লামায় রাতের আঁধারে ম্রোদের বাড়ি ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের অভিযোগ

রেংয়েন ম্রো পাড়ায় এ ঘটনার জন্য পাড়াবাসী লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেডের লোকজন জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন।

উসিথোয়াই মারমাবান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Jan 2023, 06:09 PM
Updated : 2 Jan 2023, 06:09 PM

বান্দরবানের লামা উপজেলায় রাতের আঁধারে ট্রাকভর্তি লোকজন এসে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ম্রো জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

রোববার রাতে উপজেলার সরই ইউনিয়নের রেংয়েন ম্রো পাড়ার এ ঘটনায় লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানির লোকজন জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন পাড়াবাসী।

এরই মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তবে এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ নাকচ করেছে রাবার কোম্পানি।

লামা রাবার কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক ইফতেখার আলম মজুমদার বলেন, “অনেক সময় তারা (ম্রো) নিজেরাও বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে আমাদের ওপর দায় চাপানোর অপচেষ্টা করে। আমরা কোম্পানি কোনোভাবেই এই ধরনের হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত না।” 

এ ব্যাপারে লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোস্তফা জাবেদ কায়সার সোমবার বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সর্বশেষ অবস্থা পর্যন্ত সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে সেই পরিপ্রেক্ষিতে ওসি এবং কেয়াজু পাড়ার পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি।”

“ঘর পোড়ানোর ব্যাপারে পুলিশ একটা টোটাল রিপোর্ট দেবে। সেগুলো আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাব।“

ওই এলাকায় ম্রো জাতিগোষ্ঠীর জুম জমিতে রাবার বাগান করা নিয়ে গত বছরের শুরু থেকেই দ্বন্দ্ব চলে আসছে।

গত বছরের ২৬ মার্চ লামা সরই ইউনিয়নে লাংকম ম্রো পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া ও রেংয়েন ম্রো পাড়া মিলে ৩৬টি পরিবার বসবাস করা ৪০০ একর জায়গায় রাবার ও কাজু বাদাম চাষের লক্ষ্যে লামা রাবার কোম্পানি আগুন দেয়। আগুনে প্রায় ৩৫০ একর বনভূমি পুড়ে বিরাণ হয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।  

ফলে কয়েক দিন ধরে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকটে পড়ে তিনপাড়ার ৩৬টি পরিবার। এরপর থেকে ৪০০ একর জমি রক্ষায় আন্দোলন করে আসছে পাড়াবাসী। এর মধ্যে রেংয়েন ম্রো পাড়ার একটি ঝিরিতে বিষ ঢালা ও ৩০০টি কলাগাছ কেটে ফেলার অভিযোগ আসে রাবার কোম্পানির লোকজনের বিরুদ্ধে।

তবে রাবার কোম্পানির কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ বারবার অস্বীকার করে বলছে, তারা ওই জমি ইজারা পেয়েছেন।

এর মধ্যেই রোববার রাতে সেখানে ম্রোদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটল।   

সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রেংয়েন ম্রো পাড়ার তিনটি ঘর আগুনে সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। অপর তিনটি ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয়েছে। পাড়ার অন্য দুটি ঘরে ভাঙচুর ও ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করে ফেলা হয়। ঘরের ভেতরে চাল, রান্না করা ভাত ও শীতের কাপড় এলোমেলো অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

পাড়ার বাসিন্দাদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। অনেক পরিবার খোলা আকাশের নীচে, রান্না করতে পারেনি। কোনো কোনো পরিবারের সব সদস্যকেও বাড়ি পাওয়া যায়নি।

রেংয়েন ম্রো কারবারি পাড়ার কারবারি (পাড়াপ্রধান) রেংয়েন ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোববার রাতে অতিরিক্ত ঠাণ্ডার কারণে কেউ কেউ উঠানে বসে আগুন পোহাচ্ছিল, কেউ ঘুমিয়ে পড়েছিল। এ সময় কয়েকশ লোক হঠাৎ করে এসে ভাঙচুর ও লুটপাট শুরু করে। পরে তিনটি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। কয়েকটি ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলে।

