অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে চা শ্রমিকরা

শনিবার সকালে সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের চা বাগানের শ্রমিকরা ধর্মঘটে সামিল হয়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 August 2022, 06:36 AM
Updated : 13 August 2022, 10:41 AM

দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করার দাবিতে সাময়িক কর্মবিরতিতে কাজ না হওয়ায় এবার অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে গিয়েছেন চা শ্রমিকরা; এতে ভর মৌসুমে বেকায়দায় পড়েছেন বাগান কর্তৃপক্ষ।

শনিবার সকাল থেকে সিলেট ভ্যালির ২৩টি, হবিগঞ্জের ২৪টি এবং মৌলভীবাজারের ৯২টি বাগানসহ মোট ২৪১টি চা বাগানের শ্রমিক একযোগে এ ধর্মঘট শুরু করেন।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে শ্রমিকরা এই কর্মসূচি পালন করছেন। এর আগে ৯ অগাস্ট থেকে প্রতিদিন দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করছিলেন তারা। কর্মবিরতি শেষে দিনের বাকি সময়ে তারা কাজে ফিরেছিলেন।

তবে দাবি না মানলে বাগান অচল করে দেওয়ার হুমকি তখনি দিয়েছিলেন শ্রমিক নেতারা। এর মধ্যে শ্রমিকদের সঙ্গে শ্রম অধিদপ্তরের আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস পাননি শ্রমিকরা। এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটে গেলেন তারা।

সিলেট:

সকালে সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানের সামনে সিলেট-বিমানবন্দর সড়কে মিছিল ও সমাবেশ করেন চা শ্রমিকরা। এ ছাড়া মালনিছড়া, খাদিমনগর, কেওয়াছড়া, দলদলি, জাফলং ও লালাখালসহ বিভিন্ন চা-বাগান এলাকায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তারা।

সমাবেশে চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, “গত ৩ অগাস্ট আমরা চা বাগানের মালিকদের কাছে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর জন্য এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা সেটায় কর্ণপাত করেননি।

“এর প্রতিবাদে ৯ অগাস্ট থেকে সারাদেশের সকল চা বাগানে দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করে যাচ্ছি। এরপরও মালিকপক্ষ দাবি মেনে না নেওয়ায় আমরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হয়েছি।”

এ সময় চা শ্রমিকরা বলেন, মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বাধ্য হয়েই তারা কর্মবিরতি পালন করছেন। দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে।

চা শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন এবং নিম্ন মজুরিতে তাদের সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করেন শ্রমিক নেতা রাজু।

তিনি বলেন, “জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের মূল্য বাড়ছে; এতে পরিবার নিয়ে দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরির দাবি জানিয়ে প্রায় দুই বছর আগে আবেদন করলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।”

তাছাড়া প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর চুক্তি নবায়ণ করার নিয়ম থাকলেও এবার তা বাস্তবায়নে বাগান কর্তৃপক্ষ কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন এই শ্রমিক নেতা।

হবিগঞ্জ:

সকালে হবিগঞ্জের চান্দপুর চা বাগানের শ্রমিকরা কাজে না গিয়ে বাগানের বিভিন্ন সেকশনে মিছিল ও সমাবেশ করেছেন। এ ছাড়া সমাবেশের খবর পাওয়া গেছে দেউন্দি চা বাগান এলাকা থেকে।

কর্মবিরতিতে মিছিল ও সমাবেশ করেছেন জেলা বাহুবল সদর ও মোসাই চা বাগান এলাকার শ্রমিক। এ ছাড়া বিভিন্ন বাগানে শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করেছেন বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, “একযোগে দেশের ২৪১টি চা বাগানে মজুরি বাড়ানোর আন্দোলন চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়ে যাওয়ার পরও চা শ্রমিকরা ১২০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন। গত বছর চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাগান মালিকদের চুক্তি স্বাক্ষর অনুযায়ী দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার কথা। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি।”

এজন্য বুধবার থেকে দিনে দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করা হয়। শনিবার সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি পালন করা হচ্ছে।

নৃপেন আরও বলেন, “দাবি মানা না হলে শ্রমিকরা কাজে ফিরবেন না। প্রয়োজনে তারা রাস্তায় নামতে বাধ্য হবেন।”

