এক্সিম ব্যাংক চেয়ারম্যান বলেন, “সব ব্যাংকই রাষ্ট্রের সম্পদ। এখন রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই তাকে রক্ষা করতে হবে। রক্ষার দায়িত্বটি পালন করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটিই বড় কথা।”
Published : 16 Mar 2024, 12:37 AM
ঋণ কেলেঙ্কারিতে জর্জর পদ্মা ব্যাংকের পুঞ্জীভূত লোকসান হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি, আমানতকারীদের অর্থ ফেরাতে পারছে না; এই ব্যাংকটির সঙ্গে একীভূত হলে মুনাফায় থাকা এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্যের হানি হবে কিনা, সে প্রশ্ন উঠেছে।
পদ্মা একটি প্রচলিত ধারার ব্যাংক, অন্যদিকে এক্সিম চলে শরিয়াহ ব্যাংকিংয়ের নিয়মে। পরস্পরবিরোধী দুই নীতিমালার সমন্বয় কীভাবে হবে, পদ্মায় আমানত রেখে বিপাকে পড়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা ফেরত পাবে কি না, এসব প্রশ্নের জবাবও আপাতত নেই।
দুর্বল ও ডুবে যাওয়া ব্যাংককে অধিগ্রহণের বিষয়ে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেছেন ‘রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের’ কথা। বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা করবে, সেভাবেই কাজ করবেন তারা।
একীভূত হতে দুই ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদ নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বৃহস্পতিবার। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলা বাকি।
২০১৩ সালে লাইসেন্স দেওয়া কয়েকটি ব্যাংকের একটি ছিল দ্য ফারমার্স ব্যাংক, লাইসেন্স দেওয়া হয় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে। কিন্তু বিতরণ করা ঋণের প্রায় পুরোটা খেলাপি হয়ে যাওয়ায় কয়েক বছরের মধ্যে মালিকানা-ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে, নতুন যাত্রায় নাম হয় পদ্মা ব্যাংক।
সে সময় ব্যাংকটি বাঁচাতে সরকারও এগিয়ে আসে। তারল্য সংকট কাটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক আর রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ-আইসিবির মাধ্যম ৭২৯ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেওয়া হয়।
কিন্তু নতুন ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকটি জাগেনি। বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আনার ঘোষণা দিয়ে সুবিধা চাইলেও বিনিয়োগ পায়নি। পরে সরে যেতে হয় এর চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে। এখন সেই ব্যাংক অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পথে।
বাংলাদেশে এর আগেও বেশ কিছু ব্যাংক একীভূত হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই সরকারি ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক আছে একটি। সেসব ব্যাংকের অভিজ্ঞতাও অম্লমধুর।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একীভূত কোন প্রক্রিয়ায় হচ্ছে তার নীতিমালা এখনো ঠিক করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। তা না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না দুই ব্যাংক এক হচ্ছে না ভিন্ন কিছু। হলে প্রক্রিয়াটা তো জানানো দরকার আগে। তখন বোঝা যাবে এর সুফল মিলবে কি না।”
তবে পদ্মা ও এক্সিমের এক হওয়াকে ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ব্যাংকিং খাতে যারা সবল, তারা দুর্বল ব্যাংকের দায়িত্ব নিলে প্রত্যাশাটা ভালো করা যায়। এক্সিম ব্যাংক তুলনামূলকভাবে তো পদ্মার চেয়ে ভালো। এখন যেটি হচ্ছে, তার সুফল বা ব্যর্থতা দেখতে আমাদের সময় লাগবে, অপেক্ষা করতে হবে।”
অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, এত বেশি ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। ব্যাংকের সংখ্যা কমানো প্রয়োজন। সরকার সেই পথেই হাঁটল, তবে দেরি করে।
২০২১ সাল পর্যন্ত পদ্মা ব্যাংকের পুঞ্জীভূত লোকসান ছাড়িয়েছে ৯০০ কোটি টাকার উপরে। পরের দুই বছরের চূড়ান্ত হিসাব মেলেনি এখনো। তবে নাম বদলানোর পরের চার বছরে ২০২২ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটিতে নতুন করে মূলধন থেকেই ক্ষয় হয় ২৪৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।
