নাহিদ রানাকে নিয়ে ‘মাইন্ড গেম’, বাংলাদেশের সঙ্গে ১৯ বছরের সম্পর্ক, ২০ বছরের বেশি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের অনেক অর্জন-বিতর্কে, ক্যারিয়ারের নানা বাঁকের আরও অনেক গল্প বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শোনালেন শন উইলিয়ামস।
Published : 27 Apr 2025, 06:50 AM
২০০৬ সালে প্রথমবার বাংলাদেশে এসেছিলেন শন উইলিয়ামস। প্রায় ১৯ বছর পর এসেছেন এবারও। তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের বয়স অবশ্য আরও বেশি। এতটাই বড় ক্যারিয়ার যে, বর্তমানে সক্রিয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ ক্যারিয়ার তারই। সুদীর্ঘ এই ক্যারিয়ারে গৌরবময় অর্জন যেমন আছে তার, তেমনি জড়িয়েছেন অনেক বিতর্কেও। তিনি নিজে অবশ্য সেসব নিয়েও গর্ব করেন! বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জিম্বাবুয়ের ৩৮ বছর বয়সী অলরাউন্ডার শুনিয়েছেন তার ক্যারিয়ারের গল্প। সেখানে নানা বাঁকে উঠে এসেছে বাংলাদেশের অনেক প্রসঙ্গও।
সক্রিয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ ক্যারিয়ার এখন আপনার, জানেন এটা?
শন উইলিয়ামস: হ্যাঁ, কিছু জায়গায় দেখেছি। অনেকে শুভেচ্ছাও জানিয়েছে।
এই অনুভূতি কেমন? গর্ব নিশ্চয়ই হচ্ছে, একটু বুড়োও কি মনে হচ্ছে নিজেকে?
উইলিয়ামস: ভালো লাগা উপচে পড়ার মতো অনুভূতি। খুবই গর্বিত এবং অভিভূত। বয়স হয়েছে বটে, তবে নিজেকে আমি বুড়ো ভাবতেই চাই না!
এতগুলো বছরে যে পরিমাণ ম্যাচ খেলা উচিত ছিল, তা অবশ্য পারিনি। আরও অনেক বেশি ম্যাচ খেলতে পারলে ভালো লাগত। নানা কারণেই হয়নি। এর অনেকগুলোই আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তবে চোটের কারণে খুব লম্বা সময় বাইরে থাকতে হয়নি। পারফরম্যান্সের কারণেও বেশি সময় ছিটকে পড়তে হয়নি। এই তৃপ্তিগুলো আছে।
সত্যি বলতে, সহসাই নিজের শেষ দেখছি না। যতদিন পর্যন্ত দলের জন্য সঠিক কাজটি করে যাব, যে তরুণ ছেলেরা এখন খেলছে বা উঠে আসছে, ওদেরকে যতদিন সহায়তা করতে পারব… এসবই আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই দলের সামর্থ্য আছে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার। আমি সামনে থেকেই ওদের সঙ্গী হতে চাই।
শুরুর সময়টায় কি ভাবতে পেরেছিলেন, ২০ বছর পরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে যাবেন?
উইলিয়ামস: প্রশ্নই আসে না! একটুও ভাবতে পারিনি।
ক্যারিয়ারের শুরুতে এমনিতেই এটা ভাবা কঠিন। আমাদের বাস্তবতা আরও কঠিন ছিল। ওই সময়টায় জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট রাজনৈতিকভাবে প্রচণ্ড টালমাটাল ছিল। সময়টা খুবই অস্থির ছিল।
তবে এটা আমাদের অনেককেই আরও শক্ত করে তুলেছিল। সেখান থেকেই আমরা গড়ে উঠেছিলাম। আমি জানি, ওই সময়ের অনেক ক্রিকেটারের কাছেও ওসব স্মৃতি খুবই তেতো এবং দুঃসহ। সেটি যৌক্তিক কারণেই। তবে আমাদের কয়েকজন ওই সময়টার কাছে ঋণী। আমি ওই দিনগুলি কখনোই ভুলব না। অনেক শিখেছি ক্রিকেট ও জীবন সম্পর্কে।
ওই সময়টায় আপনি নিজেও সম্ভবত অনিশ্চিত ছিলেন ক্যারিয়ার নিয়ে। জিম্বাবুয়ের চুক্তি গ্রহণ না করে ইংল্যান্ডে গেলেন, আবার ফিরে এলেন কিছু দিন পর। পরে আবার চুক্তি থেকে সরে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় গেলেন, আবার ফিরলেন…
উইলিয়ামস: সত্যি বলতে, আমার তখন চাওয়া ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে ক্যারিয়ার গড়া। আমি শুধু ক্রিকেটই খেলতে চাইছিলাম। কিন্তু জিম্বাবুয়েতে সেটা সম্ভব ছিল না, রাজনীতির কবলে পড়তেই হতো। আমার বাবা চাননি, আমি কোনেরকম রাজনীতির মধ্যে পড়িয়ে পড়ি…
এরকম শোনা যায়, আপনার বাবা সাবেক ক্রিকেটার ও হকি কোচ (কলিন উইলিয়ামস ) আপনাকে ক্রিকেটে আসতে দিতে চাননি…!
উইলিয়ামস: ওটা আরও আগের ঘটনা। ১৭ বছর বয়সেই জাতীয় দলে খেলতে পারতাম। ওই সময়ের নানা ঘটনাপ্রবাহের কারণে (ক্রিকেটারদের ধর্মঘট) সুযোগটা এসেছিল। কিন্তু আমার বাবা চাইছিলেন, আগে পড়াশোনায় গুরুত্ব দেই।
পরে আমি যে সময়টার কথা বলছিলাম, ততদিনে ক্রিকেটে আমি চলে এসেছি। কিন্তু বাবা চাননি জিম্বাবুয়েতে থেকে রাজনীতির মারপ্যাঁচে পড়ে যাই আমি। তার নিজের জীবনে সেই লড়াইয়ে অভিজ্ঞতা ছিল এবং তা সুখকর ছিল না। তিনি চাইতেন, তার ছেলেরা (শন ও তার ছোট ভাই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার ম্যাথু উইলিয়ামস) নির্ঝঞ্ঝাটে ক্রিকেট খেলবে।
আমিও অনুভব করছিলাম, দেশে এত ঝামেলার মধ্যে ক্রিকেটে মনোযোগ দেওয়া কঠিন হবে। তরুণ ক্রিকেটার হিসেবে আমি অবশ্য সবকিছুই জানতাম না বা বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আমার অভিভাবকরা তো জানতেন যে মাঠের বাইরের এত কিছুর মধ্যে ক্রিকেট খেলা কঠিন! এজন্যই তারা আমার জন্য ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ক্রিকেট থেকে কিছু দিন দূরেও ছিলাম। পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই ক্রিকেটে ফিরি এবং দেশেও ফিরে যাই।
ক্যারিয়ারের একদম শুরু থেকেই বোর্ডের সঙ্গে আপনার নানা টানাপোড়েন লেগেই ছিল। ক্যারিয়ারজুড়েই নানা সময়ে ঝামেলা লেগেছে আপনার সঙ্গে…
উইলিয়ামস: আমার তো মনে হয়, খুবই ভালো হয়েছে সেসব! ওই সময়টায় এত কিছু চলছিল, কিন্তু কোনো ক্রিকেটার মাথা তুলে দাঁড়ায়নি। সবার মনের মধ্যে ভয় কাজ করছিল। আমার মনে হয়েছিল, ক্রিকেটাররা যদি প্রতিবাদ না করে, তাহলে অন্যরা কেউ খুব বেশি কিছু করতে পারবে না আমাদের জন্য। আমি ভয় পাইনি। এখনও ওসবের জন্য কোনো আক্ষেপ নেই।
আমার স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটে বড় কিছু করার, নেতা হয়ে ওঠার, সেরাদের একজন হওয়ার। তখনই অনুভব করেছিলাম, এখানে থেকে বড় কিছু করতে হলে আমাদের ব্যতিক্রমী হতে হবে। তারা আমার কি ক্ষতি করতে পারত? বড়জোর ছুড়ে ফেলতে পারত। এই তো! আমার তাতে কিছু যায়-আসত না।
নিজের দাবিতে অটুট থাকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। শুধু আমার জন্যই নয়, এরকম যারা উঠে আসছিল, তাদেরর অনেকের জন্যই। আমি ও আমরা তখন যদি প্রতিবাদ না করতাম, তাহলে পরে যারা খেলেছে তাদের অনেকেই হয়তো টিকতে পারত না।
তাছাড়া বোর্ডের সঙ্গে ক্রিকেটারের কিছু না কিছু বিরোধ, দূরত্ব, ঝামেলা সব দেশেই সব বোর্ডে প্রায় সবসময় চলতেই থাকে। মূল ব্যাপারটায় দ্বন্দ্ব না থাকলেই হয়। আমি যতক্ষণ জানি যে আমি ঠিক কাজটি করছি এবং ভালো কিছুর জন্য লড়ছি, ততক্ষণ আমার অন্য কিছুর পরোয়া নেই।
অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, হেনরি ওলোঙ্গাদের প্রতিবাদ ততদিনে তো ক্রিকেটবিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছিল আপনার? কিংবা হিথ স্ট্রিক ও অন্য সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে?
উইলিয়ামস: হিথ স্ট্রিক ও আমি ছিলাম খুবই ঘনিষ্ঠ। হিথ আমাকে আগলে রাখতো বাবার মতো করে। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে আমার থেকে যাওয়ার মূল কারণ ছিল সে। সঙ্গে ডেভ হাটন (সাবেক অধিনায়ক ও কোচ) এবং কেভিন কারানেরও (সাবেক অলরাউন্ডার ও কোচ) বড় ভূমিকা ছিল আমাকে প্রভাবিত করার পেছনে।
এই মানুষগুলো আমার জন্য অনেক করেছেন। যতটা করা সম্ভব, সবটুকুই করেছেন আমার জন্য। আমাকে তারা যেভাবে দেখেছেন, যেভাবে সামলেছেন, যে ম্যান-ম্যানেজমেন্ট স্কিল তারা আমাকে নিয়ে দেখিয়েছেন, তা অবিশ্বাস্য। তারা যদি ওসব না করতেন, আজকে আমি এখানে আপনার সঙ্গে বসে কথা বলতে পারতাম না।
অ্যান্ডির (ফ্লাওয়ার) সঙ্গে অবশ্য দূরত্ব ছিল। কারণ সে ও তার মতো ওই কজন ক্রিকেটারকে নিয়ে আমাদের মধ্যে এক ধরনের ভয় ও সমীহ ছিল। আমরা তো বাচ্চা ছিলাম, ১৮-১৯ বছর বয়স। অ্যান্ডিরা ততদিনে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এত কিছু দেখে ফেলেছেন, যা আমাদের ধারণারও বাইরে। অ্যান্ডি তো জিম্বাবুয়েতে থাকেওনি আর।
তবে অনেক কিছুই তার কাছ থেকে শিখেছি। ক্রিকেটীয় দিক থেকে বললে অবশ্য, অ্যান্ডির ভাই গ্রান্টের কাছ থেকেই শিখেছি বেশি। অনেক লম্বা সময় আমাকে কোচিং করিয়েছে সে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে নিবিড়ভাবে করিয়েছে।
অনেক সময় কোচরা যখন কিছু শেখানোর চেষ্টা করে, তখন অনেকেই বুঝতে চায় না, কখনও ফাঁকি দিতে চায়, পাত্তা দিতে চায় না। সময় গড়ালে ফুটে ওঠে, ওই কোচ আসলে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন এবং তা কতটা জরুরি।
গ্রান্টকে ক্যারিয়ারজুড়েই পাশে পেয়েছি। এই তো কদিন আগেও তার সঙ্গে কথা হলো যে এই সফরে কীভাবে খেলা উচিত এবং অসাধারণ সব পরামর্শ তিনি দিয়েছেন। এছাড়াও আরও নানা ব্যাপার… ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে নিজের মনেই নানা সংশয় জাগে যে, চালিয়ে যেতে পারব কি না, ছেড়ে দেব খেলা নাকি কী করা উচিত, এখনও পারফর্ম করতে পারব কি না, আগের মতো খেলতে পারব কি না, অনেক কিছুই মাথায় আসে। সমাধান তার কাছে পাই।
হিথ স্ট্রিকের এত ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তার নিষেধাজ্ঞার খবরটি নিশ্চয় বড় ধাক্কা খেয়েছিলেন? পরে তিনি চলেই গেলেন ক্যান্সারে!