“প্রথমে রেংওয়াই ম্রোর ঘরে আগুন দেওয়া হয়। আমিও সেখানে আগুন পোহাচ্ছিলাম। তারা আসার সঙ্গে সঙ্গে রেংওয়াই ম্রোর ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করা শুরু করে। তারপর আমরা সেখান থেকে যে যার মত পালিয়ে যাই। পালানোর সময় আমার পিঠে একটি বড় লাঠি এসে পড়ে। নিচের একটা ঝিঁরিতে ঠাণ্ডায় আমরা দুজন রাত আড়াইটা পর্যন্ত লুকিয়ে ছিলাম।”

পাড়াপ্রধান আরও বলেন, “পালিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের পাড়াবাসী দেখেছে, পাড়া থেকে আধা কিলোমিটার দূরে ছয়টি ট্রাক দাঁড়ানো ছিল। সেখানকার লোকজনের সবার হাতে একটা করে লাঠি ও দা ছিল। আমাদের ধারণা, ছয়টি ট্রাকে অন্তত ২০০ থেকে ২৫০ লোক ছিল।“

যার ঘরে প্রথম আগুন দেওয়া হয় সেই রেংওয়াই ম্রো বলেন, “পাড়ার কারবারিসহ কয়েকজন মিলে ঠাণ্ডার কারণে আগুন পোহাচ্ছিলাম। রাবার কোস্পানির লোকজন এসে প্রথমে আমার ঘরে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ঘরটি পুড়ে সম্পূর্ণ ছাই হয়ে যায়। কারবারিসহ আমরা দুজন লাফ দিয়ে ঝিঁরিতে লুকিয়ে ছিলাম। আমার দুই ছেলে, দুই মেয়ে অন্যদিকে পালিয়ে যায়।”

“সকালে এসে দেখি, আমার ঘর সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে আছে। এমনকি তিনটা বাচ্চাসহ একটি মা ছাগল ছিল। তারা মা ছাগলটাকে ধরে নিয়ে যায়। পরিবারে সবাই সকাল থেকে আধপেটা হয়ে ছিলাম।“

আরেক ক্ষতিগ্রস্ত সিংচং ম্রো (৩৫) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১২ ডিসেম্বর থেকে ঘর তৈরি করছি। ২৮ তারিখে নতুন ঘরে উঠেছি। এক ছেলে ও বউ নিয়ে ছিলাম। তারা রাতে এসে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিল।”

তিনি আরও বলেন, “আগুন লাগানোর সময় ‘মুরুংদের ধর, ধর, মার, মার’ বলে চিৎকার করছিল তারা। তখন রাবার কোম্পানির লোকজনের মধ্যে আব্দুল মালেক, দেলোয়ার, রাজু, নুরু, শাহ মিয়া ও তার ছেলে মহসিনের আওয়াজ শুনা গেছে।”

পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে দুই ছেলেকে নিয়ে বসেছিলেন বিধবা মাওরুম ম্রো। তিনি বলেন, পাড়াবাসীদের সহযোগিতায় ঘরটা তৈরি করা হয়েছিল। ঘরে থাকা সব জিনিসপত্র আগুনে পুড়ে গেছে। দুই ছেলের জন্মনিবন্ধন, তার জাতীয় পরিচয়পত্র এবং এক বস্তা চাল পুড়ে সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়েছে।

রেংয়েন ম্রো পাড়ার ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, পাড়ার বাসিন্দা রেংয়ুং ম্রোর (৪০) ঘর তছনছ করা হয়েছে। ভাঙ্চুর করা ঘরের বেড়া খুলে নিচে পড়ে রয়েছে। খাঁচার পাশে তিনটি বাচ্চা মুরগি মরে পড়ে আছে। ঘরের ভেতর চাল, মিষ্টি কুমড়া ও অন্যান্য জিনিসপত্রও এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।

রেংয়ুং ম্রো ও তার স্ত্রী সংলেও ম্রো বলেন, প্রথমে তাদের ঘরের বেড়া খুলে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করে ফেলার পর যাওয়ার সময় ঘরের সবগুলো দা ও কোদাল নিয়ে যায় তারা। সঙ্গে কয়েকটা মুরগিও ধরে নিয়ে যায়। এমনকি মেয়ের দিনমজুরি করে জমিয়ে রাখা সাত হাজার টাকাও লুট করে নিয়ে যায়।

দুদিন আগে চিম্বুক পাহাড় থেকে সেখানে বেড়াতে আসা পারাও ম্রো অভিযোগ করে বলেন, শীতের কাপড়ের ব্যাগে তার ১১ হাজার ২০০ টাকা চামরুং ম্রোর ঘরে রাখা ছিল। সকালে রাস্তায় ওই টাকার ব্যাগ ও দুটি মোবাইল পোড়ানো অবস্থায় পাওয়া যায়।

