Published : 02 May 2025, 01:56 AM
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির সাধারণত অলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন না। তবে কাশ্মীর নিয়ে কিছু মন্তব্য করে সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে তিনি আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন। আর তা কেবল পাকিস্তানেই নয়, সীমানা পেরিয়ে ভারত এবং বিশ্বের বিভিন্ন কূটনৈতিক কেন্দ্রেও।
ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিল জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত হন। এর কয়েক দিন আগে কাশ্মীর নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন আসিম মুনির। তার এসব মন্তব্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান ও আঞ্চলিক উত্তেজনায় তাদের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
জেনারেল মুনির পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে জনসম্মুখে তেমন কথা বলেননি। কিন্তু তার একটি মূখ্য বক্তব্যই ব্যাপকভাবে নজর কেড়েছে।
গত ১৭ এপ্রিল ইসলামাবাদে প্রবাসীদের সঙ্গে এক বৈঠকে জেনারেল মুনির বলেছিলেন, “আমরা হিন্দুদের থেকে সব দিক থেকে আলাদা।” কাশ্মীরকে ‘পাকিস্তানের গলার শিরা’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেছিলেন, “ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কাশ্মীরিদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম থেকে পাকিস্তান কখনও মুখ ফিরিয়ে নেবে না।”
পাকিস্তানের নেতারা অনেক বছর ধরেই এমন আদর্শিক বক্তব্য বা বিবৃতি দিয়ে এসেছেন। সেই হিসাবে মুনীরের বক্তব্যও হয়ত তেমন এক বিবৃতি হয়েই থেকে যেত। কিন্তু কাশ্মীরে হামলা পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।
মুনীরের মন্তব্যের মাত্র ৫ দিন পরই কাশ্মীরের পেহেলগামে জঙ্গি হামলার ঘটনাটি ঘটে গেছে। ফলে কাশ্মীর নিয়ে মুনীরের ওই মন্তব্য বিচার-বিশ্লেষণ করে একে তার এবং তার বাহিনীর পক্ষ থেকে অনেক বেশি আগ্রাসী হিসাবেই দেখা হচ্ছে।
যদিও কাশ্মীরে হামলার সঙ্গে মুনীরের বক্তব্যের সরাসরি যোগ নেই। তারপরও ভারতের পক্ষ থেকে মুনীরের মন্তব্য স্পষ্টভাবেই ‘উসকানিমূলক’ ও ‘ধর্মীয় বিভাজনমূলক’ বলা হচ্ছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, সময়কাল এবং ভাষ্য—উভয়ের মিল 'উদ্বেগজনক'।
এমনকি পাকিস্তানও মুনিরের মন্তব্যর কারণে বিপাকে পড়েছে। সংযম ধরে রাখার কথা বলা কিংবা ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক পথে চলার চেষ্টায় তারা জটিল অবস্থায় পড়েছে।
পাকিস্তানের নেতাদের এমন বক্তব্য নতুন কিছু না হলেও এবার তা এসেছে এমন একজনের কাছ থেকে, যাকে এখন পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি হিসেবে দেখা হয়। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে উত্তাপ যখন বারবার কাশ্মিরে হামলাকে কেন্দ্র করে চরমে পৌঁছেছে, তখন আসিম মুনিরের সর্বসাম্প্রতিক মন্তব্য নতুন করে আলোচনায় আসছে।
জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ জশুয়া টি হোয়াইট বলেন, “তার (আসিম মুনির) বক্তব্য নিছক বাগাড়ম্বর নয়। তিনি যে সুরে, বিশেষত হিন্দু–মুসলিম তফাৎ নিয়ে কথা বলেছেন, তাতে এটি অনেক বেশি উত্তেজক হয়েছে।”
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, দিল্লি এখন কূটনৈতিক ও সামরিক পর্যায়ে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “বক্তব্যটি যদি পরিকল্পিত হয়, তাহলে তা ভয়ংকর বার্তা বহন করে। আর যদি তাৎক্ষণিকভাবে বলে থাকেন, তবে তা দায়িত্বহীন।”
বিশ্লেষকদের মতে, মুনিরের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আগের চেয়ে প্রকাশ্য ও কৌশলগতভাবে আগ্রাসী অবস্থান নিচ্ছে। পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান কামার বাজওয়ার সময় যেখানে কূটনৈতিক যোগাযোগ ও সংযম ছিল মুখ্য, সেখানে মুনিরের কণ্ঠে সংঘাতের ডামাডোল।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক গবেষক আবদুল বাসিত বলেন, “মুনির এখন সামরিক ও রাজনৈতিক দুই দিক থেকেই চাপে আছেন। তার ভাষা ও কৌশল তাই আগের থেকে অনেক বেশি কঠোর।”
ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই কাশ্মীরকে পুরোপুরি নিজেদের বলে দাবি করে। কিন্তু কাশ্মীরের দুই অংশ শাসন করে দুই দেশ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছে এই কাশ্মীর অঞ্চল।
কাশ্মীর নিয়ে তিনটি যুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে দুই প্রতিবেশী দেশের। চলতি বছরের শুরুর দিকে মুজাফ্ফরাবাদে জেনারেল আসিম মুনির কাশ্মীর সংহতি দিবসে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “কাশ্মীরের জন্য ৩টি যুদ্ধ লড়েছি। দরকার হলে আরও ১০টি লড়ব।”
তার সেইসব কথা এবং সর্বশেষ হিন্দুদের নাম করে বিষোদগার আর এর কয়েকদিনের মাথায় কাশ্মীরে হামলা-- এসব ঘটনাপ্রবাহ দেখে বিশ্লেষকদের ধারণা, ভারতের সঙ্গে হয়ত সরাসরি যুদ্ধেই জড়াতে চাইছেন মুনির। জঙ্গি হামলার মাধ্যমে তিনি সেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন।
ভারতীয় কর্মকর্তারা এখন জেনারেল আসিম মুনিরের সব বক্তব্যের সঙ্গেই পেহেলগামে হামলার যোগসূত্রতার ইঙ্গিত করছেন। যদিও এর কোনও প্রমাণ তারা হাজির করতে পারেননি। তবুও মুনির যে সময়ে কাশ্মীর নিয়ে মন্তব্য করেছেন, তার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের প্রতি ভারতের অবিশ্বাস আরও গভীর হয়েছে।
আসিম মুনিরের মন্তব্য নিয়ে ভারতে ক্ষোভ এখন কেবল রাজনৈতিক স্তরে নয়, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা মহলেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এনডিটিভি-কে বলেছেন, “কাশ্মীর নিয়ে মুনিরের তীব্র মন্তব্য সন্ত্রাসে উস্কানি হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতেই পারে।”
অন্যদিকে, পাকিস্তান সরকার কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে বলেছে, ভারত এ বিষয়ে 'অন্যায্যভাবে' পাকিস্তানকে দায়ী করছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এখন অভ্যন্তরীন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার চাপে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় নিরাপত্তা ও কাশ্মীর নিয়ে মুনিরের কঠোর অবস্থান রাজনৈতিক ও কৌশলগত বার্তা বহন করছে।