উইলিয়ামস: হ্যাঁ, তা বটে। তবে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে সে গভীর ছাপ রেখে গেছে। খারাপ ব্যাপারটিকে সেভাবে দেখতে চাই না। খারাপের চেয়ে অনেক বেশি ভালো কিছুই তার মধ্যে দেখতে পাই।
এটা অনেকটা ব্যাটিংয়ের মতো। কেউ হয়তো অনেক কষ্ট করে ৯৯ রান পর্যন্ত গেল, সব ঠিকঠাক করল, কিন্তু একটা ভুল শটে আউট হয়ে সব শেষ করে দিল।
হিথের মধ্যে ভালো এত কিছু ছিল… শুধু ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবে নয়, পারিবারিক একজন মানুষ হিসেবে, বন্ধু হিসেবে… তাকে ফুটয়ে তোলার মতে উপযুক্ত ভাষা আমার জানা নেই। অবিশ্বাস্য ও অসাধারণ ছিল যে। তার চলে যাওয়াটা মানতে পারি না এখনও। হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল আমার।
আপনার ক্যারিয়ারে ফিরে আসা যাক। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন সেই ২০০৬ সালে। ওই সফরের কতটা মনে পড়ে?
উইলিয়ামস: আমার দ্বিতীয় সফর ছিল সেটি। বেশি কিছু মনে নেই। পাইলট (খালেদ মাসুদ) ছিল বাংলাদেশ দলে, প্রচুর কথা বলত। হাবিবুল বাশার ছিল অধিনায়ক। পরেও তার সঙ্গে অনেক খেলেছি। তার সঙ্গে মাঠে খুব লেগে যেত আমার। রফিক ছিল, দুর্দান্ত ক্রিকেটার। তার বলে বোল্ড হয়েছিলাম এক ম্যাচে (খুলনায়)।
কোনো ফিফটি কি করেছিলাম? মনেও নেই!
দুটি ফিফটি করেছিলেন আপনি, টানা দুই ম্যাচে, আপনার প্রথম দুই ফিফটি…
উইলিয়ামস: দুটি! (হাসি)… তবে দুটি ফিফটি করলেও নিশ্চয়ই খুব ধীরগতগিতে রান করেছিলাম! (৭০ বলে ৬১ ও ১০৯ বলে ৬৮)। কারণ তখন আমার খেলায় প্রচুর ভয় আর সংশয় মিশে থাকত। এটা করা উচিত নাকি ওটা, কখন কোন শট খেলা উচিত, এসব চলতে থাকত মাথায়।
পরে সময়ের সঙ্গে নিজের খেলা বুঝতে শিখেছি এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে লড়াইয়ের অনেক অধ্যায়ের স্বাক্ষী আপনি। স্মরণীয় স্মৃতি কোনটি?
