ফারমার্স ব্যাংক ‘ঝুঁকিতে ফেলছে’ আর্থিক খাতকে

সাবেক মন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মালিকানাধীন ফারমার্স ব্যাংককে আর্থিক খাতের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

সাজিদুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Oct 2017, 01:09 PM
Updated : 29 Oct 2017, 01:09 PM

যাত্রা শুরুর তিন বছর না যেতেই শত শত কোটি টাকা ঋণ বিতরণে অনিয়ম ধরা পড়ায় বেসরকারি এই ব্যাংকটিতে কড়া নজরদারিতে আনতে পর্যবেক্ষক বসিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক; যদিও তা আদালতে আটকে যায়।

এখন অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, ব্যাংকটি সাধারণ আমানতকারী এবং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চসুদে অর্থ নিয়ে চলছে। দায় পরিশোধের সক্ষমতাও নেই ব্যাংকটির। এর ফলে ব্যাংকটি সমগ্র আর্থিক খাতে ‘সিস্টেমেটিক রিস্ক’ সৃষ্টি করছে।

এতে করে আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট হতে পারে বলেও মনে করছে মন্ত্রণালয়।

রোববার অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দেওয়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা না মেনে ফারমার্স ব্যাংকের নতুন ঋণ দেওয়ার কথাও এসেছে প্রতিবেদনে। এসব অনিয়মের কথা ফারমার্স ব্যাংক স্বীকারও করেছে বলে জানায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

২০১৩ সালে জুন মাসে ফারমার্স ব্যাংক আরও আটটি ব্যাংকের সঙ্গে লাইসেন্স পেয়েছিল, যা রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে।

ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন আলমগীর। এর আগে তার স্ত্রী ছিলেন এই পদে।

রোববার ফারমার্স ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ‘অনিয়মের’ প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা শেষে সংসদীয় কমিটি ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে।

মহীউদ্দীন খান আলমগীর (ফাইল ছবি)

সংসদীয় কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক পরে সাংবাদিকদের বলেন, “ব্যাংকগুলো যেসব অনিয়ম করেছে, পড়লেই গা শিউরে ওঠে। এসব অনিয়মের দায় বোর্ডকে নিতে হবে। তারা দায় এড়াবে কীভাবে?”

প্রভাবশালী চেয়ারম্যানের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পায় কি না- এই প্রশ্নে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সঙ্গে একই মন্ত্রিসভায় থাকা রাজ্জাক বলেন, “কিছুটা তো পায়ই।”

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফারমার্স ব্যাংক ২০১৩ সালে তাদের কার্যক্রম শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই ঋণ নিয়মাচার পরিপালন ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শিথিলতা দেখা দেয়।

প্রতিবেদনে যে অনিয়মগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো হল

>> নীতিমালা অনুসরণ না করে গ্রাহকদের ঋণ দেওয়া

>> অস্তিত্ববিহীন/সাইন বোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া

>> ঋণ নিয়মাচার লঙ্ঘন করে ব্যাংকের পরিচালকসহ অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ দেওয়া

>> অপর্যাপ্ত/ত্রুটিপূর্ণ জামানতের বিপরীতে ঋণ দেওয়া

>> এক ঋণগ্রহীতার সর্বোচ্চ ঋণসীমার অতিরিক্ত ঋণ সুবিধা দেওয়া

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছর ধরে ফারমার্স ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট রয়েছে এবং বর্তমানে তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ জমা  (সিআরআর) সংরক্ষণে ব্যাংকটি ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।

সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির গ্রাহক আমানত ৫ হাজার ১২৫ কোটি টাকা এবং আন্তঃব্যাংক আমানত ৫৩৫ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়।  

অন্যদিকে ব্যাংকটির কলমানি ঋণের পরিমাণ ১৪৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ক্রয়কৃত সরকারি সিকিউরিটিজের (বিল ও বন্ড) পরিমাণ ১ হাজার ৯ কোটি টাকা।

