগুলা। বৈরাগীরা অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী দুইজনে আসতো। বৈরাগীরা ছিলো অশিক্ষিত, নিচু শ্রেণীর। তাদের আমন্ত্রণ কইরা নিয়া যাওয়া হইতো। আবার নাটকের ডাইরেক্টর ভাড়া কইরা নেওয়া হইতো। তারা যাইয়া স্থানীয়দের দিয়া নাটক করাইতো। বিশেষ কইরা নাটকটা আমাদের বিক্রমপুরের উপজীব্য হইয়া দাঁড়াইলো।

আমি তখন ক্লাস নাইন এবং টেন-এ পড়ি। আমার জীবনের এই দুই বছর নাটক লাইনে গেছে। এই বিষয়ে আমার বাড়ির তেমন আপত্তি করতো না। কিন্তু এক ধরনের নজর রাখতো যাতে কিনা আমি খারাপ দিকে না যাই।

আমাদের এই নাটক হইতো শ্রীনগর বাজারে। বাজারের মালিক ছিলো বাবুরা–হিন্দু। ছোটলোকদের লেখাপড়া করতে দেয় না, বড়োলোক ছাড়া চিনে না—তাদের এক কথায় বলা হয় বাবু। বাবুরা দুইটা বড়ো বড়ো অনুষ্ঠান করতো। একটা 'দুর্গাপুজা', আরেকটা হইলো 'রথযাত্রা'। আরেকটা ছিলো স্বরস্বতী পুজা। স্বরস্বতী পুজা হইতো স্কুলগুলায়। এইগুলা হাটে বাজারে হইতো না। দুর্গাপুজা হইতো সাত দিন ধইরা, বাজারের একটা অংশে। গান-বাজনা, নাচ ইত্যাদি হইতো। টিকিট নিয়া এইগুলা দেখাইতো।

দুর্গাপুজা আর রথযাত্রার অনুষ্ঠান হইতো বিরাট কইরা। এইখানে আমরা নাটক করতাম। নাটক করার জন্য বাইরে থেকে অভিজ্ঞ লোক আনতাম আমরা, টাকা দিয়া। এই লোক পেশাদার, অভিজ্ঞ অভিনেতা এবং ডাইরেক্টর। টিকিট দিয়া এই নাটক দেখানো হইতো। আমাদের এই দলের প্রায় সবাই ছিলো হিন্দু। মোসলমানদের ভিতরে আমি-ই উৎসাহিত বেশি ছিলাম। আমি একমাত্র মুসলিম, পরে আরো দুই একজন হইছিলো। আমরা করতাম 'সিরাজউদ্দৌলা', 'টিপু সুলতান', 'রায়চাঁদ-কেদারচাঁদ' নাটক। আমি লোকজন ডাকি, চাঁদা উঠাই, আমি খুব উৎসাহী। কিন্তু আমি সবচেয়ে বয়োঃকনিষ্ঠ। আমারে ছোটখাট কোন পাট দিতো। যেমন, 'সিরাজউদ্দৌলা' নাটকে ষড়যন্ত্র হইতাছে, ক্লাইভ পার্টি দিছে, খারাপ বাংলায় কথা কইতাছে, মিষ্টি খাওয়া চলতাছে। সেইখানে আমিও একজন ষড়যন্ত্রকারী। বইসা রইছি, মিষ্টি খাইতেছি–এই রকম ছিলো আমার পাট।

আমাদের দলে একজন ছিলো নাপিত, রিয়েল নাপিত। সে কইলো তারে পাট দিতে হবে। আমরা কইলাম টাকা উঠাইয়া দাও! সে ছয় টাকা উঠাইয়া দিছিলো। শ্রীনগর হাটে আরেকজন লোক ছিলো—মান্নান। মান্নান সাহেব করিৎকর্মা লোক, লোকজন চেনে, বাজারে মাতুব্বরি করে, বিচার-আচার করে, বাহাদুর মানুষ। তো সে একবার কইলো—আমারে পাট দিতে হবে। আমরা কইলাম—কেমনে করবেন, আপনে তো জানেন না কিছু! বললো—আমারে না নিলে নাটক হবে না। তখন আমরা রাজি হইলাম। সে কইলো যে আমি প্রম্পট করবো, প্রম্পটার হবে। মান্নান সাহেব তখন আড়ালে দাঁড়াইয়া আস্তে আস্তে ডায়লগ বলে। আর মঞ্চের মেইন অ্যাক্টর সেইটা শুইনা মূল ডায়লগ দেয়। মেইন অ্যাক্টর একবার পরের ডায়লগ ভুলে আগে দিয়া দিলো। মান্নান সাহেব তো খুঁইজা পায় না! তখন নির্দিষ্ট অংশ না পইড়া আরেক অংশে চইলা গেলো। শুইনা তো মেইন অ্যাক্টর কিছু কয় না, চুপ কইরা রইছে। মান্নান সাহেব গেলো ঘাবড়াইয়া! তখন উল্টাপাল্টা কইতে কইতে মাথা ঢুকাইয়া দিলো মঞ্চের ভিতরে। নাটক বন্ধ হইয়া যায় প্রায়। আমরা টানাটানি কইরা মান্নান সাহেবরে সরাইতে পারি না! তাড়াতাড়ি কইরা পর্দা ফালাইয়া দিলাম!

আরেকবার পুরাতন জমিদার বাড়িতে নাটক করতেছি আমরা। মান্নান সাহেবের দায়িত্ব ছিলো বোমা ফুটানোর। যুদ্ধের সিন ছিলো সেইটা। মার মার কইরা আক্রমণ-ণ-ণ বইলা চিৎকার দিবে। কিন্তু তার আগে দুই একটা বোমা ফাটানো দরকার, শব্দ করতে হবে। পুরান জমিদার বাড়ির দেয়াল, জাগায় জাগায় ভাঙ্গা। আমরা পর্দা দিয়া নিছি। এই দেয়ালটা ছিলো স্টেজের পিছনের দিক। পিছনে আলো রাখা যাবে না, তাইলে স্টেজের সামনে থেইকা পিছনের লোক দেখা যাবে। কোন জাগায় দেওয়াল আছে আর কোথায় ফাকা বোঝার উপায় নাই অন্ধকারে। সেই কারণে মান্নান সাহেবরে কইয়া দিছে দেওয়ালে হাত দিয়া রাখেন, বোমা মারার আগে হাত সরাইয়া নেবেন। কিন্তু মান্নান সাহেব এইগুলা গেছে ভুইলা। সে বোমা মারতেছে, কিন্তু বোমা ফাটে না! দেওয়ালের ফাক দিয়া চইলা যায় স্টেজে! তার আর হুশ নাই। ওদিকে ডায়লগ দিয়া দিছে, কিন্ত বোমা ফাটে না, যুদ্ধও শুরু করা যাইতেছে না! অ্যাক্টররা খাড়াইয়া আছে! মান্নান সাহেবের হুশ নাই, পর্দার ওইপাশে মাথা বাইর কইরা দেয়! এই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় মান্নান সাহেবকে আমরা স্টেজের দিক থেকে টাইনা রাখলাম। আর সবাই বলতে থাকলাম—মাথা বাইর হইয়া গেছে, মাথা বাইর হইয়া গেছে। পরে মোমবাতি জ্বালাইয়া বোমা মারা হইছে। এই সব ঘটছে সেই সময়, আমাদের নাটকে।

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: ফয়েজ আহমদ
ইমেইল: artsbdnews24@gmail.com

ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts