"সংস্কার কমিশন পরামর্শ দিয়েছে জুনে সম্ভব। সেটি সম্ভব হবে যদি ১৬ লক্ষ মৃত ভোটারকে বাদ দেওয়া না হয় এবং নতুন ৩৫ লাখ ভোটারদের বাদ দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয়।”
Published : 24 Feb 2025, 03:10 PM
চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার প্রস্তুতি নেওয়া ‘সম্ভব নয়’ জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, কমিশনের মূল লক্ষ্য ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা।
সেই প্রস্তুতি নিয়েই তারা এগিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
এছাড়া ভোটার তালিকা হালনাগাদের যে কার্যক্রম কমিশন হাতে নিয়েছে, সেটি শেষ হতেও জুন পর্যন্ত সময় লাগবে বলে তুলে ধরেন সিইসি।
সোমবার নির্বাচন কমিশন বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন আরএফইডির নতুন কমিটির দায়িত্ব গ্রহণ উপলক্ষে নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নাসির উদ্দিন কথা বলছিলেন।
আগামী জুনের মধ্যে সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, "সংস্কার কমিশন পরামর্শ দিয়েছে জুনে সম্ভব। সেটি সম্ভব হবে যদি ১৬ লক্ষ মৃত ভোটারকে বাদ দেওয়া না হয় এবং নতুন ৩৫ লাখ ভোটারদের বাদ দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয়। ভোটার তালিকা হালনাগাদের কার্যক্রম শেষ হবে আগামী জুন মাসে। সুতরাং চূড়ান্ত ভোটার তালিকা না হলে আমরা নির্বাচনের জন্য তো প্রস্তুত হতে পারছি না।"
তিনি বলেন, “আমাদের টার্গেট ডিসেম্বর এবং জাতীয় নির্বাচন। ডিসেম্বরে নির্বাচন করতে গেলে অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা করতে হবে।”
এমন পরিস্থিতির মধ্যে স্থানীয় সরকার কমিশনের সুপারিশ একান্ত তাদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি বলে মন্তব্য করেছেন সিইসি।
তিনি বলেন, "তারা বিজ্ঞ এবং জ্ঞানী লোকজন, এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। রাজনৈতিক এ বিষয়ে একটি রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে। নির্বাচন কমিশন তাতে জড়িত হতে চায় না। আগে ভোটার তালিকা হোক, এখনও ভোটার তালিকা করা সম্ভব হয়নি।"
এ বিষয়ে আগেভাগে কোনো মন্তব্য করতে ‘চান না’ জানিয়ে সিইসি বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছেন।
ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ৬ মাস হওয়ায় সমঝোতার জন্য এসময় অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
ভোটার তালিকা তৈরির পাশাপাশি অন্যান্য প্রস্তুতি তারা নিচ্ছেন বলেও তুলে ধরেন নাসির উদ্দিন।
তিনি বলেন, “সীমানা নির্ধারণের অনেকগুলো আবেদন ঝুলে আছে। আইনি জটিলতার কারণে নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। এই আইন সংশোধন করার জন্য ইতিমধ্যে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।"
আরও কিছু বিষয় সরকারের কাছে নির্বাচন কমিশন প্রস্তাব দেবে জানিয়ে তিনি বলেন, যদি সংস্কার কমিশন গঠন করা না হত তাহলেও এটি করতে হত।
নাসির উদ্দিন বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব সংস্কার দরকার বলে কমিশন মনে করে সেটুকু করার উদ্যোগ তারা নিয়েছেন।
বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব কী না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "ডিসেম্বর আসতে আসতে এই পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে। সবার সহযোগিতা নিয়ে এমন একটি নির্বাচনি পরিবেশ করা হবে যেখানে ভোট ছাড়া মানুষের আর কোনো চিন্তা থাকবে না।"
এর আগে সেবা পেতে জনগণের ভোগান্তি লাঘবের জন্য হলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
তবে এটা একান্তই তার ‘ব্যক্তিগত’ মত জানিয়ে উপদেষ্টা বলেছিলেন, সরকারই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলগুলোর মধ্যে শেষ পর্যন্ত সমঝোতা হবে বলে মনে করেন সিইসি নাসির উদ্দিন।
ভোটের তারিখ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “জাতীয় নির্বাচনের জন্য মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা দুটো ডেট ঘোষণা করেছেন। উইথ মিনিমাম রিফর্মস ডিসেম্বর, আর যদি ম্যাক্সিমাম রিফর্মস হয় আরর্লি নেক্সট ইয়ার বাই জুন। মে-জুন মাসে সাধারণত যদি হয় এপ্রিলের দিকে। আবার সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে ঐকমত্য কমিশন হয়েছে, যেটির মেয়াদ ছয় মাস।”
এরইমধ্যে কমিশনের প্রস্তুতির কথা তুলে ধরেন তিনি।
সিইসি বলেন, “ছয় মাসকে মাথায় রেখে আমাদের চিন্তা করতে হবে যে, ক্যান উই রিয়েলি ওয়েট সিক্স মান্থস? আমাদের যদি বলা হয় মিনিমাম রিফর্ম করে ডিসেম্বরে ইলেকশন করতে চাই তাহলে আমাদের তো ছয় মাস বসে থাকার সুযোগ নেই।