“অর্থাৎ ব্যাংকটির দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই,” বলা হয় প্রতিবেদনে।

নতুন ঋণ মঞ্জুরি ও ঋণসীমা বাড়ানোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ফারমার্স ব্যাংক তা না মেনে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়,  জুন, ২০১৭ ত্রৈমাসিকে ঋণ প্রবৃদ্ধি আমানত প্রবৃদ্ধির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় ঋণ-আমানত হার দাঁড়িয়েছে ৮৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, যা সসর্বোচ্চ গ্রহণযোগীসীমার ৮৫ শতাংশ অপেক্ষা বেশি।

ব্যাংকটির ওপর দণ্ডসুদ ও জরিমানার পরিমাণ গত এক বছরে দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির মোট ৫৪টি শাখার মধ্যে ২৮টি শাখাই লোকসানে পরিচালিত হচ্ছে।

ফারমার্স ব্যাংকের শাখা এখন ৫৪টি

সংসদীয় কমিটির সভাপতি রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, বেসরকারি ব্যাংক হলেও এগুলো ‘পাবলিক প্রতিষ্ঠান’। জনগণের টাকায় চলে। সেজন্য কমিটি তা নিয়ে আলোচনা করেছে।

সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ফারমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শামীম উপস্থিত ছিলেন।

রাজ্জাক বলেন, “তিনি (শামীম) বলেছেন, এমডি হিসেবে তার আসার আগে আগে এগুলো হয়েছে। তারা সংশোধনের চেষ্টা করছেন।”

অনিয়ম এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেও

এদিকে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বোর্ড সভায় অনুপস্থিত পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল করে উপস্থিতি দেখিয়ে পর্ষদ সভার কার্যবিররণী করা হয়েছে। নিয়ম ভেঙে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যানের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে।

ব্যাংকটি গঠনের সময় মূলধন আনায় অনিয়ম, অনিবাসীদের পরিবর্তে বেনামে বাংলাদেশে বসবাসকারী ব্যক্তি কর্তৃক ব্যাংকের শেয়ার কেনা, বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ প্রদান এবং ব্যাংক হতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টির সাথে পর্ষদ সদস্য ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সম্পৃক্ততার কথা এসেছে প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানি আইনের বিধান এবং ব্যাংকের আর্টিক্যালস অব অ্যসোসিয়েশনের সংশ্লিষ্ট ধারা লঙ্ঘন করে ব্যাংকের একজন পরিচালকের অনুপস্থিতিতে তার শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়ে পর্ষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এছাড়া নিয়ম না মেনে ৬ জন পরিচালকের শেয়ার বাজেয়াপ্তকরণ ও ৩ জন পরিচালককে অপসারণ করেছে।

এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংকটির শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ ডিসেম্বর ২০১৬ প্রান্তিকে প্রায় ১৯ কোটি ৩০ কোটি টাকা। কিন্তু জুন ২০১৭ প্রান্তিকে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ ১৭২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ১৯১ কোটি ৬৯ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

নতুন স্থাপিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে শ্রেণীকৃত ঋণের হারের বিবেচনায় এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ফারমার্স ব্যাংক রয়েছে প্রথম অবস্থানে। 

বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়ে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংক পরিচালনায় অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কে অধিকতর তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করে ব্যাংকগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়।

বৈঠকে ইসলামী ব্যাংক নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক।

তিনি বলেন, “আমরা যেটা দেখেছি সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক এগ্রেসিভ লোন দিচ্ছে। এ বিষয়টি আমরা সতর্ক করেছি।”

আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, নাজমুল হাসান, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, ফরহাদ হোসেন, শওকত চৌধুরী ও আখতার জাহান অংশ নেন।

বৈঠকে জানানো হয়, এবি ব্যাংকের যোগসাজশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার হওয়ার বিষয়ে বাংলদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইউনিট ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ৪টি বিদেশি ফাইন্যান্সিয়াল ইউনিটকে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করেছে, যার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করে আগামী বৈঠকে কমিটিকে জানানো হবে।