উইলিয়ামস: স্মরণীয় অনেক কিছুই আছে। তবে আমার খুব মনে পড়ে মিরপুর টেস্টে (২০১৮ সালে) ব্রেন্ডান টেইলরের জোড়া সেঞ্চুরি। জানি আমরা ম্যাচটা হেরেছিলাম। তবে দুই ইনিংসেই সে অসাধারণ ব্যাট করেছিল।
এছাড়া টি-টোয়েন্টি সিরিজে ২-০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়েও ২-২ করতে পারাটা ছিল দারুণ (২০১৬ সালে)। এছাড়াও আরও অনেকবার জয়ের কাছাকাছি গিয়েও আমরা পারিনি।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেক। ২০ বছর আগে থেকে আমি দেখছি। যে সময়টা তারা পেরিয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছে, আমাদের কাছে তা অসাধারণ লাগে। জানি, আপনারা হয়তো দলকে নিয়ে অনেক সময় খুশি থাকেন না, আমাদের কাছে এবার হারার পরও নিশ্চয়ই অনেক সমালোচনা হচ্ছে। তবে আমি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি এবং বাংলাদেশের এই ভ্রমণ আমাদের জন্যও প্রেরণার।
মুশি, সাকিব, তামিমদেরকে দেখেছি যুব বিশ্বকাপে। কেউ কেউ এখনও খেলছে। দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে ওরা লড়েছে। আমাদের লড়াইটাও একই।
এবারও তো দারুণ ম্যাচ জিতলেন…
উইলিয়ামস: এবারের জয়টি ভালো লাগার এই কারণে যে, অনেক দিন ধরে আমরা টেস্ট জিততে পারছিলাম না। এই দলটা নবীন। দলের অনেকের এটি প্রথম টেস্ট জয়। দারুণ কিছু তরুণ ক্রিকেটার উঠে এসেছে আমাদের। তাদের জন্য বড় প্রেরণা হবে এই জয়।
তাছাড়া, বাংলাদেশের বিপক্ষে এতবার কাছে গিয়েও হেরেছি এত ম্যাচে, এই জয়টা তাই খুবই আনন্দদায়ী।
নাহিদ রানার গতির প্রসঙ্গে সিলেট টেস্টের আগে আপনার একটি মন্তব্য বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। আপনি ও অন্যরা নাহিদকে বেশ ভালোই সামলেছেন। নাহিদ তো এই টেস্টে নেই, এখন নিশ্চয়ই বলতেই পারেন, ওই মন্তব্য কি মাইন্ড গেমের অংশ ছিল?
উইলিয়ামস: আমাদের জন্য এটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এবং এখানে আমাদের মানসিকতা মেলে ধরা জরুরি ছিল।
আমরা জানি, নানা দেশে আমরা যখন সফরে যাই, সেখানকার মিডিয়া এবং অনেকেই নানা কিছু বলে থাকে, আমাদের ড্রেসিং রুমে ভয় ও সংশয় প্রবেশ করানোর চেষ্টা করে। এটা খেলাটিরই অংশ। মূল ব্যাপার হলো, আমরা কীভাবে সেটি সামলাতে পারি। আমার দায়িত্ব ছিল, আমাদের ড্রেসিং রুমে সেই ভয়ের ছায়া পড়তে না দেওয়া।
নাহিদের গতির কথা আমরা জানতাম। আমরা জানতাম সে দারুণ প্রতিভাবান। শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্যই নয়, বিশ্ব ক্রিকেটের জন্যও সে দারুণ এক সম্পদ হতে পারে। কিন্তু আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল আগেই কাবু না হয়ে যাওয়া।
তবে কথা বলা এক ব্যাপার, কাজে সেটা প্রমাণ করা অন্য কিছু। আমরা দুটিই পেরেছি। সেটি বড় তৃপ্তির।
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটেও তো খেলেছেন। বিপিএলে খেলেছেন, এর আগে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে দুই দফায় খেলার অভিজ্ঞতা আছে। অভিষেক ম্যাচটিতেই ২৫ রানে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন। কতটুকু মনে পড়ে ওই স্মৃতি?
উইলিয়ামস: অনেকটুকুই মনে পড়ে। ৭ উইকেট তো আর রোজ পাওয়া যায় না! কত গ্রেট বোলারও এই স্বাদ পাননি।
আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, প্রতিপক্ষ দলে জিম্বাবুয়ের তিনজন ক্রিকেটার খেলেছিল-ভুসি সিবান্দা, হ্যামিল্টন মাসাকাদজা ও সিকান্দার রাজা। তিনজনকেই আমি আউট করেছিলাম। হ্যাটট্রিকও করেছিলাম সেদিন। অবিশ্বাস্য একটি দিন ছিল। পরে আমাদের দলের (ব্রাদার্স ইউনিয়ন) তামিম ইকবাল বিধংসী ইনিংস খেলেছিল (৬৫ বলে অপরাজিত ৯৫*)।
ওই ম্যাচের স্কোরকার্ড আমি এখনও রেখে দিয়েছি। কখনোই ভুলব না ম্যাচটি।
সব মিলিয়ে ভালো অভিজ্ঞতাই হয়েছিল ঢাকা লিগে। খেলার মান বেশ ভালো ছিল।
আরও অনেক বেশি ম্যাচ খেলা উচিত ছিল, বলেছেন একটু আগে। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি তবু খেলেছেন মোটামুটি সংখ্যক। টেস্ট মাত্র ১৮টি, এটিই কি বেশি পোড়ায়?