শ্রমিক নেতারা বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হবিগঞ্জের ২৪টি চা বাগানের ১০ জন শ্রমিক নেতার সঙ্গে শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের কর্মকর্তারা বৈঠকে বসলেও আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। এজন্য অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ডাক দেওয়া হয়েছে। এতে বাগানগুলোতে পুরোপুরিভাবে উৎপাদন বন্ধ থাকবে।

শ্রীমঙ্গলে বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নাহিদুল ইসলাম বলেন, “শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আমাদের এক ঘণ্টার বৈঠক হয়েছিল। ২৮ আগস্ট বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব রেখে শ্রমিকদের আন্দোলন থেকে সড়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু শ্রমিকরা এতে সম্মত হননি।”

মৌলভীবাজার:

সকালে বাগান ছেড়ে মৌলভীবাজার-ঢাকা মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শ্রমিকরা। একই সঙ্গে শ্রীমঙ্গল স্টেশন রোড, ভানুগাছ রোড, গুহ রোড ও কলেজ রোডে বিক্ষোভ মিছিল করেন তারা।

এ ছাড়া চা শ্রমিকরা শ্রীমঙ্গলের আমরইলছড়া চা বাগানে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন। চাতালী ডিভিশনের শ্রমিকরা ফুলছড়ি চা বাগানে জড়িত হয়ে মিছিল করেছেন।

রোববার সাপ্তাহিক ছুটি এবং সোমবার জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি কিছুটা শিথিল থাকবে। এরপর ১৬ অগাস্ট থেকে পুরোদমে দিনব্যাপী কর্মবিরতির আন্দোলন চলবে বলে জানান বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা।

তিনি আরও জানান, আন্দোলনের বিষয়ে বাংলাদেশ শ্রম অধিদপ্তরের ডিজি শুক্রবার বিকেলে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন। এতে চা পাতা উত্তোলনের ভরা মৌসুমে আন্দোলন না করে সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

শনিবার বিকালে শ্রীমঙ্গলের বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা বৈঠকে বসবেন বলে জানান বিজয় হাজরা।

তিনি আরও বলেন, “আমরা এখন আলোচনায় মজুরিকেই গুরুত্ব দিচ্ছি। বাগান কর্তৃপক্ষ বোনাস কিছুটা বাড়িয়েছে। আগে বোনাস দেওয়া হতো ৪৭ দিনের মজুরির সমান। এখন দেওয়া হবে ৫২ দিনের। অর্থাৎ পাঁচ দিনের হাজিরা সমান অর্থ মূল বোনাসের সঙ্গে সংযুক্ত হবে।”

“বেতনের ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ বাড়িয়েছে ১৪ টাকা। আগে ছিলো ১২০ টাকা এখন হয়েছে ১৩৪ টাকা। যা মানসম্মত নয়। আর চার মাস গেলে দ্বি-বার্ষিক চুক্তি দুটির মেয়াদ অতিক্রম করবে। অর্থাৎ দুই দফা বেতন বাড়ত। সে হিসেবে ৩০০ টাকা মজুরি নায্যদাবি।”

অপরদিকে বাংলাদেশীয় চা সংসদের সিলেট শাখার চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, সমঝোতা চুক্তির মধ্যে কর্মবিরতি ও আন্দোলনে যাওয়া সম্পূর্ণ অনৈতিক। এরই মধ্যে শ্রমিকদের বিষয়গুলো নিয়ে ১৩টি বৈঠক হয়েছে। ফলপ্রসূ আলোচনাও হয়েছে।

“তাদের বোনাস বৃদ্ধি, গামছা ও টুকরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। বর্ধিত মজুরিরও একটি প্রস্তাবনা আমরা দিয়েছি। এই শিল্পকে তো টিকিয়ে রাখতে হবে। গত ১০ বছর ধরে চা পাতার মূল্য বাড়েনি। কিন্তু ১০ বছরে চা শ্রমিকদের বেতন কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “দুই টাকা কেজি দরে শ্রমিকদের সপ্তাহে একবার আটা দেওয়া হয়। বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা সবকিছুই আমরা দিচ্ছি। এই হিসাব করলে তাদের দৈনিক মজুরি দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৩০০ টাকা।”

Also Read: বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ২৪১ চা বাগানে চলছে কর্মবিরতি