আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করলে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হবে বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন।
Published : 18 Mar 2025, 12:27 AM
আদালতের দৃষ্টিতে ফেরারি আসামিকে ভোটে অযোগ্য রাখা, বেসরকারি সংস্থার কাযনির্বাহী পদে থাকা ব্যক্তির নির্বাচনে অংশ নিতে তিন বছরের অবসরের বিধান তুলে দেওয়া এবং ২০১৮ সালের ভোট জালিয়াতি নিয়ে আলাদা তদন্ত কমিশন গঠন নিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশে ভিন্ন মত দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
একই সঙ্গে ২০২৩ সালে নিবন্ধিত দলগুলোর নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ নিয়েও নিজেদের আপত্তি তুলে ধরেছে এএমএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
সংস্কার কমিশনের এসব সুপারিশের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে ঐকমত্য কমিশনে পাঠানো চিঠিতে ইসি বলেছে, ফেরারি আসামিকে প্রার্থী হতে বিরত রাখার বিধান করা হলে তা অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতে পারে।
পাশাপাশি বিদেশি সহায়তা ও তহবিল পাওয়া এনজিওর কর্তা ব্যক্তিদের অবসরের তিন বছর পার হলে প্রার্থী হওয়ার বিধানের পক্ষে মত দিয়ে ইসি।
একই সঙ্গে চিঠিতে অন্য নির্বাচন বাদ দিয়ে শুধু একাদশ সংসদ নির্বাচনের দায় নির্ধারণ এবং দ্বাদশ সংসদে নতুন দলের নিবন্ধন বাতিলে তদন্ত হলে তা পক্ষপাতদুষ্ট হবে বলে মত দিয়েছে বর্তমান কমিশন।
এছাড়া আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করলে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশনকে বলেছে নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অন্তত ১০টি সুনিদির্ষ্ট বিষয়ের দেড় ডজন সুপারিশের বিষয়ে ভিন্নমত মত পোষণ করেছে নির্বাচন কমিশন।
ঐকমত্য কমিশনের কাছে চিঠিতে ইসি কী মতামত দিল, সংস্কার কমিশনের কী প্রস্তাব ছিল তা তুলে ধরা হয়েছে।
এক মাসেরও আগে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ দেয় সরকারের কাছে। মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন এসব সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর মতামত নেওয়া শুরু হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক সংস্থা নির্বাচন কমিশন ‘স্বাধীনতা খর্ব’ হয় এমন কিছু সুপারিশের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে চিঠি দিল ঐকমত্য কমিশনের কাছে।
ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে পাঠানো ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে বলা হয়, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কতিপয় সুপারিশের বিপরীতে ইসির মতামত সম্বলিত একটি প্রতিবেদন অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে।
একই সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, সংসদ সচিবালয় সচিবকেও এটির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে।
বদিউল আলম মজুমদার নেতৃত্বোধীন নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অন্তত তিন সুপারিশ নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দিন।
বিশেষ করে কমিশন থেকে বিদায় নেওয়ার পর ইসির বিষয়ে তদন্তভার সংসদীয় স্থায়ী কমিটির হাতে দিলে এবং সীমানা পুননির্ধারণ ও ভোটার তালিকা নিয়ে স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ করার সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে তা ইসির স্বাধীনতা ‘খর্ব করবে’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
