Published : 25 Jun 2024, 01:29 AM
সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি বাংলাদেশ রেইস অ্যাসেট ম্যানেজেমেন্ট পিসিএল এর সব বিও অ্যাকাউন্টে লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে; একই সঙ্গে তাদের পরিচালনাধীন সব মিউচুয়াল ফান্ডের বিও অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ নিতে সংশ্লিষ্ট ট্রাস্টিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সোমবার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এক আদেশে এসব নির্দেশনা দেন।
আদেশে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর ট্রাস্টিকে এসব বিও হিসাবের বিস্তারিত তথ্যও সাত দিনের মধ্যে বিএসইসিতে প্রতিবেদন আকারে জমা দিতে বলা হয়েছে।
পাশাপাশি মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর কাস্টডিয়ানকে রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের পরিচালনায় থাকা অননুমোদিত বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে সেগুলোতে থাকা সব শেয়ার সাত দিনের মধ্যে অনুমোদিত বিও অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করতে হবে।
রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনার বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ফান্ড ব্যবস্থাপনায় রেইসের ‘কাস্টডিয়ান’ শর্ত ভঙ্গের অভিযোগে এমন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে বিএসইসির আদেশে।
নির্দেশনার বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনা ইস্যুতে রেইসের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান দল কাজ করছে। তাদের সুপারিশে বিও হিসাবগুলো পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।’’
রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট এবং তার অধীনে পরিচালিত সব মিউচুয়াল ফান্ডের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিতের খবরের মধ্যে এবার বিও অ্যাকাউন্টে লেনদেন স্থগিতের আদেশ এল।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গত ১০ জুন এক নির্দেশনায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ৯ জুলাই পর্যন্ত ৩০ দিনের জন্য এসব ব্যাংক হিসাব স্থগিতের আদেশ দেয় বলে খবরে এসেছে।
বর্তমানে ১২টি মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনাকারী রেইস অ্যাসেট ম্যানজেমেন্ট কোম্পানি যাত্রা শুরু করে ২০০৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। মেয়াদী ও বেমেয়াদী এসব ফান্ডের আকার আড়াই হাজার কোটি টাকার মত।
অন্যতম বৃহৎ এ সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি দেড় দশক পার করলেও এটির অধীনে পরিচালিত মেয়াদী ও বেমেয়াদী ফান্ডগুলোর বিনিয়োগকারীরা আশানুরূপ মুনাফা পাচ্ছেন না। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ থেকে কাঙ্খিত মুনাফা না হওয়ায় এটির পরিচালনা নিয়ে অনেক দিন থেকেই নানা কথা তুলেছেন বিনিয়োগকারীরা।
ঝুঁকিপূর্ণ খাতে রেইসের বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি বলে খবরও প্রকাশিত হয় আগে। এর পুরোটাই বিনিয়োগ করা হয়েছে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানিতে, যেখান থেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা।
ডুবতে বসা ফারমার্স ব্যাংকে ৭০ কোটি ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগের পাশাপাশি রেইস একটি স্টক ব্রোকারেজ কোম্পানি ও বিভিন্ন সিকিউরিটিজে বড় অংকের অর্থ খাটিয়েছে, যার পরিমাণ অন্তত ৮৭ কোটি টাকা। রেইসের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের তালিকায় বেস্ট হোল্ডিংয়ের কনভার্টিবল বন্ডও (বিএফআইএসপিভি) রয়েছে। এই নন লিস্টেড বন্ডে রেইস লগ্নি করেছে ২৫০ কোটি টাকা বলে আগে খবরে এসেছে।
তালিকাভুক্ত নয় এমন কিছু কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে; যেগুলো থেকে ঠিকঠাক মনুফার বদলে লোকসানের মুখে পড়তে হয় বিনিয়োগকারীদের। এসব বিনিয়োগের মধ্যে ফারর্মার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) শেয়ারে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ নিয়েও সমালোচনা হয়।
পরে ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবতে থাকা ফারর্মার্স ব্যাংক পুর্নগঠনের অংশ হিসেবে নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক হয়। অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে ২০১৭ সালে। রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে রেইস গ্রুপের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত এটির চেয়ারম্যান হন। ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করা ব্যাংকটি ২০১৯ সালে পদ্মা ব্যাংকে রূপ নেয়।
আর ‘পদ্মা’ নামে যাত্রা শুরুর পাঁচ বছর পর চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। এতদিনেও ব্যাংকটির অবস্থার বদল ঘটেনি। অনিয়মে ডুবতে থাকা লোকসানি ব্যাংকটির অবস্থার বদল না হলে সবশেষ চলতি বছর তা এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
