Published : 02 May 2025, 01:30 AM
ভারত থেকে নেমে আসা সুতাং নদী একসময় হবিগঞ্জ ও সংলগ্ন বিস্তৃর্ণ এলাকার কৃষিকাজের সেচ, যোগাযোগ, মৃত্তিকা শিল্প ও দৈনন্দিন কাজে অপরিহার্য থাকলেও শিল্পের বর্জ্যে এখন এই স্রোতস্বিনীর প্রাণ যায় যায়।
কৃষকরা অভিযোগ করছেন, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার অলিপুরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা কল-কারখানার দূষিত বর্জ্যে নদীটি এখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, এর পানি সেচকাজে ব্যবহার করলে ধান গাছও মরে যায়।
কালো কুচকুচে জলের এই নদীতে মাছ, জলজ প্রাণী বা উদ্ভিদের বেঁচে থাকা তো দূরের কথা; পরিবেশ দূষণের কারণে নদীর আশপাশে মানুষের বসবাস করাও এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও জলজসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের একটি দলের গবেষণায় এ নদীর জলে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিকও পাওয়া গেছে।
নদীটির অববাহিকা অঞ্চলের নদ-নদীর মাছ ও ফসলেও এই মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করবে। যেহেতু নদীটি হাওরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, ফলে সেখানকার বোরো ধানও নিরাপদ না- এমনটা মনে করছেন গবেষকরা।
গবেষণা প্রকল্পের প্রধান এবং হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও জলজসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক মো. শাকির আহম্মেদ বলছিলেন, “আমরা এরই মধ্যে নিশ্চিত হয়েছি যে, পানি ও মাছের নমুনায় মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। বর্তমানে ভারী ধাতুর উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য আরও পরীক্ষা চলছে।”
ইটিপি আছে, ইটিপি নেই
বাংলাদেশ নদী কমিশনের ১২০৬ নম্বরে রয়েছে সুতাং। বাংলাদেশ ও ভারতের এই আন্তঃসীমান্ত নদীর দৈর্ঘ্য ৮১ কিলোমিটার। হবিগঞ্জ সদর, লাখাই, শায়েস্তাগঞ্জ ও চুনারুঘাট উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এ নদী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ নদীর দৈর্ঘ্য ৮১ কিলোমিটার হলেও এর অববাহিকা প্রায় ৪০০ কিলোমিটারের। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আসা নদীটি লাখাই উপজেলার কালনী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
সারাবছর পানি থাকায় হাওর অঞ্চলের এই নদী এক সময় যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে খনন না হওয়া এবং অলিপুরে অপরিকল্পিতভাবে ইন্ড্রাস্টিয়াল পার্ক গড়ে উঠায় শিল্প বর্জ্যে নদীর রূপ পাল্টাতে থাকে।
নদী তীরবর্তী করাব, ছড়িপুর, উচাইল, রাজিউড়া, সাধুরবাজার, মির্জাপুর, ঘোড়াইল চর, রহিমপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নদীর পানি কালো কুচকুচে হয়ে আছে। পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। নদীর দূষিত পানিতে মরে আছে জলজপ্রাণী।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, অলিপুরের ৩০ থেকে ৩৫টি কল-কারখানার দূষিত বর্জ্য সরাসরি সুতাং নদীতে ফেলা হচ্ছে। অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নেই প্রয়োজনীয় বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি)। যেসব কোম্পানিতে ইটিপি রয়েছে সেগুলো অতিরিক্ত খরচের ভয়ে নিয়মিত চালানো হচ্ছে না। এগুলো বন্ধ রেখে কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সুতাং নদীতে।
ফলে নদী তীরবর্তী বুল্লা, করাব, লুকড়া, নূরপুর, রাজিউড়াসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের গ্রামে মানবিক বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
দূষণের পরিস্থিতি বর্ণনা করে সাধুর বাজার এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক গুলনাহার বেগম বলছিলেন, “নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। আমরা স্কুলে আসা-যাওয়ার সময় নাখ-মুখ ঢেকে আসতে হয়। গন্ধে এলাকায় থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।”
