গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতায় নতুন দফা, হলফনামায় ভুল তথ্য দেওয়া, মনোনয়নপত্র জমার সময় নির্ধারণ, প্রচারণার সময় নির্ধারণ, দল নিবন্ধন বিধিসহ ছোটখাটো সংযোজনের প্রস্তাব নিয়ে পর্যালোচনা চলছে।
Published : 13 Apr 2025, 01:24 AM
ইসির নিজস্ব প্রস্তাব ও সংস্কার কমিশনের সুপারিশ সমন্বয়ের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনের আইন-বিধি সংশোধনের প্রস্তুতি চলছে, যেখানে ভোটের পরেও ঋণখেলাপি ও হলফনামায় তথ্য গোপন করলে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব রাখা হচ্ছে।
তাছাড়া সোশাল মিডিয়ায় প্রচারের সুযোগ দিলেও বিধি লঙ্ঘনে সাইবার সুরক্ষা আইনে ব্যবস্থা এবং দল ও প্রার্থীর কাছে আচরণবিধি মানার বিষয়ে অঙ্গীকারনামা নেওয়ার প্রস্তাব থাকছে।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের আমলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ ও প্রভাবমুক্ত রাখতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ও আচরণবিধিতে একগুচ্ছ পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এক্ষেত্রে নিজস্ব প্রস্তাবের পাশাপাশি নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতায় নতুন দফা, হলফনামায় ভুল তথ্য দেওয়া, মনোনয়নপত্র জমার সময় নির্ধারণ, প্রচারের সময় নির্ধারণ, দল নিবন্ধন বিধিসহ ছোটখাটো সংযোজনের প্রস্তাব নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। পাশাপাশি আচরণবিধিকেও সময়োপযোগী করাসহ বেশ কিছু সংশোধন প্রস্তাব থাকছে নির্বাচন কমিশনের।
ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও ‘অতি জরুরি ভিত্তিতে’ নির্বাচনি আইন, বিধি, নীতিমালা নিয়ে প্রস্তাব পাঠানোর অনুরোধ করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
সরকার প্রস্তাবগুলো পাওয়ার পর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং পর্যালোচনা করে অধ্যাদেশ, বিধি গেজেট আকারে প্রকাশে উদ্যোগ নেবে।
আচরণবিধি নতুন আঙ্গিকে
২০০৮ সালে প্রণীত ‘রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালার নাম এবার ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন আচরণ বিধিমালা, ২০২৫’ রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “আচরণবিধি যেটি আছে, সেটি একটু নতুন আঙ্গিকে আমরা দাঁড় করাচ্ছি। নতুন আঙ্গিকে বলতে নতুন কিছু এখানে ইনকরপোরেট হবে।
“বিদ্যমান আচরণ বিধিমালায় নির্বাচনি প্রচারে ভিআইপিরা যেন কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে অংশ নিতে না পারেন, সে বিষয়টি রয়েছে। এর সাথে নির্বাচিত সরকারের বাইরেও, যেমন বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রয়েছে, বা ভবিষ্যতে কেয়ারটেকার সরকার থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে পদ-পদবি বা মন্ত্রী বা ভিআইপির সাথে উপদেষ্টা শব্দটিও ইনকরপোরেট করার প্রস্তাব করব আমরা।”
খসড়াটি পরে নির্বাচন কমিশন চূড়ান্তভাবে অনুমোদন হলে পরবর্তী পদক্ষেপে যাবে।
এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “পোস্টার, লেমিনেটেড পোস্টার নিয়ে পরিবেশবিদদের সুপারিশ আর সংস্কার কমিশনের সুপারিশ গুরুত্ব সহকারের বিবেচনা করছি আমরা। পোস্টারের বদলে এটা ব্যানারে থাকা যায় কিনা চিন্তা ভাবনা করছি। কমিশনের সিদ্ধান্তের পরে চূড়ান্ত হবে।”
“ঋণখেলাপি ও হলফনামায় ভুল তথ্য দিলে ভোটের পরেও ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব থাকবে আমাদের। সেই সঙ্গে ভালো নির্বাচনের জন্য সংস্কার কমিশনের কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করলেও অসুবিধা নেই।”