পাড়াবাসী অভিযোগ করেন, রাতে ভাঙচুর ও আগুন লাগানো সময় ভয়ে রেংয়ুং ম্রো আরেক ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। একদল লোক সেখানে গিয়েও হামলা চালায়।

পাড়ার কারবারি রেংয়েন ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনার আগের দিন শনিবার বিকালেও রাবার কোম্পানির লোক আব্দুল মালেক ও দেলোয়ার পাড়ায় এসেছিল। তাদের সঙ্গে এসআই শামীম ছিলেন। এরপর রোববার রাতে পাড়ায় ঘরে আগুন লাগানো ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।”

রোববার দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে রেংয়েন ম্রো পাড়ায় পরিদর্শনে আসেন পাশের কেয়াজু বাজার পুলিশ ফাঁড়ির  এসআই শামীমসহ সদস্যরা।  

এ সময় এসআই শামীম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে দুটি পক্ষ রয়েছে। একটি ম্রো সম্প্রদায় আর অন্যটি রাবার কোম্পানি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য যেকোনো পক্ষ অভিযোগ দিলে আমরা সেখানে যাই। খবর পেয়ে আজকে (সোমবার) ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেছি।”

পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “এ ঘটনার জন্য পাড়াবাসী রাবার কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ দিচ্ছে। আমরা তদন্ত করব। তদন্তে প্রমাণিত হলে যেই হোক তারা শাস্তি পাবে।“

ভাঙচুর ও অগ্নি-সংযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে লামা সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনোয়ারুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক কথায় হার্ড দ্য নিউজ, রিসিভ দ্য নিউজ। এরপরে ইনভেস্টিগেশন। এরপরে আরও ভাল জানবেন ওসি ও পিএস (পুলিশ সুপার)।”

লামার ইউএনও মো. মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের ব্যাপারে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বা কোনো সিদ্ধান্ত এলে তা দেওয়া হবে। তবে আগে থেকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পাড়াবাসী ও রাবার কোম্পানি যার যার অবস্থানে যেন থাকে। বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সেখানে নতুন করে কোনো কিছু স্থাপনা করা যাবে না বলা হয়েছিল।”

লামা রাবার কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক ইফতেখার আলম মজুমদার বলেন, “দুদিন আগে পাড়াবাসী সেখানে কয়েকটি ঘর তুলেছেন। সেখানে রাবার চারা লাগানোর জন্য ড্রেজিং করে ধাপ করা হয়েছিল। বিষয়টি কর্মচারীরা আমাদের জানান। তখন আমরা থানায় এ নিয়ে অভিযোগ করি। তারপর পুলিশও আমাদের জানায়।”

“আজ দুপুরে শুনতে পারছি সেখানে বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এটা শুনে আমরা সেখানে কর্মচারীদের যেতে বলি। কর্মচারীরা গিয়ে সেখানে কয়েকটি বাড়ি ভাঙচুর দেখতে পায়। তবে রাতের আঁধারে কে বা কারা সেটি করেছে তা আমরা জানতে পারিনি।”

এ বিষয়ে জানতে বিকালে জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজিকে ফোন করা হলে তিনি তার রিসিভ করেননি।

আরও পড়ুন:

লামায় জুমভূমির জঙ্গল কাটার অভিযোগ রাবার কোম্পানির বিরুদ্ধে

পাহাড়ের ৪০০ একর জমি ইজারা পাওয়ার দাবি লামা রাবার কোম্পানির

পাহাড়ি ঝিড়িতে ‘বিষ ছিটানোর’ প্রতিবাদে মানববন্ধন

লামায় এবার ৩০০ কলাগাছ কাটার অভিযোগ রাবার কোম্পানির বিরুদ্ধে

লামায় খাবার পানির ঝিরিতে বিষ দেওয়ার অভিযোগ

লামায় আদিবাসীদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি

বান্দরবানের লামায় ‘জুমের বাগান পোড়ানোয়’ উদ্বেগ

জুমভূমিতে আগুন: সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হল মিটিং

জুমভূমিতে আগুন: 'খাদ্য সংকটে' লামার ৩ পাড়ার ৩৬ পরিবার