একই কথা বলছিলেন ভাদগরি গ্রামের শফিক মিয়া। তিনি বলেন, “সুতাং নদীর পানি বিষাক্ত হওয়ার কারণে আমরা দুর্ভোগে আছি। জীবিকার তাগিদে আমরা নদী পার হয়ে আসা-যাওয়া করি। পানি শরীরে লাগলেই চুলকায়।”
‘অপরিকল্পিত’ শিল্পায়নের ফলে সেখানকার কৃষি, পরিবেশ ও জৈব-বৈচিত্র্যে ভারসাম্যহীন অবস্থা তৈরি হচ্ছে মন্তব্য করে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জহিরুল হক শাকিল বলেন, “সুতাং নদী সম্পূর্ণভাবে বিপন্ন হয়ে গেছে শুধু হবিগঞ্জের শিল্পায়নের জন্য। এই শিল্পায়ন এবং প্রবৃদ্ধি মানুষের জন্য। এখন যদি মানুষই না থাকে তাহলে ভোগ করবে কে? নদীর পানি কালো আলকাতরার মতো প্রবাহিত হচ্ছে।”
একই বিষয়ে নজর রেখে কথা বলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল।
তিনি বলেন, “সুতাং নদী এবং আশপাশের খাল-বিলের চিত্র দেখলেই বোঝা যায়, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন দেশের উন্নয়ন নয় বরং ধ্বংস ডেকে আনছে। নদী, খাল, বিল, জলাশয়ে শিল্পবর্জ্য নিক্ষেপের ফলে এই অঞ্চলের কৃষি ও পরিবেশে বিপর্যয় নেমে এসেছে।
“দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সব ধরনের শিল্পবর্জ্য ‘উৎসে পরিশোধন’ বাধ্যতামূলক হলেও এই অঞ্চলে তা একেবারেই মানা হচ্ছে না। কল-কারখানাগুলো শুরু থেকেই বেপরোয়াভাবে দূষণ চালিয়ে আসছে, যা সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের সাংবিধানিক অধিকারের ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত।”
‘পানি জমিতে দিলে ধানের চারাও মরে যায়’
বিশাল হাওরের বোরো ধানের জন্য সেচের প্রয়োজন হয়। এর একটা অংশ নদী থেকেও আসে। সুতাং নদীর অববাহিকায় সেচের জন্য এর পানি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু দিন দিন সেই সক্ষমতা কমে আসছে।
সেই আফসোস থেকেই সাধুর বাজার এলাকার ব্যবসায়ী মহসিন আহমেদ বলছিলেন, “পানি এতটাই দূষিত হয়েছে যে, নদীর পানি ধানের জমিতে দিলে ধানের চারা মরে যায়। এখানকার গরু-ছাগল, হাঁস নদীতে নামানো হলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে।”
সুতাং নদীর লাখাই অংশে প্রতিবছর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূণ্যস্নান হয়। কিন্তু নদীর পানির কারণে এখন সেই পূন্যস্নানেও ভাটা পড়েছে।
বুল্লা এলাকার বাসিন্দা সুশীল চন্দ্র দাস বলেন, “বিভিন্ন স্থান থেকে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ পূণ্যস্নানে অংশগ্রহণ করে। এখন লোক কমে গেছে।
“দুর্গন্ধের জন্য আমরা তো ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ করেও থাকতে পারি না।”
সুরাবই পাল বাড়ির বাসিন্দা সুভাষ পাল বলেন, “আগে এই নদীর মাটি দিয়ে মৃৎশিল্পের কাজ করতাম। এতে আমাদের অনেক সুবিধা হত। এখন আর এই নদীর মাটি ব্যবহার করা যায় না।
“বিভিন্ন এলাকা থেকে মাটি ক্রয় করতে হয়। অনেকেই আবার মাটি বিক্রি করতে চান না। পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে বাড়তি দামে মাটি ক্রয় করতে হয়েছে।”
প্রয়োজন খনন
নদীটিকে বাঁচাতে হলে শিল্প-কারখানায় ইটিপির ব্যবহারের পাশাপাশি নিয়মিত খনন করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
রাজিউড়া গ্রামের বাসিন্দা আহাম্মদ আলী শামীম বলেন, “পুরনো এ নদীটি ড্রেজিংয়ের অভাবে অস্তিত্ব হারাচ্ছে। অবহেলা আর নজরদারির অভাবে বহমান এ নদীটি মরে যাচ্ছে। পাহাড়ি ঢল ও অতি বর্ষণের ফলে ভারত থেকে আসা উজানের পানি ও পলি মাটিতে ভরাট হয়ে নাব্য হারিয়েছে নদীটি। এটি খনন করা প্রয়োজন।”
একই দাবি জানান নুরপুর গ্রামের বাসিন্দা বলেন অনন্যা পাল।
স্থানীয়রা জানান, একসময় সুতাং নদীকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে বাঁশের সবচেয়ে বড় বাজার গড়ে ওঠেছিল। বর্ষাকালে ব্যবসায়ীরা বাঁশ কিনে নদী পথে নিয়ে যেতেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
কিন্তু সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। নদীটি রক্ষায় আন্দোলনও হয়েছে। কিন্তু কেউ এতে নজর দেয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফরিদুর রহমান বলেন, “সুতাং নদীকে বাঁচাতে আমরা কাজ করছি। নদীটি রক্ষায় যা যা করা প্রয়োজন আমরা তাই করব।”