উইলিয়ামস: অবশ্যই। আমার আসলে টেস্ট অভিষেক হওয়ার কথা ছিল ২০০৫ সালেই। কিন্তু অভিষেকের ঠিক আগেরে রাতে হাঁটুতে চোট পেয়ে গেলাম।
আমার জন্য সেটা ছিল শাপেবর। কারণ, তখনও আমি তৈরি ছিলাম না টেস্ট খেলার জন্য। পরে তো পাঁচ বছর আমরা টেস্ট থেকে দূরে ছিলাম।
আমাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটও খুব ভালো ছিল না। একটুও শক্তিশালী ছিল না তখন। স্কিলের দিক থেকে বলুন, প্রতিভার দিক থেকে, কাঠামোগতভাবে খুব ভালো অবস্থা ছিল না। ক্রিকেটারদের তখন খুব কঠিন সময় ছিল। বিদেশি কোচ ছিল না, স্থানীয় কোচ দিয়ে খুব উন্নতি হচ্ছিল না। সার্বিকভাবেই খুব বাজে অবস্থা ছিল।
তবে সৌভাগ্যবশত, আমরা কিছু ক্রিকেটার লড়াই করেছি, আঁকড়ে ধরে রেখেছি এবং সময়টা উতরে দিয়েছি সবাই মিলে। আমরা তখন পেরেছিলাম বলেই জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট টিকে গেছে এবং আজকে এটুকু আসতে পেরেছে।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আপনার মধ্যে নেতৃত্বগুণ দেখা গেছে সবসময়ই। কিন্তু জাতীয় দলে নেতৃত্বের অধ্যায় লম্বা হয়নি। আপনার খ্যাপাটে চরিত্রের কারণেই কি এটা?
উইলিয়ামস: হতে পারে। তবে আরও ব্যাপার আছে। আমার মানদণ্ড খুব উঁচুতে বাঁধা এবং আমি অনেক বেশি চাই। সেখানে কমতি বা আপোস আমি মেনে নিতে পারি না। না নিজের, না দলের।
আমি খুবই আগ্রাসী। জয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবনায় থাকে না। ড্র-ও করতে চাই না কখনও। সেই ধরনের সঙ্গে সবাই সবসময় একমত হয়নি বা মানিয়ে নিতে পারেনি।
আমি তাই আড়ালেই চলে গেছি। অধিনায়কদের পরামর্শ দেই নানা সময়ে। এটুকুতেই খুশি।
বয়স ৩৮ পেরিয়ে গেছে। সামনে তাকিয়ে ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ পথচলা কেমন দেখেন?