দুই নীতির মিলন কীভাবে
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলছেন, “এখানে বড় একটি চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে দুই ব্যাংক পরিচালনার নীতিগত পার্থক্যটি।
“পদ্মা ব্যাংক চলে প্রচলিত সুদ ব্যবস্থায় ও এক্সিম ব্যাংক শরিয়াহভিত্তিতে। সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী নীতির দুই ব্যাংক এক জায়গায় হলে পুরো কাঠামোই বদলে যাবে।”
প্রচলিত ব্যাংকের ঋণ ও আমানত সুদহার নির্দিষ্ট করা থাকে। চুক্তি অনুযায়ী আমানতের বিপরীতে সুদ পান আমানতকারীরা। আবার ঋণ নেওয়ার সময় উল্লেখ থাকা হার অনুযায়ী ব্যাংক ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে সুদ নিয়ে থাকে প্রচলিত ধারার ব্যাংক।
প্রচলিতের সঙ্গে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের এটিই মৌলিক পার্থক্য। সংজ্ঞা ও পরিচালনায় আরো পার্থক্য থাকলেও তা গৌণ ধরা হয়।
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “পদ্মা ব্যাংকের গ্রাহকের চেয়ে এক্সিম ব্যাংকের গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীরা বিষয়টিকে কীভাবে নেবেন, তা বড় প্রশ্ন। বিপরীতে পদ্মা ব্যাংকের কর্মচারীদের তো শরিয়াহ সম্পর্কে ধারণা নেই। তাদেরই বা কীভাবে আত্মীকরণ করবে এক্সিম ব্যাংক?”
পদ্মা ব্যাংকের সব কর্মীই এক্সিমে চাকরি পাবেন কি না, আর একীভূত হলে একই এলাকায় থাকা দুই ব্যাংকের শাখার কী হবে- এই প্রশ্নে চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পদ্মা ব্যাংকের শাখা ও কর্মচারীরা এক্সিম ব্যাংকের হয়ে যাবে। শাখার নামগুলো বদলে এক্সিম হবে।”
তবে একই এলাকায় থাকা দুই ব্যাংকের শাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী, তা খোলাসা করেননি তিনি।
এক্সিম ব্যাংকের ‘স্বাস্থ্যের’ হানি হবে?
পদ্মা ব্যাংকের আমানত আছে ছয় হাজার ১৪১ কোটি টাকার। অন্যদিকে ব্যবসার পরিধি বা বিতরণকৃত ঋণের আকার গত সেপ্টেম্বর শেষে ছিল সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার উপরে। এর ৩ হাজার ৬৭২ কোটি অর্থাৎ ৬৪ শতাংশই খেলাপি।
বিপরীতে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকার পোর্টফলিও থাকা এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দুই হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি যা শতকরা হারে চার শতাংশের সামান্য বেশি।
পদ্মার আমানত ও ঋণের দায় পুরোটাই এক্সিম ব্যাংকে নিতে হবে জানিয়ে অধ্যাপক মাহমুদ বলেন, “এতে এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন দুর্বল হবে কিছুটা। তা কীভাবে সামাল দেবে আর সেটি এখন বড় প্রশ্ন।”
এই প্রশ্ন নিয়ে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ‘রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের’ প্রসঙ্গ টেনেছেন।
পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের ঘনিষ্ঠ এই ব্যবসায়ী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সব ব্যাংকই রাষ্ট্রের সম্পদ। এখন রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই তাকে রক্ষা করতে হবে। রক্ষার দায়িত্বটি পালন করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটিই বড় কথা।”
পদ্মা ও এক্সিম ব্যাংকের হিসাবনিকাশ (সব অংক কোটি টাকায়)
বিষয় | এক্সিম | পদ্মা |
পরিশোধিত মূলধন | ১৪৪৭.৫৬ | ১১১৬ (৬৮ শতাংশ বা ৭২৯ কোটি ৩০ লাখ টাকার সোনালী, রুপালী, জনতা, অগ্রণী ও আইসিবির) |
আমানত | ৪২,৭০৪ | ৬১৪১ |
ঋণ | ৪৫,৯৮৮ | ৫৭৬২ |
খেলাপির পরিমাণ | ১৮৭৫ | ৩৬৭২ |
খেলাপির হার | ৪.০৪% | ৬৩.৭৩% |
আদায় অযোগ্য ঋণ | ১৫৪৫ | ৩৬৩০ |
মুনাফা ২০২২ | ৩৭২ | তথ্য নেই |
শাখা | ১৪৭টি | ৫৯টি |
জনবল | ৩৩৫১ জন | ১২০০ জন |
পদ্মা ব্যাংক অবশ্য এই সিদ্ধান্তে খুশি।
নাফিজ সরাফাত সরে যাওয়ার পর পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য, মুনাফার পরিমাণ ও ঋণের গুণগত মান পদ্মা ব্যাংকের চেয়ে তো ভালো। তারা চেয়েছে। আমরা রাজি হয়েছি। এখানে তো উভয় ব্যাংকেরই সমর্থন থাকতে হবে। আমরা চাইলেও তো আর হবে না।”