রেইস গ্রুপের ওয়েবসাইটে চেয়ারম্যান হিসেবে এখন নাফিজ সরাফতের নাম নেই। রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের পরিচালকদের তথ্যও নেই সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে।
দীর্ঘদিন নাফিজ সরাফতের নেত্বত্বে পরিচালিত রেইস গ্রুপের রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের বিষয়ে তদন্তে নেমে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিটির বিও অ্যাকাউন্ট ও লিংক অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে অনিয়ম দেখতে পায় তদন্ত কমিটি।
সোমবার এসব বিও অ্যাকাউন্টে রেইসের লেনদেন স্থগিতের বিষয়ে বিএসইসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত আদেশে বলা হয়, মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপায় কাস্টডিয়ান শর্ত ভঙ্গ করে রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বিভিন্ন ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানে বিও খুলেছে বা বিওআইডি ‘লিংকড’ করেছে বা ‘মাদার’ অ্যাকাউন্টের সঙ্গে সংযোগ করেছে। এগুলোর মধ্যে মাল্টি সিকিউরিটিজ সার্ভিসেস, দি স্মার্ট ট্রেড লিমিটেড ও ট্রাস্ট ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেড অন্যতম।
এভাবে বিধিমালা ভঙ্গ করায় বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ না হওয়ার কথা তুলে ধরে আদেশে বলা হয়, ‘‘বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় এ আদেশ দেওয়া হল।’’
বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল করিমও মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনা ইস্যুতে রেইসের বিষয়ে অনুসন্ধান দলের কাজ করা এবং তাদের সুপারিশে এমন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন।
তবে এ বিষয়ে রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘রেইস পরিচালিত সব ফান্ডের শেয়ার কাস্টডিয়ান ব্র্যাক ব্যাংক ও আইসিবি’র ডিপি হিসাবে আছে। সিডিবিএল এর সঙ্গে চেক (যাচাই) করলে শতভাগ শেয়ারই যথাযথ অবস্থায় পাওয়া যাবে। শেয়ার লেনদেনের তথ্য সংরক্ষণ করা আছে।’’
কোনো শেয়ারের সংখ্যায় গড়মিল বা ভিন্ন কোথাও নেই দাবি করে তিনি বলেন, ‘‘প্রতিটি মিউচুয়াল ফান্ডের আলাদা আলাদা ওয়েবসআট আছে। সেখানে গেলেও সব শেয়ারের তথ্য পাওয়া যাবে। সবশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে শেয়ারের তথ্য দেয়া আছে। আমরা বিনিয়োগকারীদের এ বিষয়ে আগামীকাল(মঙ্গলবার) একটি বিবৃতি দিব।’’
রেইস পরিচালিত ১২টি মিউচুয়াল ফান্ডের কাস্টডিয়ান ব্র্যাক ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ কোম্পানি ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। এসব ফান্ডের মোট আকার আড়াই হাজার কোটি টাকার মত। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভূক্ত ৩৭টি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ১০টির পরিচালনা করছে রেইস।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ এন্ড কমিশনে মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিধিমালা ২০০১ অনুযায়ী, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের অধীনে কেনা শেয়ার কাস্টডিয়ানের ডিপিতে (ডিপজটরি পার্টিসিপেন্ট) থাকে।
মিউচ্যুয়াল ফান্ড যখন কোনো ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শেয়ার ক্রয় করে তখন সিডিবিএল এর সেটেলমেন্টের জন্য ব্রোকারের ডিপি থেকে শেয়ারগুলো ওই ফান্ডের কাস্টডিয়ানের ডিপিতে পাঠানো হয়।
একই ভাবে মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিক্রি করলে সিডিবিএল এর সেটেলমেন্টের জন্য কাস্টডিয়ানের ডিপি থেকে শেয়ারগুলো ফান্ডের ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের ডিপিতে পাঠানো হয়। এভাবেই সিডিবিএল মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে শেয়ার হস্তান্তর প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়।
সোমবার কমিশনের আদেশে একই সঙ্গে রেইস পরিচালিত ফান্ডগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে তাদের পদক্ষেপ ও কমপ্লায়েন্সে প্রতিবেদন আকারে ১০ দিনের মধ্যে জমা দিতে বলেছে।
আরও পড়ুন:
বিনিয়োগকারীদের টাকা রেইস লগ্নি করেছে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে: বিশ্লেষক
পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ 'ছাড়লেন' নাফিজ সরাফাত
ফারমার্স ব্যাংক এখন পদ্মা ব্যাংক
পাল্টাপাল্টি অভিযোগে আলোচনায় পদ্মা ব্যাংক, 'খতিয়ে দেখবে' বিএসইসি
এমওইউ: পদ্মার পরিচালক থাকবে না এক্সিমে, যাবে না কারো চাকরি
পদ্মা ব্যাংক অধিগ্রহণের তথ্য বিনিয়োগকারীদের জানাল এক্সিম ব্যাংক
পদ্মা ব্যাংক অধিগ্রহণ করে এক্সিম ব্যাংকের কী লাভ
দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক একীভূত হচ্ছে এক্সিমে
রেইসের ১০ ফান্ডের দরই অভিহিত মূল্যের অর্ধেকের নিচে
বেস্ট হোল্ডিংস: 'না জানিয়েই' সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইস্যু ম্যানেজার