এর মধ্যে দিয়ে টানা ১২ দিনের আন্দোলনের পরিসমাপ্তি হলো।
Published : 20 Aug 2022, 05:17 PM
দৈনিক মজুরি ১৪৫ টাকা করার প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে টানা ১২ দিনের আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে ফেরার ঘোষণা দিয়েছেন চা শ্রমিকরা।
শনিবার বিকাল ৪টার দিকে আন্দোলনকারী সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল সাংবাদিকদের বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবনাকে গ্রহণ করে উনার সম্মান রক্ষার্থে আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, এই সিদ্ধান্ত প্রতিটি চা বাগানে নেতৃত্বের মাধ্যমে তৃণমূলের কাছে যাবে। রোববার থেকে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেবেন।
এর আগে বিকাল ৩টায় শ্রম অধিদপ্তরের মৌলভীবাজারে ভানুগাছ রোডের বিভাগীয় কার্যালয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন চা শ্রমিকদের প্রতিনিধিদল।
এ সময় সেখানে হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি, মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের স্থল থেকেই আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন চা শ্রমিক নেতা।
এ সময় শ্রম অধিদপ্তরের মহাপিরচালক খালেদ মামুন চৌধুরী বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের সভাপতিত্বে আমরা সভায় বসেছিলাম। সেই সভায় বাগান মালিক নেতারাও ছিলেন। আমরা সেখানে একটা সিদ্ধান্ত নেই। সচিব মহোদয় প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি জানান। প্রধানমন্ত্রী ১৪৫ টাকার নির্দেশ দেন। চা শিল্পের স্বার্থে শ্রমিকদের অনুরোধ করা হয়েছে তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করার জন্য।”
“আজকে আমরা প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনাই চা শ্রমিকদের বলেছি। তারা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। এজন্য চা শ্রমিকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।”
দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে ৯ অগাস্ট থেকে টানা আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন দেশের ২৪১টি চা বাগানের প্রায় সোয়া লাখ শ্রমিক। প্রথম চারদিন শ্রমিকরা প্রতিদিন দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেন। তারপর তারা বাগানের কাজে ফেরেন। কিন্তু ১৩ অগাস্ট থেকে কাজে না গিয়ে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন শুরু করেন শ্রমিকরা। তারা এ সময় বাগানের সেকশনে এবং রাজপথেও মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন করেন।
এর মধ্যে বেশ কয়েকবার শ্রম অধিদপ্তরের সঙ্গে এবং একবার ঢাকায় মালিকদের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হলেও তাতে কোনো ফল আসেনি। ফলে পাতা তোলার ভরা মৌসুমেও শনিবার টানা ১২ দিনের মতো আন্দোলন ও কর্মবিরতিতে ছিলেন শ্রমিকরা। মালিকপক্ষ দাবি করছিলেন, এই সময়ে ধর্মঘট থাকায় পাতা তোলতে না পরায় বাগানের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে।
দুপুর থেকেই শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারের বাগানে বাগানে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন- এমন একটি খবর প্রচার হতে থাকে। শ্রমিকরা তখন বাগানে সমাবেশ, মিছিলে ছিলেন। তারা বাগান ছেড়ে শ্রম অধিদপ্তরের কার্যালয়ের সামনে জড়ো হন। শ্রমিক নেতারা যখন ভিতরে বৈঠক করছিলেন, তখন বাইরে প্রচুর শ্রমিক অপেক্ষা করছিলেন।
এর মধ্যেই বিকালে বৈঠক শেষে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে টানা ১২ দিনের আন্দোলন শেষ হলো। উপস্থিত শ্রমিকদের মধ্যে অবশ্য কেউ কেউ দাবি না মানার কথাও বলেন।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল সাংবাদিকদের সামনে এসে বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে চা শ্রমিকরা ধর্মঘটে যুক্ত আছেন। দীর্ঘদিন ধরে যে দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছেন চা শ্রমিকরা, তা হচ্ছে- ৩০০ টাকা মজুরি করার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর যে নির্দেশনা আমাদের এমপি সাহেবের মাধ্যমে বা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পেয়েছি সেটা আমরা বলতে চাই।”
“আপনারা যে সিদ্ধান্তটা হয়েছে, আমরা যেটা জানতে পেরেছি, (বাগান মালিকদের সংগঠন) বাংলাদেশীয় চা সংসদের সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি। তারপরও আমরা প্রধানমন্ত্রীকে মানি। তার যে প্রস্তাবনা, সেটা আমরা মানি। প্রধানমন্ত্রীকে আমরা সম্মান করি।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত ছিলো। সেটা প্রত্যাহার করব। সকলকে আমরা অনুরোধ করব, আমাদের যে সিদ্ধান্ত, প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, আমরা আপনাদের কাছে তুলে ধরছি।”