পদ্মার আমানতকারীদের কী হবে
পদ্মা ব্যাংককে উদ্ধার করতে সরকারের উদ্যোগে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর মাধ্যমে যে মূলধন জোগান দেওয়া হয়েছিল, তা পাঁচ বছরেও ফেরত যায়নি।
ব্যাংক কোম্পানি আইনের একটি ধারা থেকে অব্যাহতি দিয়ে মূলধন জোগান দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের পদাধিকার বলে পদ্মা ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তখন থেকেই পাঁচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা পদ্মা ব্যাংকের পরিচালক হিসেব দায়িত্ব পালন করছেন।
আর্থিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না পদ্মা ব্যাংক। ওই অবস্থায় ২০২০ সালে কোনো রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেয় তারা।
আরেকটি প্রস্তাবে জোগান দেওয়া মূলধনের বিপরীতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমপরিমাণ শেয়ার ইস্যু করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের মতামত জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে যে চিঠি দেয়, সেখানে বলা হয়, পদ্মা ব্যাংক সরকারি ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করার যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটা ব্যাংক কোম্পানি আইনের সাথে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়’।
এমন আরো অনেক প্রতিষ্ঠানই পদ্মায় আমানত রেখে ফেরত পাচ্ছে না। একীভূত হলে সেই অর্থ এক্সিম ব্যাংক দেবে কি না- এক্সিম ব্যাংকের নজরুল ইসলাম মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, “অডিট ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী সব কিছু হবে।
“মার্জারের পর সবার স্বার্থ রক্ষা হবে। পদ্মা ব্যাংকের আমানত ও ঋণ আমাদের (এক্সিম ব্যাংক) তুলনায় অনেক কম।”
প্রথমে ফারমার্স, পরে সমস্যার পাকে পদ্মা
পদ্মা ব্যাংকের সূচনা হয়েছিল ফারমার্স ব্যাংক নামে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালে একসঙ্গে যে নয়টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়, তার মধ্যে একটি সেটি।
যাত্রার তিন বছর পার করেই ধুঁকতে শুরু করে ব্যাংকটি। অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে তারল্য সংকটে ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে ২০১৭ সালে। সে সময় চাপের মুখে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
ফারমার্স ব্যাংকের ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় গত বছরের শেষে ব্যাংকটির অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী ও তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতীকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে রায় দিয়েছে আদালত।
২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ আরাফাত হোসেন এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে বাবুল চিশতীর স্ত্রী রোজী চিশতী ও ব্যাংকের সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসুদুর রহমান খানকেও পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
বাবুল চিশতি, তার স্ত্রী ও ছেলেকে ১৫৯ কোটি ৯৫ লাখ ৪৯ হাজার ৬৪২ টাকার দ্বিগুণ অর্থাৎ ৩১৯ কোটি ৯০ লাখ ৯৯ হাজার ২৪০ টাকা অর্থদণ্ডও করা হয়েছে।
মামলা আরো হয়েছে। সেগুলোর নিষ্পত্তি হয়নি। আর মহীউদ্দীন খান আলমগীরের কিছুই হয়নি। তার বিরুদ্ধে মামলা বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
২০১৮ সালে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। পরের বছরের জানুয়ারিতে ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে হয় পদ্মা ব্যাংক।
তখন পদ্মা ব্যাংককে উদ্ধার করতে সরকারের উদ্যোগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান মূলধন জোগান দেয়।
পুনর্গঠনেও পদ্মা ব্যাংকের যখন উন্নতি হচ্ছিল না, বরং আরো পাকে পড়ে ডুবে যাচ্ছিল, সে সময় ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর একটি চমকপ্রদ খবর দেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি।