উইলিয়ামস: নিজেও নিশ্চিত নই। এই বয়সে অবশ্যই অনেক প্রশ্ন আর সংশয় মনে দানা বাঁধে। তবে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কতটা ফিট থাকতে পারছি এবং পারফর্ম কেমন করছি। আমি সবকিছু সিম্পল রাখতে চাই। নিজে যেভাবে খেলতে চাই, সেভাবে যদি খেলতে পারি, তরুণদেরকে সহায়তা করার মতো অনেক কিছুও আমার ঝুলিতে জমা আছে, সব কিছু প্রত্যাশামতো করতে পারলে খেলতে থাকব।
তবে আরও অনেক কিছুই এখন ভাবার আছে। কাঁচা পরিবার আমার। একটা সময় পর্যন্ত, বয়স যখন কম তাকে, তখন ক্রিকেটকেই মনে হয় জীবনের সবকিছু। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল আসে। বাবা হওয়ার পর জীবন নতুনভাবে ধরা দেয়। এখন পরিবার ও সন্তানকে সময় দেওয়ার কথাও ভাবি।
শেষের সময়টা তো আসবেই, আজ হোক বা কাল। আপাতত পারফরম্যান্সই সবকিছু। পারফর্ম করে যেতে চাই। দলের যে কোনো তরুণ ক্রিকেটারের মতোই ভূমিকা রাখতে চাই। জিম্বাবুইয়ান হিসেবে আমরা যদি সামনে এগোতে চাই, তাহলে ‘মিডিওক্রিটি’ দূর করতে হবে এবং সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে স্রেফ কথা না বলে আমাদের করে দেখাতে হবে।
গত দুটি ওয়ানডে বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ে খেলতে পারেনি। বিশেষ করে, ২০২৩ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে আপনি অসাধারণ ফর্মে ছিলেন। ৬০০ রান করেছিলেন। তার পরও দেশের মাঠে বাছাইয়ে লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি দল। যন্ত্রণাটা কি এখনও অনভুব করেন?
উইলিয়ামস: হৃদয় ভেঙেচুরে গিয়েছিল একদম। আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়গুলোর একটি। দল হিসেবে তো বটেই, ব্যক্তিগতভাবে মুষড়ে পড়েছিলাম। পরের সময়টায় ভান করেছি যে তেমন কিছু হয়নি। তবে আসলে প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলাম।
এই আসরের আগে অনেক কষ্ট করেছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে ভয়ঙ্কর খেটেছিলাম। এমন নয়, অন্যরা করেনি। সবাই অনেক পরিশ্রম করেছিল। কিন্তু… শেষ পর্যন্ত… হয়তো আমাদের এটা পাওয়ার ছিল না!
পরের বিশ্বকাপে তো জিম্বাবুয়ের খেলা নিশ্চিত, স্বাগতিক দেশ হিসেবে। উইলিয়ামসকেও কি দেখা যাবে সেখানে?
উইলিয়ামস: জানি না, সত্যিই। বয়স তখন ৪১ হয়ে যাবে। খেলতে পারলে তো দারুণ হবে। তবে এখনও অনেক দূরের পথ। আপাতত এই বছরে বেশ কিছু টেস্ট ম্যাচ আছে, ইংল্যান্ডে খেলব আমরা, দেশের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলব। আপাতত এদিকেই মনোযোগ।
২০২৭ বিশ্বকাপে খেলা অবশ্যই মনের কোণে থাকবে। হয়তো সেটিই চূড়ান্ত লক্ষ্য। যদি সে পর্যন্ত যেতে পারি, এরপর আর অবশ্যই খেলব না।
চার বছর পর টেস্টে ফিরে গত কয়েক মাসে চারটি টেস্ট খেলেছেন। সামনে এতগুলি টেস্টের কথা বললেন। এজন্যই কি টেস্টে ফিরেছেন?
উইলিয়ামস: এটা একটা কারণ। আরেকটি বড় কারণ, জিম্বাবুয়ের উঠতি অনেক ক্রিকেটার। দারুণ প্রতিভাবান কিছু ক্রিকেটার উঠে আসছে। বেন কারান যোগ হয়েছে, ব্রায়ান ব্রেনেট, ওয়েসলি মাধেভেরের মতো ছেলেদের আপনারা দেখছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে আরও কজন খেলছে দারুণ প্রতিভাবান। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে অনেক কিছুতেই বদলের আভাস দেখছি।
সবচেয়ে বড় কথা, যে ‘মিডিওক্রিটির’ কথা বলেছিলাম, সেখানে বদলের ছাপ দেখছি। এই পালাবদলের সময়টা তরুণদেরকে যতটা সম্ভব সহায়তা ও অনুপ্রাণিত করতে চাই। এত বছর ধরে যে লড়াইটা করেছি, যে ধাপটা আমরা পেরোতে চাই, আমা মনে হয় তা সামনেই অপেক্ষায় এবং সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে রোমাঞ্চকর এই সময়টার সঙ্গী হতে চাই।