পাল্টাপাল্টি অভিযোগে আলোচনায় পদ্মা ব্যাংক, ‘খতিয়ে দেখবে’ বিএসইসি

সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং বর্তমান চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে ‘টাকা সরানোর’ পাল্টাপাল্টি অভিযোগে নতুন করে আলোচনায় এসেছে পদ্মা ব্যাংক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 March 2021, 01:34 PM
Updated : 13 March 2021, 03:45 AM

অভিযোগ পাওয়ার পর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বলেছে, বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখবে। 

অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবতে বসা ফারমার্স ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে ২০১৮ সালে। পরের বছর নাম বদলে হয় পদ্মা ব্যাংক।

ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর এখন বলছেন, বর্তমান চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ‘বিধি ভেঙে’ ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকা একটি তহবিলে বিনিয়োগ করেছেন।

পাল্টা অভিযোগে পদ্মা ব্যাংক বলেছে, চেয়ারম্যান থাকাকালে মহীউদ্দীন খান আলমগীরই ব্যাংকের টাকায় ‘নয়-ছয়’ করেছেন। 

দুই পক্ষই তাদের অভিযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানিয়ে প্রতিকার চেয়েছে।

নাফিজ সারাফাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের পাঠানো চিঠি হাতে পাওয়ার কথা জানিয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমরা তাকে ডাকব এবং তার বক্তব্য জানব। খতিয়ে দেখে পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাফিজ সরাফাত কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান।

নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ

পদ্মা ব্যাংকের স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর গত ৭ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি লিখে চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে তার অভিযোগের কথা তুলে ধরে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। 

চিঠির অনুলিপি অর্থমন্ত্রী, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনেও পাঠানো হয়।

সেখানে বলা হয়, ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর, মহীউদ্দীন খান আলমগীর যখন ব্যাংকের চেয়ারম্যান, তখন তার ‘অনুপস্থিতিতে’ ফারমার্স ব্যাংক পর্ষদের এক বৈঠকে একটি অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডে ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ অনুমোদন করা হয়।

সেই বৈঠকের একটি বোর্ড মোমোর ফটোকপি সম্প্রতি হাতে পাওয়ার পর ওই বিনিয়োগের বিষয়টি জানতে পেরেছেন বলে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ভাষ্য। 

তার চিঠিতে বলা হয়েছে, “আমি জানতে পেরেছি, চৌধুরী নাফিজ সরাফাত সে সময় অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান/এমডি হিসেবে বিনিয়োগের ওই অর্থ নেন। তাতে আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়, কারণ তিনি তখন ব্যাংকের একজন পরিচালক এবং আইন অনুযায়ী তিনি পরিচালক থাকা অবস্থায় ফারমার্স ব্যাংক থেকে কোনো তহবিল পেতে পারেন না।”

বাংলাদেশের ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের ২৭ এর ২ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যাংক এমন কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে পারবে না, যেখানে ব্যাংকটির কোনো পরিচালক যুক্ত থাকবেন পরিচালক বা পার্টনার হিসেবে।

আর তখনি ঋণ অনুমোদন করা যাবে, যখন বেশির ভাগ পরিচালক এর পক্ষে মত দেবেন। তবে যে পরিচালক সেই প্রতিষ্ঠানে আছেন, তার মতামত এখানে গ্রহণযোগ্য হবে না।     

মহীউদ্দীন খান আলমগীরের অভিযোগ, ওই ঋণ অনুমোদন করা হয়েছিল তার অনুপস্থিতিতে, তাকে না জানিয়ে।

চিঠিতে তিনি বলেছেন, সেই অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড থেকে এ পর্যন্ত কোনো লভ্যাংশ পদ্মা ব্যাংককে ‘দেওয়া হয়নি’, মূল টাকাও তারা ‘ফেরত দেয়নি’। 

“ওই তহবিল বেআইনিভাবে অনুমোদন করা হয়েছে এবং যেভাবে ব্যাংকের মূলধন থেকে ওই টাকা বিনিয়োগ বা সরানো হয়েছে, তাতে গুরুতর অনিয়ম ঘটেছে।”

বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি বিনিয়োগের ওই টাকা ব্যাংকে ফেরত আনার ব্যবস্থা নিতে আবেদন করা হয়েছে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের চিঠিতে।

এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের জবাবে মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, “এ ধরনের কাজের শাস্তি হওয়া উচিত। এখানে জনগণের টাকা লুট করা হয়েছে।”

এত দিন পরে কেন এই অভিযোগ করলেন- সেই প্রশ্নে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, “ব্যাংকের কতিপয় কর্মচারী মিলে বিষয়টি লুকিয়ে রেখেছিল। এখন বিষয়টি আমার হাতে এসেছে, তাই আমি জানিয়েছি।”

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ওয়েবসাইটে দেখা যায়, অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড অব বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনায় আছে স্ট্রাটেজিক ইকুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড। আর ট্রাস্টি হিসেবে আছে প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের পর্ষদে একজন স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে আছেন চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত, যিনি পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান নাফিজের বড় ভাই।

২০১৩ সালে ফারমার্স ব্যাংক অনুমোদন পায়

২০১৯ সালে ফারমার্স ব্যাংক নাম পাল্টে হয় পদ্মা ব্যাংক

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে চেয়ার‌ম্যান হিসেবে রেখেই ২০১৩ সালে ফারমার্স ব্যাংক অনুমোদন পায়।

ঋণ কেলেঙ্কারি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে চাপের মুখে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন তিনি। পরের বছর ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, যিনি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজেমেন্ট পিএলসি এবং কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান।

২০১৯ সালের শুরুর দিকে ফারমার্স ব্যাংক নাম পাল্টে হয় পদ্মা ব্যাংক।

মহীউদ্দীন খান আলমগীরের অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে পদ্মা ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে কয়েকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।

বিএসইসি মহীউদ্দীন খান আলমগীরের চিঠি পাওয়ার কথা জানালেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পায়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি বিআরপিডিতে খোঁজ নিয়েছি, এরকম কোনো চিঠি এখনো এসে পৌঁছেনি। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবৃদ্ধি ও নীতি বিভাগ- বিআরপিডি দেখে।”

মহীউদ্দীন খান আলমগীর, ফাইল ছবি

পদ্মা ব্যাংকের পাল্টা অভিযোগ

মহীউদ্দীন খান আলমগীর যেদিন গভর্নরকে চিঠি দিয়েছেন, সেই একই তারিখে পদ্মা ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিএসইসিকে একটি চিঠি পাঠিয়ে তার বিরুদ্ধে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের’ অভিযোগ করা হয়। 

পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান খসরুর স্বাক্ষরে ওই চিঠি পাঠানো হয় বিএসইসি কমিশনার মো. মিজানুর রহমানের বরাবরে।

চিঠিতে অভিযোগ করা হয় ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং তখনকার অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী) “ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ এবং আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে তহবিল তছরুপ করেছেন।”

চেয়ারম্যান থাকার সময় মহীউদ্দীন খান আলমগীর ব্যাংকের কাজে ‘সরাসরি হস্তক্ষেপ করে ঋণ অনুমোদন করিয়েছেন’ বলেও অভিযোগ করা হয়েছে চিঠিতে।

এরকম ১৯ গ্রাহকের কাছ থেকে খেলাপি ঋণের ৮৪৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ফেরত পেতে পদ্মা ব্যাংক মহীউদ্দীন খান আলমগীরের কাছ থেকে ‘সাহায্য চাওয়া হয়েছে’ বলেও চিঠিতে লেখা হয়েছে। 

সেখানে বলা হয়েছে, গ্রাহকের ঋণ হিসাব থেকে বিভিন্ন সময়ে ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ‘মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মালিকানাধীন সিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সরানো হয়েছে’।

পদ্মা ব্যাংকের অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মহীউদ্দীন খান আলমগীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটমকে বলেন, “সিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে আমার কোনো শেয়ার নেই। যে সব অভিযোগ পদ্মা ব্যাংকে থেকে করা হয়েছে সে সব মিথ্যা।”

চিঠির বিষয়ে কথা বলতে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান খসরুকে বৃহস্পতিবার ফোন করা হলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান। কিন্তু পরে কয়েক দফা চেষ্টা করা হলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।

বিএসইসি কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটমকে বলেছেন, পদ্মা ব্যাংক থেকে একটি চিঠি কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে, তিনিও তার একটি অনুলিপি পেয়েছেন।