বিদ্যমান নিয়ম এড়িয়ে সরাসরি তালিকাভুক্তির (ডিরেক্ট লিস্টিং) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে এসে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা তুলতে চাওয়ার প্রক্রিয়ায় একের পর এক অনিয়মের ঘটনা বের হচ্ছে ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেল লো মেরিডিয়ানের পরিচালনাকারী কোম্পানি বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডকে নিয়ে।
Published : 19 Dec 2020, 05:40 PM
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বেস্ট হোল্ডিংসের সরাসরি তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া থামানোর পর বিতর্কের মুখে অর্থমন্ত্রীর একটি চিঠি স্থগিত করা হয়। এখন বেস্ট হোল্ডিংসের প্রসপেক্টাসে ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে নাম থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট থেকে বলা হচ্ছে, তারা এ বিষয়ে ‘কিছুই জানে না’।
বেস্ট হোল্ডিংসের প্রসপেক্টাসে ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে আইসিবির পাশাপাশি রয়েছে চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের কোম্পানি রেইস পোর্টফোলিও অ্যান্ড ইস্যু ম্যানেজমেন্টের নাম।
পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাফিজ সরাফাত কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। সম্প্রতি তিনি গণমাধ্যমেও বিনিয়োগ করেছেন এবং একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হয়েছেন।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি কোম্পানির প্রাপ্য সুবিধায় বেসরকারি বেস্ট হোল্ডিংসকে স্টক এক্সচেঞ্জে সরাসরি তালিকাভুক্ত করে ‘প্রভাবশালী একটি মহল’ বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছিল, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্রুত হস্তক্ষেপে থামানো গেছে।
আর যে কৌশলে বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড সরাসরি তালিকাভুক্ত হতে চেয়েছিল, তাতে ‘সীমাহীন জোচ্চুরির’ ঝুঁকি দেখতে পাওয়ার কথা বলেছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি।
গত ১৫ ডিসেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মহাব্যবস্থাপক ও কোম্পানি সচিব আসাদুর রহমান স্বাক্ষরিত পর্ষদ সভার এজেন্ডার একটি চিঠিতে বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের একটি সংক্ষিপ্ত প্রসপেক্টাস দেওয়া হয়। ওই চিঠি শুধু পরিচালকদেরই পাঠানো হয়েছে।
প্রসপেক্টাসে ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের নাম থাকলেও সরকারি এই মার্চেন্ট ব্যাংক বলছে, তাদের সাথে এ ধরনের কোনো চুক্তি হয়নি ওই কোম্পানির।
আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শুক্লা দাস শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সাথে বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের কোনো ধরনের চুক্তি হয়নি। আমরা তাদের ইস্যু ম্যানেজার না।
“আমরা গতকাল গণমাধ্যমে আসা খবর থেকে বিষয়টি প্রথম জানি যে, আমাদের নাম বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে এসেছে। পরে আমরা এ বিষয়ে একটি পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠিয়েছি।”
শুক্লা দাস বলেন, “সাধারণ নিয়মে আমাদেরকে ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে পেতে হলে, আবেদন করার পরে যাচাই বাছাই হবে এবং সর্বশেষ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের সাথে আমাদের সেরকম কিছুই হয়নি।”
একজন মার্চেন্ট ব্যাংকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড যদি ইস্যু ম্যানেজার নিয়ে মিথ্যাচার করে থাকে, তাহলে তাদেরকে ইস্যু ম্যানেজার সাথে চুক্তি জাল করতে হয়েছে। এতে তারা একটি ফৌজদারি অপরাধ করেছে।”
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বেস্ট হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিন আহমেদের মোবাইলে কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। সংশ্লিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চেয়ে টেক্সট মেসেজ পাঠানো হলেও জবাব আসেনি।
এই ‘মিথ্যাচারে’ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জেরও (ডিএসই) দায় দেখছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি।
তাদের একজন বলেন, “সংক্ষিপ্ত প্রসপেক্টাস বোর্ড মিটিং এ তোলার আগেই ডিএসইর এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা না করায় প্রমাণ হয় যে, ডিএসই কর্তৃপক্ষ এই বিষয়টি নিয়ে আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলেনি অথবা বিষয়টি গোপনে সারতে চেয়েছে।”
ডিএসইর সাবেক একজন পরিচালক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হলে কোম্পানির প্রসপেক্টাস প্রকাশ করতে হয়। বিনিয়োগকারী সেখান থেকে কোম্পানির আর্থিক স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন। কিন্তু বেস্ট হোল্ডিংসের প্রসপেক্টাস কোথায়? কেন গোপন করা হচ্ছে?”
তিনি বলেন, “এই কোম্পানি তালিকাভুক্তির নেপথ্যে কাজ করছেন নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে দেখানো এক ব্যক্তি। আর তার সহযোগী হিসেবে আছেন ডিএসইর একজন পরিচালক।”
অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ইউনুসূর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডের বিষয়ে বিএসইসি থেকে আমাদের মানা করা হয়। এরপর বিষয়টি আর বোর্ড মিটিংয়ে ওঠেনি।
“আইপিও কমিটির রিপোর্ট এবং বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ যেসব খোঁজ খবর করেছে সেগুলো আর বোর্ডে ওঠেনি। আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানি না।”
বেস্ট হোল্ডিংস নিয়ম এড়িয়ে ডিএসইতে সরাসরি তালিকাভুক্তির (ডিরেক্ট লিস্টিং) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ২৮৩ কোটি টাকা তুলতে চাইলে কয়েকটি আইনি প্রশ্ন তুলে সেসব বিষয়ে ডিএসইর ব্যাখ্যা চায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বিএসইসি।
গত মঙ্গলবার ডিএসইকে পাঠানো বিএসইসির চিঠিতে বলা হয়, এসব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত বেস্ট হোল্ডিংসের তালিকাভুক্তির সব কার্যক্রম স্থগিত রাখতে হবে।
ডিরেক্ট লিস্টিং হল সেই পদ্ধতি, যেখানে একটি কোম্পানি তাদের পেইড-আপ ক্যাপিটাল না বাড়িয়ে এবং নতুন শেয়ার ইস্যু না করে সরাসরি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারে। এ নিয়মে ওই কোম্পানিকে তাদের হাতে থাকা শেয়ার পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করার সুযোগ দেওয়া হয়।
২০১৬ সালে বিএসইসির জারি করা এক নির্দেশনায় বলা হয়, দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কোনো বেসরকারি কোম্পানিকে সরাসরি তালিকাভুক্তির নিয়মে পুঁজিবাজারে আসার সুযোগ দিতে পারবে না। কেবল সরকারি কোম্পানি বা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানই সরাসরি তালিকাভুক্তির যোগ্য বিবেচিত হবে।
বেস্ট হোল্ডিংস তাদের মালিকানার ৭০ দশমিক ৪ শতাংশ বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানায় থাকার পরও সরাসরি তালিকাভুক্তির ওই সুযোগ নিতে চেয়েছিল।
বেস্ট হোল্ডিংসের ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের হাতে। এটাকেই যুক্তি হিসেবে দেখিয়ে তারা সরাসরি তালিকাভুক্তির ওই বিশেষ অনুমতি দাবি করে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপের পর নির্মাণ খাতের কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ দিতে নিয়ম শিথিলের সুপারিশ করে তিন মাস আগে অর্থমন্ত্রীর স্বাক্ষরে পাঠানো একটি চিঠির কার্যকারিতাও বিতর্কের মুখে স্থগিত করা হয়েছে।
ওই চিঠিকে অবলম্বন করেই নিয়ম এড়িয়ে সরাসরি তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদন করেছিল বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেড।