নজরুলের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে আজ কেবলই মনে হচ্ছে, তিনি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্ভাগা ব্যক্তি যার চিন্তা-চেতনা-আদর্শকে অনেক বেশি ভুল বোঝা হয়েছে, ভুল ‘অনুবাদ’ করা হয়েছে!
Published : 25 May 2024, 02:17 PM
কাজী নজরুল ইসলাম মানুষটা ধর্মকর্ম খুব একটা মানতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিয়ে করেছেন জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে। কবিতায় লিখেছেন, ‘বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে, ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি।' বলেছেন, ‘স্রষ্টারে আমি চুষে খাই!... ভগবানে আমি পোড়াব বলিয়া জ্বালায়েছি বুকে চিতা!' বলেছেন, ‘হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনও মন্দির-কাবা নাই।’ তিনি ভজন লিখেছেন, কীর্তন লিখেছেন। লিখেছেন গজল।
আমরা নজরুলকে বুঝলাম আমাদের মতো করে। আমরা ভুলে গেলাম নজরুলের সেই মহান বাণী, ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নাই কিছু মহীয়ান।’
আমরা 'মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই'— এই কথাটিকেই নজরুলের একমাত্র 'আদর্শ' হিসেবে চালালাম!
নজরুলের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে আজ কেবলই মনে হচ্ছে, তিনি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্ভাগা ব্যক্তি যার চিন্তা-চেতনা-আদর্শকে অনেক বেশি ভুল বোঝা হয়েছে, ভুল ‘অনুবাদ’ করা হয়েছে!
আমরা ভুলে যাই দ্রোহ-বিদ্রোহের ঊর্ধ্বে নজরুলের প্রেমময় জীবনের কথা। তার প্রেমিক রূপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই মানুষটি অনায়াসেই বলতে পারেন ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়।’ পৃথিবীতে এমন কয়জন আছেন যিনি প্রেমের টানে রক্তের সর্ম্পককে অস্বীকার করে পথে বেরিয়ে পড়তে পারেন? নজরুলের জীবনে প্রেম এসেছিল বারবার—কখনো ঝড়ের মতো, কখনো নিভৃতে। তাই তো জীবনের শেষ ভাষণে কবি বলেছিলেন: ‘আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি; আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম।’
নজরুলের প্রণয়-পর্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় নার্গিসকে লেখা এক চিঠিতে। হৃদয়ে কতটা প্রেমের ফল্গুধারা বইলে এমন চিঠি লেখা যায়, তা এই চিঠিটি বিশ্লেষণ না করলে বোঝা যাবে না।
১৯২১ সাল৷ কিছুদিন কুমিল্লায় খেয়ালি সময় কাটিয়ে একপ্রাণ ছুটি আর অপ্রত্যাশিতের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম এলেন দৌলতপুরের এক গ্রামের বাড়িতে৷ বাড়িটি আলী আকবর খানের৷ বাড়ির কর্ত্রী আকবর খানের বিধবা বড় বোন৷ আকবর সাহেবের আর এক বোনও থাকেন ওই গ্রামেই৷ তিনিও বিধবা৷ তার সুন্দরী মেয়ে সৈয়দা খাতুন মাঝেমধ্যেই আসে আকবর খানের বাড়িতে৷ সেখানেই এক বৈশাখ-অপরাহ্নে এই সুন্দরীর দেখা হলো নজরুলের সঙ্গে৷ কবির মধ্যে অপ্রত্যাশিতের তৃষ্ণা উসকে দিল সুন্দরী৷ নজরুল লিখলেন–
“সে যেন কোন দূরের মেয়ে আমার কবি মানস বধূ্
বুক-পোরা আর মুখ-ভরা তার পিছলে পড়ে ব্যথার মধু!
নিশীথ-রাতের স্বপন হেন,
পেয়েও তারে পাইনে যেন,
মিলন মোদের স্বপন-কুলে কাঁদন-ভরা চুমায়-চুমায়৷
নাম হারা সেই আমার প্রিয়া, তারেই চেয়ে জনম গোয়ায়৷”
এই মেয়েই নজরুলের নার্গিস! নার্গিস অসাধারণ সুন্দরী৷ তোলপাড় ভালোবাসলেন নজরুল ইসলাম৷ এতই কাছাকাছি হলেন তারা, দুজনের বিয়েও ঠিক হয়ে গেল৷ সে-খবর কলকাতার বন্ধুদের জানালেন কবি৷ এক বন্ধু সেই চিঠি পেয়ে লিখলেন, ‘তোর চিঠিতে জানলুম তুই স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে তাকে বরণ করে নিয়েছিস৷ তবে একটা কথা, তোর বয়েস আমাদের চেয়ে ঢের কম৷ অভিজ্ঞতাও তদনুরূপ৷ কাজেই ভয় হয় যে, হয়তো বা দুটো জীবনই ব্যর্থ হয়৷’ ১৯২১-এ নজরুল ঠিক বাইশ৷ বন্ধুকে জানালেন তিনি, ‘এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত ও অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা কোনও নারীর কাছে কখনও হইনি৷’ নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ের লগ্ন ঠিক হল ‘১৩২৮-এর ৩রা আষাঢ়, শুক্রবার, নিশীথ রাতে৷’
কিন্তু বিয়ে হয়েও হল না৷ নজরুল জানতে পারলেন এই নিয়ে একটি ভয়ানক শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে তার ঘাড়ে৷ শর্ত হল, কাজী নজরুল ইসলাম দৌলতপুর গ্রামে এসে নার্গিস বেগমের সঙ্গে ঘর করতে পারবেন, কিন্তু তাকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না৷
এই শর্ত চুরমার করে দিল বাইশ বছরের আবেগ-তাড়িত প্রেমিক কবির মর্যাদাবোধ৷ বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে উঠে গেলেন তিনি৷ সেই গভীর রাতেই পায়ে হেঁটে দৌলতপুর ছেড়ে কুমিল্লা চলে গেলেন৷ এবং চিরদিনের জন্যে, বুকভরা বেদনাবহ্নি নিয়েও, নিজেকে নির্বাসনে পাঠালেন এই তীব্র প্রেম থেকে৷ নজরুল ক্রমশ জানতে পারলেন, তার সঙ্গে বঞ্চনা করা হয়েছে৷ নার্গিস কি তাকে সত্যি ভালোবেসে ছিলেন? না কি ভালোবাসার অভিনয় করেছিলেন? কারণ যে সত্যটি উন্মোচিত হলো ক্রমশ, তা হলো, নার্গিসের মামা আকবর খানের ছিল একটি প্রকাশনা সংস্হা৷ ভাগনি নার্গিসকে দিয়ে তিনি প্রতিভাবান এবং ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা কবি নজরুলকে পাকড়াতে চেয়েছিলেন তার প্রকাশনা-বাণিজ্যের জন্য! মামা-ভাগনি পাকা অভিনেতা-অভিনেত্রীর মতো অভিনয় করেছিলেন বাইশ বছরের বিশুদ্ধ প্রেমিকটির সঙ্গে! তাই তাকে ঘরজামাই করে রাখবার মতলব৷ নজরুল পালালেন এই বিয়ে থেকে৷ কলকাতায় ফিরে আসার আগে একটি গানের মধ্যে জানালেন তার অন্তরের আর্তি:
“আমি এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম,
আর কাঁদবে এ-বুক সঙ্গীহারা কপোতিনী সম৷”
একশ বছর আগের এক প্রেম, বিচ্ছেদ, বিরহ! যা একটি চিঠিতে বিবৃত হয়েছে। চিঠিটি লিখেছেন প্রেমের বেদনাবিক্ষত নজরুল৷ লিখেছেন নার্গিসকে! নার্গিস সম্ভবত ফিরে আসতে চান তার কাছেই, বহুবছর পরে৷ তারই উত্তরে নজরুল লিখলেন এক অনন্য প্রণয়পত্র, বেদনার শুদ্ধিতে অপূর্ব!
নজরুল লিখছেন, নার্গিসের সঙ্গে পনেরো বছর বিচ্ছেদের পর, তাকেই৷ তার আবেগ এখন সমাহিত। প্রেম ছলছল করছে স্পর্শময় অমল অভিমানে: “কল্যাণীয়াসু,
তোমার পত্র পেয়েছি৷ সেদিন নববর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে মেঘমেদুর গগনে অশাম্ত ধারায় বারি ঝরছিল৷”
নজরুল পিছন ফিরে তাকালেন৷ পনেরো বছরের পথ পেরিয়ে তার মেদুর মনকেমন: “পনেরো বছর আগে, এমনি এক আষাঢ়ে, এমনি বারিধারার প্লাবন নেমেছিল৷ তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পার৷”
নজরুল কি জানেন না, তিনি যেভাবে ভাবলেন পনেরো বছরের আগের সেই দিনটি, নার্গিসের পক্ষে সম্ভব নয় সেভাবে ভাবা৷ তিনি তো কবি নন৷
নজরুল লিখলেন: “আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার৷ মেঘদূত যক্ষেরবাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে।”
থামলেন নজরুল৷ লিখবেন কি এবার চরম সত্য কথাটি তার প্রিয়তমা মেয়েটিকে? না, তিনি কোনোরকম আঘাত করলেন না৷ শুধু পনেরো বছরের এপার থেকে দিলেন বেদনার অঞ্জলি: “আর এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চয়৷ এই আষাঢ় আমাকে কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্তস্রোতে!”
নার্গিসকে অকপটে জানালেন তার অন্তর্দহন আর গহন সহিষ্ণুতা, তিতিক্ষা, ক্ষমা: “তোমার ওপর আমি কোনও জিঘাংসা পোষণ করি না, এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি৷
আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কত ক্ষত, কী অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি৷ তা দিয়ে কোনোদিন তোমায় দগ্ধ করতে চাইনি৷”
এরপর এই প্রেমপত্র হয়ে ওঠে এক অনন্য স্বীকারোক্তি– যে প্রেম তাকে এত কষ্ট দিল, তারই কাছে কৃত: নজরুল: “তুমি এই আগুনের পরশমাণিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবাণী’ বাজাতে পারতাম না!
আমি ‘ধূমকেতুর’ বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না৷”
প্রেমিক কবি কেমন করে হয়ে উঠলেন বিদ্রোহী কবি, তার কিছুটা আঁচ পাই আমরা এই অমূল্য প্রণয়পত্রে৷
এই চিঠিরই একটি জায়গায় লিখছেন নজরুল: “হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনেরো বছর আগেকার কথা৷ তোমার জ্বর হয়েছিল৷ বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র সুন্দর ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল৷ তোমার সেই তপ্ত ললাটের স্পর্শ আজও অনুভব করতে পারি৷ আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অম্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুণ মিনতি৷ মনে হয় যেন কালকের কথা৷ মহাকাল সেই স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলেন না৷ কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল! সারা দিনরাত আমার চোখে ঘুম ছিল না৷”
মহাকালের কোল থেকে যদি ফিরিয়ে আনা যায় নজরুল-নার্গিসের সেই প্রেম ২০২৪-র কোনো সন্ধ্যায়? যদি ফিরিয়ে আনা যায় আমাদের ভালোবাসায়? আমাদের বিচ্ছেদে-বিরহে-দহনে, প্রতিদিনের জীবন চর্চায়? আমাদের প্রেমহীন নাগরিক জীবনে, হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে আজ প্রেম যে খুব বেশি দরকার!
কৃতজ্ঞতা: অনিন্দিতা কাজী, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়