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ-জানিপপের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর মতে, সোশাল মিডিয়ায় প্রচারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা ঠিক হবে না। তবে আক্রমণাত্মক ও ধর্মানুভূতিতে আঘাতসহ কিছু বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ ইতিবাচক।
তিনি বলেন, “বাক স্বাধীনতা থাকবে, নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কিন্তু সোশাল মিডিয়ায় প্রার্থীরা কী করতে পারবে, কী করতে পারবে না-এমন বিষয়গুলো ক্যাটাগরি করে দিতে হবে এবং তদারকি করতে হবে।”
আর কী কী প্রস্তাব
‘নির্বাচনপূর্ব সময়’ বলতে বিদ্যমান বিধিতে তফসিল ঘোষণা থেকে ফলাফলের গেজেট প্রকাশের সময়কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী আচরণবিধি প্রতিপালনে তিনটি সময় প্রস্তাব করা হচ্ছে।
সংসদের মেয়াদ শেষ থেকে তফসিল ঘোষণার সময়কে ‘নির্বাচনপূর্ব সময়; তফসিল ঘোষণা থেকে ফলাফলের গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত ‘নির্বাচনকালীন সময়’ এবং গেজেট প্রকাশ থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত ‘নির্বাচনপরবর্তী সময়’ বলা হয়েছে।
প্রস্তাবে আরো বলা হচ্ছে–
>> মনোনয়নপত্র জমায় প্রার্থীর সঙ্গে ৫ জনের বেশি থাকতে পারবেন না।
>> পলিথিনের লিফলেট, প্লাস্টিক ব্যানার (পিভিসি ব্যানার) নিষিদ্ধ।
>> ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের সুযোগ; আইডি রিটার্নিং অফিসারের কাছে দিতে হবে।
>> সোশাল মিডিয়ার প্রচার ব্যয় নির্বাচনী ব্যয়ে দেখাতে হবে।
>> সোশাল মিডিয়ায় উসকানিমূলক ও মানহানিকর বক্তব্য দেওয়া হলে অর্থদণ্ডের পাশাপাশি ডিজিটাল/সাইবার সুরক্ষা আইনের আওতায় শাস্তি।
>> মাইকের প্রচারের ৬০ ডেসিবেলের বেশি শব্দ নয়।
>> আচরণবিধি লঙ্ঘনে প্রার্থিতা বাতিলের বিষয়টি স্পষ্ট করে নতুন দফা যুক্ত হচ্ছে।
>> দলগুলো আচরণবিধি মানবে–এমন প্রত্যয়নপত্র প্রতীক বরাদ্দের আগে ইসিতে দিতে হবে এবং প্রার্থীও বিধি মানার বিষয়ে রিটার্নিং অফিসারের কাছে প্রত্যয়নপত্র দেবেন। অঙ্গীকার না মানলে বিধিমালার শাস্তি মানতে বাধ্য হবেন।
২ মার্চ ভোটার দিবসে সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায় দলকেই নিতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে প্রত্যেকটা দলের কাছ থেকে দলিলে সই নিতে পারে ঐক্যমত কমিশন। তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা অনেকটা সহজ হবে।
ঋণখেলাপি ও ভুল তথ্য দিলে ভোটের পরেও ব্যবস্থা
প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা, মনোনয়নপত্র, নিবন্ধন শর্ত শিথিলসহ আরপিওতে একগুচ্ছ সুপারিশ দিয়েছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। বেশকিছু সুপারিশে ভিন্নমত পোষণ করে ইতোমধ্যে ঐকমত্য কমিশনে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, “যত দ্রুত সম্ভব, এসব সুপারিশের ওপর মতামত পেশ করা হবে। তবে এই মুহূর্তে কী কী সুপারিশ করা হবে, সে বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। মাননীয় কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।”
নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে আইন-বিধি নিয়ে প্রস্তাব পাঠাতে পর্যালোচনা শুরু করেছে বলে জানান তিনি।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের কিছু বিষয় আমরা মোটামুটিভাবে, ভালো নির্বাচনের জন্য যেগুলো সহায়ক হবে সে পয়েন্টগুলো আমরা ইনকরপোরেট করার চেষ্টা করছি।”
সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশ আলোচনায়
>> অভ্যাসগত ঋণখেলাপি ও বিল খেলাপিদের প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা। বিশেষত ঋণখেলাপিদের ক্ষেত্রে তাদের তামাদি ঋণ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ছয় মাস আগে পরিপূর্ণভাবে শোধ করার বিধান করা। নির্বাচনের পরে যারা আবার ঋণখেলাপি হয়েছেন, তাদেরকে সংসদ সদস্য পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণার বিধান করা।
>> মনোনয়ন দাখিলে ১০ দিন, বাছাইয়ে ৭ দিন, প্রত্যাহারে ১০ দিন ও প্রচারে ১৫ দিন সময় বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে তুলে ধরে ইসি বলেছে, আরপিওতে তা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
>> স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জমা দেওয়ার বিধানের পরিবর্তে ৫০০ ভোটারের সম্মতির বিধান করা।
>> একাধিক আসনে কোনো ব্যক্তির প্রার্থী হওয়ার বিধান বাতিল করা।
>> হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেওয়ার কিংবা তথ্য গোপনের কারণে আদালতে কোনো নির্বাচিত ব্যক্তির নির্বাচন বাতিল করা হলে ভবিষ্যতে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য করার বিধান করা।
>> বেসরকারি সংস্থার কার্যনির্বাহী পদে আসীন ব্যক্তিদের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ওই পদ থেকে তিন বছর আগে অবসর গ্রহণ সংক্রান্ত আরপিওর ধারা বাতিল করা।
>> স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পদত্যাগ না করে সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য করা।
>> কোনো নির্বাচনী এলাকায় ৪০% এর কম ভোট পড়লে পুননির্বাচনের বিধান করা।
>> নতুন দলের নিবন্ধন শর্ত শিতিল করে ১০% জেলা অফিস, ৫% উপজেলা অফিস এবং ন্যূনতম ৫ হাজার সদস্য থাকার বিধান করা।
>> ৫ বছর পর পর দলের নিবন্ধন নবায়ন করা।
>> হলফনামা ও আয়কর নথিতে তথ্য গোপন করলে বা ভুল তথ্য দিলে মনোনয়নপত্র/নির্বাচন বাতিল করা।
গোছানোর প্রস্তুতি
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী ডিসেম্বরকে লক্ষ্য করে সরকারের পাশাপাশি ইসি সব কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনেয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “আমরা জুলাই-আগস্টের ভেতরে পূর্ণ প্রস্তুত থাকর চিন্তা করছি। কারণ আমাদের যে সংশোধনীগুলো আইনে আসছে সেগুলোর ম্যানুয়াল পাবলিশ করতে হবে। এই জিনিসগুলো আবার ডিস্ট্রিবিউট করতে হবে। তারপরে মাঠ পর্যায়ে থেকে সকল পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
“বরাবরই বলে আসছি ডিসেম্বরই আমাদের টার্গেট। অক্টোবরে যদি আমরা তফসিল ঘোষণার চিন্তা করি, তাহলে জুলাই-অগাস্টের ভেতরে আমাদের সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। সেই লক্ষ্যে আমরা এগোচ্ছি। … এরপর রাজনীতিবিদসহ অন্যান্য স্টেক হোল্ডার যারা আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, তাদের সঙ্গে আমাদের মত বিনিময় হবে। তারপর শিডিউল হবে।”
তিনি বলেন, “সবাই নজিরবিহীন সুন্দর নির্বাচন চায়। অনন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এ সময়ে প্রভাবমুক্ত, পক্ষপাতহীন, নিরপেক্ষভাবে নির্ভেজাল নির্বাচন করতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
“যে কোনো মূল্যে ভালো নির্বাচনের বিকল্প নেই। সবাই ইসির দিকে তাকিয়ে আছে। সব কর্নার থেকে সবার সহযোগিতা আশা করছি।”
পুরনো খবর
পাঁচ কমিশনের 'আশু বাস্তবায়নযোগ্য' ১২১ সুপারিশ, দ্রুত তালিকা চায় সরকার
জুনে স্থানীয় সরকার সম্ভব নয়, টার্গেট ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন
কারসাজি করে জেতা গেলেও দলেরই সর্বনাশ: সিইসি
ফেরারি আসামিকে প্রার্থী হতে বাধা নয়, ঐকমত্য কমিশনকে ইসি
নির্বাচন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে ১৫০ সুপারিশ কমিশনের
আশু বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে 'কাজ করছে' ইসি
লক্ষ্য ডিসেম্বর, ইসি কী প্রস্তুতি নিচ্ছে
৯৬ পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন পর্যালোচনা করছে ইসি