ফারমার্স ব্যাংক থেকে মহীউদ্দীন আলমগীরের পদত্যাগ

ঋণ কেলেঙ্কারি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে চাপের মুখে ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়েছেন সাবেক মন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর।

প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2017, 04:01 PM
Updated : 27 Nov 2017, 06:34 PM

বেসরকারি এই ব্যাংকটির এমডিকে অপসারণের নোটিস দেওয়ার পর সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যানের পদত্যাগের খবর জানানো হয়।

ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরের পাশাপাশি অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীও পদত্যাগ করেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তাদের পদত্যাগপত্র পরিচালনা পর্ষদ গ্রহণ করেছে। নতুন চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মোহাম্মদ মাসুদ।

একইসঙ্গে ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটি, অডিট কমিটি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি পুনর্গঠনের কথাও জানানো হয়েছে।  

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ব্যাংকটিতে সদ্য নিয়োগ পাওয়া উপদেষ্টা, সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত সোমবার বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের তালিকা জমা দিলে তা অনুমোদন দেওয়া হয়।  

নতুন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাসুদ

পুনর্গঠিত পর্ষদ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকটির উপর ‘নজরদারি অব্যাহত’ থাকছে।

বেশ কিছু আমানতকারীর ব্যাংকটি থেকে অর্থ তুলে নেওয়ার চেষ্টায় সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমানতকারীদের সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

পদত্যাগের বিষয়ে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে রাতে কল করা হলেও তা অন্য একজন ধরে ‘রং নম্বর’ বলে লাইন কেটে দেন।

চাঁদপুরের সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন আলমগীর বর্তমান সংসদে সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ফারমার্স ব্যাংকটি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ২০১৩ সালে অনুমোদন পেয়েছিল।

তখন মোট আটটি ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, যা রাজনৈতিক বিবেচনায় বলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও স্বীকার করেন।

দেশের ‘চাহিদার চেয়ে বেশি’ ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়ায় এ নিয়ে সরকারকে সমালোচনায় পড়তে হয়েছিল। যাত্রা শুরুর তিন বছর না যেতেই ফারমার্স ব্যাংকে শত শত কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়লে সেই সমালোচনা আরও জোরালো হয়ে ওঠে।

ফারমার্স ব্যাংক এখন সঙ্কটে

অনিয়ম ধরা পড়ার পর তখন বেসরকারি এই ব্যাংকটিতে কড়া নজরদারিতে আনতে পর্যবেক্ষক বসিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক; যদিও পরে তা আদালতে আটকে যায়।

সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে দেওয়া এক প্রতিবেদনে ফারমার্স ব্যাংককে দেশের আর্থিক খাতের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে।

অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, ফারমার্স ব্যাংক সাধারণ আমানতকারী এবং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চসুদে অর্থ নিয়ে চলছে। দায় পরিশোধের সক্ষমতাও নেই ব্যাংকটির। এর ফলে ব্যাংকটি সমগ্র আর্থিক খাতে ‘সিস্টেমেটিক রিস্ক’ সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা না মেনে ফারমার্স ব্যাংকের নতুন ঋণ দেওয়ার বিষয়টিও প্রকাশ পায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে ফারমার্স ব্যাংকে যে অনিয়মগুলো চিহ্নিত করা হয়, সেগুলো হল

>> নীতিমালা অনুসরণ না করে গ্রাহকদের ঋণ দেওয়া

>> অস্তিত্ববিহীন/সাইন বোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া

>> ঋণ নিয়মাচার লঙ্ঘন করে ব্যাংকের পরিচালকসহ অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ দেওয়া

>> অপর্যাপ্ত/ত্রুটিপূর্ণ জামানতের বিপরীতে ঋণ দেওয়া

>> এক ঋণগ্রহীতার সর্বোচ্চ ঋণসীমার অতিরিক্ত ঋণ সুবিধা দেওয়া

সংসদীয় কমিটিতে দেওয়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক বছর ধরে ফারমার্স ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট রয়েছে এবং বর্তমানে তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ জমা  (সিআরআর) সংরক্ষণে ব্যাংকটি ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।

সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির গ্রাহক আমানত ৫ হাজার ১২৫ কোটি টাকা এবং আন্তঃব্যাংক আমানত ৫৩৫ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়।  

অন্যদিকে ব্যাংকটির কলমানি ঋণের পরিমাণ ১৪৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ক্রয়কৃত সরকারি সিকিউরিটিজের (বিল ও বন্ড) পরিমাণ ১ হাজার ৯ কোটি টাকা।

“অর্থাৎ ব্যাংকটির দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই,” বলা হয় প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির মোট ৫৪টি শাখার মধ্যে ২৮টি শাখাই লোকসানে পরিচালিত হচ্ছে।