সোমবার ইসি সচিব বলেন, ৭-১০টি বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে। দুয়েকটি বিষয়ে আরো সম্প্রসারণ করে মতামত দেওয়া হয়েছে।
সংস্কার কমিশনের এসব সুপারিশ ইসির স্বাধীনতা খর্ব হবে- এমন বিষয়টি চিঠিতে তুলে ধরা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে সচিব বলেন, “মতামত দেওয়ার কারণটা কী। আমরা মনে করছি, খর্ব হচ্ছে বলেই তো মতামত দেওয়া। খর্ব না হলে তো মতামত দেওয়া হত না।
“আমাদের মতামত গ্রহণ করা বা না করার এখতিয়ার যাকে দেওয়া হয়েছে তার। আমাদের মতামত দেওয়ার সুযোগ রয়েছে” বলেন ইসি সচিব আখতার আহমেদ।
সংস্কার কমিশনের কী সুপারিশ
>> সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের জন্য ভবিষ্যতে একটি আলাদা ‘স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কমিশন’ গঠন করা।
>> জাতীয় নির্বাচন শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, ফলাফল গেজেটে প্রকাশের পূর্বে, ইসি নির্বাচনের সুষ্ঠতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সার্টিফাই করে তা গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ব্যবস্থা করা।
>> সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে বা শপথ ভঙ্গ করলে কমিশনের মেয়াদ পরবর্তী উত্থাপিত অভিযোগ প্রস্তাবিত সংসদীয় কমিটি তদন্ত করে সুপারিশসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর বিধান করা। অসদাচরণের জন্য ২০ বছরের কারাদণ্ড।
>> তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার মেয়াদ চার মাস নির্ধারণ করে এ মেয়াদকালে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা।
>> এনআইডি সেবা সুচারু করতে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিবর্তে আগামী সাত বছরের মধ্যে জাতীয় নাগরিক ডেটা কমিশন নামে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ কমিশন গঠন করা।
>> ইসি সচিবালয়- ইসির পক্ষে আইন প্রণয়নসহ ওভারসাইট কাযক্রম কমিশনের সঙ্গে আলোচনা না করে স্পিকারের নেতৃত্বে সংসদীয় কমিটি করবে।
>> মনোনয়ন দাখিলে ১০ দিন, বাছাইয়ে ৭ দিন, প্রত্যাহারে ১০ দিন ও প্রচারে ১৫ দিন সময় দিতে হবে।
>> সিইসি ও ইসি নিয়োগে নতুন বিধিমালা ও আচরণবিধি প্রণয়নের সুপারিশ। সংসদীয় কমিটির কাছে রিপোর্ট করা।
>> ইসির আর্থিক স্বাধীনতা-সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে অর্থ বরাদ্দ চাওয়া।
>> নির্বাচনি অপরাধ- ২০১৮ সালের ভোটের জালিয়াতির জন্য আলাদা তদন্ত কমিশন করা। অন্যান্য বিতর্কিত নির্বাচনের জন্য দায়ীদের তদন্তের আওতায় আনা যেতে পারে।
>> আইনি হেফাজতে ছাড়া সবাইকে সশরীরে মনোনয়নপত্র জমার বাধ্যবাধকতা।
>> কোনো আদালতে ফেরারি আসামি ঘোষিত ব্যক্তিকে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা।
>> বেসরকারি সংস্থার কাযনির্বাহী পদে থাকা ব্যক্তিকে প্রার্থী হতে তিন বছর আগে অবসরগ্রহণের বিধান বাতিল করা।
>> ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ। প্রশাসনসহ অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ।
>> ইসির দায়বদ্ধতা- আইনি, আর্থিক, প্রশাসনিক প্রস্তাবে সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানোর বিধান।
>> কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন ২০২৩ সালে যেসব বিতর্কিত দলকে নিবন্ধন দিয়েছে, তদন্ত সাপেক্ষে বাতিল করা।
>> প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের নির্বাচনি পোলিং এজেন্টদের সুরক্ষা দেওয়া।
>> স্থানীয় নির্বাচন-জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা।