”ডিসেম্বর হোক আর আগামী বছর হোক আমরা আর্লিয়েস্ট ধরে নিয়ে আমাদের প্রস্তুতির দরকার আছে। আমরা জোরেশোরে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছি।”
সবাই রাজনৈতিক সমঝোতার প্রত্যাশায় রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ঐকমত্য কমিশন নির্বাচনের তারিখ নিয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছাবে এমন কোথাও দেখিনি। ছয়টি রিপোর্ট কমিশন দিয়েছে, বিভিন্ন দলের কাছে পাঠিয়েছে দেখলাম। একটা নির্বাচন যখন হয় রাজনৈতিক সমঝোতা হলে ভালো। সবাই প্রত্যাশা করে একটা রাজনৈতিক সমঝোতা।”
অন্য কারো এজেন্ডায় না চললে গণ্ডগোল থাকার কথাও নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“প্রস্তুতি থেমে থাকবে না, প্রস্তুতি চলবে।…আমাদের ব্যক্তিগত এজেন্ডাও নেই, অন্য কারো এজেন্ডা বাস্তবায়নের নিয়েও ওয়ার্ক করছি না। এজেন্ডা নিয়েছি ১৮ কোটি দেশের মানুষের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে, গণতন্ত্রের দিকে তাকিয়ে, যাতে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর যাতে হতে পারে,” যোগ করেন তিনি।
ভোটা তালিকার চলমান হালনাগাদ কাজের তথ্য তুলে ধরে সিইসি বলেন, এরইমধ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হালনাগাদের সময় প্রায় ১৭ লাখ মৃত ভোটার তালিকায় পাওয়া গেছে।
“বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের নাম কাটা হয়েছে। ৩৫-৩৬ লাখ বাদ পড়া ভোটার রয়েছে। নতুন ভোটার রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। (হালনাগাদ না হলে) সব মিলিয়ে ৫৪ লাখের মতো বাদ পড়ে যেত।”
সম্প্রতি কক্সবাজারের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, উখিয়া-টেকনাফে অনেক বাংলাদেশি নাগরিক ত্রাণের আশায় রোহিঙ্গা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন।
“রিলিফ কমে গেছে, এদিকে এনআইডি করতে পারে না। আমাদের এখানে ওদের সাথে ক্রসম্যাচিং হচ্ছে তখন আটকে যাচ্ছে। তারা এখন আর বাংলাদেশি হতে পারছে না।”
কত ধরনের চ্যালেঞ্জ যে রয়েছে মাঠে না গেলে জানা যায় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সিইসি বলেন, “রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। অনেক সময় স্বামী রোহিঙ্গা, স্ত্রী বাংলাদেশি, আবার স্ত্রী বাংলাদেশি, স্বামী রোহিঙ্গা। এমন তথ্য আমরা পাচ্ছি। ছেলে মেয়ের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।…এসব জটিলতায় আমরা আছি। আমরা চেষ্টা করছি সমাধানের। কীভাবে সমাধান, কমিশনে আলাপ করে করতে হবে। স্থানীয় অফিসাররা দিন-রাত পরিশ্রম করছে।”
অপরদিকে সোশাল মিডিয়ায় একজনের পক্ষে-বিপক্ষে প্রচারণা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সহযোগিতা চান তিনি। বলেন, ইসির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই সোশাল মিডিয়ায়। এখন থেকে বলা শুরু হয়েছে পক্ষে-বিপক্ষে।
“আচরণবিধি যেটা করব, আমরা অ্যালাউ করার আগে শুরু হয়ে গেছে। শুধু পক্ষে নয়, প্রতিপক্ষের চরিত্র হননও শুরু হয়ে যাচ্ছে। এটা যাতে প্রার্থীর পক্ষে-বিপক্ষে না করে সেজন্য মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে।”
সরকার কিছু করতে গেলে মুশকিল বলে মন্তব্য করেন নাসির উদ্দিন। বলেন, “সোশাল মিডিয়ায় গুজব ছড়িয়ে গেলে মুশকিল। রিউমার মকারিং কীভাবে অ্যাড্রেস করব, এটা মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। এটা বিরাজ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, কীভাবে আচরণবিধি দিয়ে কন্ট্রোল করব।”
ভোটার তালিকা প্রস্তুতের পাশাপাশি সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে প্রস্তুতিও শুরু করতে চায় কমিশন।
সিইসি বলেন, “আইনি জটিলতায় কাজ শুরু করতে পারছি না। ইতোমধ্যে আমরা সরকারের কাছে আইন মন্ত্রণালয়ে সংশোধন প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আরও কিছু প্রস্তাব যাবে। সংস্কার কমিশন না হলেও এসব কাজ করতে হত। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মিনিমাম যে সংস্কার দরকার সেটুকু করার উদ্যোগ আমরা নিচ্ছি।”
তিনি বলেন, “পার্টি রেজিস্ট্রেশন, ডিলিমিটেশন হোক, যেখানে যেখানে কিছুটা সংশোধন দরকার সরকারের কাছে দেব। তা হয়ে গেলে বিধি সংশোধন করে ফেলব। আমাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। সর্বশক্তি দিয়ে প্রস্তুতি এগিয়ে নেব।”
অনুষ্ঠানে আরএফইডি’র নতুন কমিটির কাছে বিদায়ী কমিটি দায়িত্ব হস্তান্তর করে। এসময় চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসির সচিব উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন
সীমানা নির্ধারণ আইনের ‘জটিলতা’ কাটাতে সংশোধন প্রস্তাব পাঠাবে ইসি