নৃপেন পাল বলেন, “পাশাপাশি আমরা অনুরোধ করব, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবনা বর্তমানে আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু পরবর্তীতে লাখ লাখ চা শ্রমিক আছেন, তারা যেন কথা বলতে পারেন, সাধারণ শ্রমিকরা যেন কথা বলতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।”
পরে মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ নিয়েই আমরা এখানে এসেছি। শ্রমিকদের মজুরি ২৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর শেষে শ্রমিকদের সঙ্গে বসবেন।”
বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বলেন, “উনারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, আমাদের ১৪৫ টাকা মজুরি দেওয়া হবে এবং তিনি ভারত সফর শেষে ফিরে আসার পর আমাদের সঙ্গে বসবেন। আমাদের দাবি ৩০০ টাকার; ১৪৫ টাকায় চলা সম্ভব না। আমরা চাই, প্রধানমন্ত্রী এটা পুনরায় বিবেচনা করুন।”
“প্রধানমন্ত্রীর সম্মান রক্ষার্থে আপাতত আমরা ধর্মঘট স্থগিত করলাম। পরবর্তীতে আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসে মজুরি কাঠামো নিয়ে আলোচনা করব।”
চা শ্রমিক নেতা পংকজ কান্দু বলেন, “যে ১৪৫ টাকা মজুরির কথা বলা হয়েছে আমরা সেটা পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ করেছি। শ্রম অধিদপ্তরের ডিজি ও সংসদ সদস্য জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষ করে এসে আমাদের সঙ্গে বসবেন। সেখানে আরও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাকে সম্মান করে আমরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছি।”
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশীয় চা সংসদের আইন অনুযায়ী, শ্রমিকদের বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, রেশন, পানীয় জলের ব্যবস্থা ও বোনাসসহ ন্যায্যমজুরি নিশ্চিত করবে বাগান মালিক।
মজুরি বাড়ানোর জন্য প্রতি দুই বছর পর পর বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশীয় চা সংসদের মধ্যে সমঝোতা বৈঠক হবে। সেই বৈঠকে উভয়ের আলোচনায় ঐক্যমতের পর চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এই চুক্তি অনুযায়ী, পরবর্তীতে দুই বছর শ্রমিকরা বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যাবেন।
চা শ্রমিকদের সঙ্গে সবশেষ দ্বি-বার্ষিক চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। এর পর পরই বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশীয় চা সংসদের কাছে ২০ দফা দাবিনামায় ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরি দাবি করেন। এ নিয়ে দফায় দফায় এ পর্যন্ত ১৩টি বৈঠকও হয় দুই পক্ষের মধ্যে। কিন্তু দাবির বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ করেন শ্রমিক নেতারা।
শ্রমিক নেতারা জানান, গত ৩ অগাস্ট চা বাগানের মালিকদের কাছে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর জন্য এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। কিন্তু তারা সেটায় কর্ণপাত করেননি।
এর প্রতিবাদে ৯ অগাস্ট থেকে সারাদেশের চা বাগানে দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করে শ্রমিকরা। কর্মবিরতি শেষে তারা কাজে ফিরছিলেন। এরপরও মালিকপক্ষ দাবি মেনে না নেওয়ায় শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে যায়।
এর মধ্যে ১১ অগাস্ট হবিগঞ্জের ২৪টি চা বাগানের ১০ জন শ্রমিক নেতার সঙ্গে শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের কর্মকর্তারা বৈঠকে বসলেও আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। ২৮ অগাস্ট বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব রেখে শ্রমিকদের আন্দোলন থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু শ্রমিকরা এতে সম্মত হননি।
১৩ অগাস্ট শ্রমিকরা পূর্ণদিবস ধর্মঘটে যান। ১৪ অগাস্ট ছিল রোববার; সাপ্তাহিক ছুটি। এদিন শ্রমিকরা শ্রীমঙ্গলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে স্মারকলিপি দেন। এতে বেতন বৃদ্ধির জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে শ্রমিকরা আন্দোলন শিথিল রাখে। ১৬ অগাস্ট থেকে ফের ধর্মঘট শুরু হয়। এদিন শ্রীমঙ্গলে শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করলেও কোনো ফল আসেনি।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ ঢাকায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। কিন্তু সেখানেও কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় শ্রমিকরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।