বড় অঙ্কের বিদেশি বিনিয়োগ আনার ঘোষণা দেয় ব্যাংকটি। তারা জানায়, অঙ্কটা হতে পারে ৭০ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
জানানো হয়, বিপুল এ বিনিয়োগ আনতে মধ্যস্থতা করবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক খ্যাতনামা বিনিয়োগ ব্যাংক ডেলমর্গান অ্যান্ড কোম্পানি।
এ লক্ষ্যে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করার বিষয়ে তথ্য দেওয়া হয়। গণমাধ্যমে সেই চুক্তির ছবিও পাঠানো হয়।
এমওইউ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পদ্মা ব্যাংকের সে সময়ের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও ডেলমর্গানের চেয়ারম্যান রব ডেলগাডো।
ব্যাংকটির সে সময়ের এমডি ও সিইও এহসান খসরু গণমাধ্যমকে বলেন, আগামী ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যেই এ বিনিয়োগ আসবে। বিনিয়োগের মধ্যে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আসবে ইক্যুইটি বিনিয়োগ হিসেবে। বাকি টাকা আসবে ঋণ হিসেবে।
কিন্তু সেই বিনিয়োগ আর আসেনি। এ বিষয়ে পদ্মা ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি, যদিও বিনিয়োগ আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ সুবিধা আদায় করে নেয় তারা।
বিদেশি বিনিয়োগ আনতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডেলমর্গানের শর্তানুযায়ী ব্যাংকটির আর্থিক লোকসানের তথ্য হিসেব বিবরণী থেকে গোপন রেখে আলাদা হিসাব তৈরির ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্মতি দেয়, যা পরবর্তী ১০ বছরে ব্যাংকটির মুনাফা থেকে সমন্বয় করার কথা।
এর মধ্যে গত ৩১ জানুয়ারি চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়ার খবর আসে।
ব্যাংক একীভূত: অতীতে যা যা হয়েছে
সর্বপ্রথম ব্যাংক একীভূত করার ঘটনা দেখা যায় ১৯৭২ সালে। আর সর্বশেষ ২০০৯ সালে।
পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে কার্যরত থাকা মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক, অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক একীভূত করে নাম দেওয়া হয় রূপালী ব্যাংক। তিন ব্যাংকের সকল দায় ও সম্পদ এক হয়।
সে সময় রূপালী ছিল শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানার প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৬ সালে এর ৪৯ শতাংশ শেয়ার বাজারে ছেড়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে ব্যাংকটির ৯০ শতাংশের বেশি শেয়ার ফের সরকারের মালিকানায় রয়েছে।
সাবেক হাবিব ব্যাংক লিমিটেড ও কমার্স ব্যাংক লিমিটেড এর বাংলাদেশে থাকা সব সম্পদ ও দায় সমন্বয় করে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে গঠন করা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক।
আর একই আদেশে ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড ও ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড মিলিয়ে একই বছরে গড়া হয় জনতা ব্যাংক।
সোনালী ব্যাংক গঠন করা হয় তিনটি ব্যাংক নিয়ে। সেগুলো হল ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ব্যাংক অব বাহওয়ালপুর এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক।
১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক’ ও ‘বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা’ নামে দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ২০০৯ সালের নভেম্বরে প্রতিষ্ঠান দুটিকে একীভূত করে সরকার। নতুন নাম হয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড।
আরো পড়ুন
পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ ‘ছাড়লেন’ নাফিজ সরাফাত
দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক একীভূত হচ্ছে এক্সিমে
ব্যাংক একীভূতকরণ: স্বেচ্ছায় ডিসেম্বরের মধ্যে, না হলে মার্চে প্রক্রিয়া শুরু
উত্তর পেয়ে গেছি: ব্যাংক মার্জার নিয়ে বিএবি চেয়ারম্যান