ইসির ভিন্নমত যেখানে
কী কী বিষয়ে ভিন্নমত তুলে ধরা হয়েছে জানতে চাইলে ইসি সচিব বলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সার্টিফাই করার বিষয় রয়েছে।
”আমরা মনে করি-এটার দরকার নেই। রিটার্নিং অফিসাররা নিশ্চিত হয়ে ফলাফল দেন, গেজেট নোটিফিকেশন টাই ডকুমেন্টেশন। এজন্য বাড়তি সার্টিফাই করার দরকার আছে বলে মনে হয় না।”
>> এনআইডি নিয়ে সুপারিশ রয়েছে। ইসির অধীনে রাখাই কাম্য। স্বাধীন ডেটা কমিশন করলে ইসির সাংবিধানিক ক্ষমতা খর্ব হবে।
>> কমিশনারদের শাস্তির বিধানের সুপারিশ করা হয়েছে। এটা তো ভয়ংকর ব্যাপার। শপথ ভঙ্গ করলে নিষ্পত্তির পদ্ধতি রয়েছে।…নতুন করে এ ধরনের সুপারিশ কাম্য নয়।
>> সীমানা নির্ধারণে কমিশনের সুপারিশ রয়েছে। এটার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? এতে ইসির সাংবিধানিক ক্ষমতা খর্ব হবে।
>> সব নির্বাচন চার মাসের মধ্যে করতে হবে। এটা সম্ভব না। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করতে এক বছর সময় লেগেছে অতীতে।
>> ওভারসাইট কাযক্রম সংসদীয় কমিটির তত্ত্বাবধানে থাকলে সংবিধানের ১১৮ (১) ও (৪) এর সাংঘর্ষিক, তাই এটা অপ্রয়োজনীয়।
>> মনোনয়নপত্র জমা, বাছাই, প্রত্যাহার ও প্রচারণার সময় নির্ধারণের বিষয়টি আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
>> সংসদীয় কমিটির কাছে ইসির রিপোর্টিং অথরিটিতে পরিণত করা হবে। এ জন্য আলাদা আইনের প্রয়োজন নেই।
>> সংসদীয় কমিটির কাছে অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হলে কমিটির উপর নির্ভরশীলতা তৈরি হবে, যা ইসির স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করবে।
>> ২০১৮ সালের জন্য আলাদা তদন্ত কমিশন করলে অহেতুক সময়ক্ষেপন হবে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় সংক্ষুব্ধ রিট করতে পারেন। শুধু ২০১৮ নির্বাচনকে পযালোচনা ও দায় নির্ধারণ করা হলে তা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে।
>> মনোনয়নপত্র জমায় সশরীরে ও অনলাইনে দুটোই রাখতে হবে। শুধু সশরীরে হলে ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
>> ফেরারি আসামিকে ভোটে অযোগ্য ঘোষণার বিধান অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে।
>> বিদেশি সহায়তা বা ফান্ডপ্রাপ্ত এনজিও এর ক্ষেত্রে বর্তমান নিয়ম (অবসর/অব্যাহতি থেকে তিন বছর) বজায় রাখা জরুরি।
>> ইসি কর্মকর্তা ও অন্য কাডারের কর্মকর্তাদের রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিংয়ের দায়িত্ব দিতে সক্ষমতা, সিনিয়রিটি ভিত্তিতে অগ্রাধিকারক্রমে অনুশীলন করতে হবে।
>> ইসির আর্থিক, আইন ও প্রশাসনিক প্রস্তাবের বিষয়গুলো সংসদীয় কমিটির কাজ নয়, এটা নির্বাহী কাজ।
>> শুধু এক বছর ধরে (২০২৩ সালের দলগুলোর নিবন্ধন বাতিল) করলে তা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে ভিন্ন কথা।
>> কমিশন পুলিশ ও প্রশাসনের মাধ্যমে প্রার্থী তাদের এজেন্টদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। ভোটের দিন কেন্দ্রে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে।
>> আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করলে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হবে।
আরও পড়ুন-
সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আপত্তি জানিয়ে ঐকমত্য কমিশনে ইসির চিঠি
নির্বাচন ব্যবস্থা ভাঙায় দায়ীদের বিতাড়িত করার সুপারিশ করেছি: বদিউল
সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আপত্তি জানিয়ে ঐকমত্য কমিশনে ইসির চিঠি