জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুলের দুই সন্তানের লড়াইয়ে নৌকার প্রার্থী লিপির পাশে আছেন তার চার ভাই বোন, অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাফায়াতের পাশে আছেন তার চাচাত ভাই।
Published : 01 Jan 2024, 08:09 AM
এবারের নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ সদর ও হোসেনপুর উপজেলা মিলিয়ে গঠিত সংসদীয় আসনটি আলাদাভাবে দৃষ্টি কাড়ছে ভোটের মাঠে ভাই-বোনের লড়াইয়ের কারণে।
আওয়ামী লীগের নৌকা পাওয়া সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপিকে ঈগল প্রতীক নিয়ে হারিয়ে দিতে চাইছেন তার বড় ভাই সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলাম।
মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠন করা প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের দুই সন্তান ও তাদের অনুসারীরা একে অন্যের তীব্র সমালোচনাও করছেন। এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনছেন, যা পরিবারের বিভক্তিকে সামনে তুলে ধরছে।
বিএনপি-জামায়াত ও সমমনাদের বর্জনের এই নির্বাচনে আসনটিতে অন্য যে প্রার্থীরা আছেন, তারা সেভাবে আলোচনায় নেই।
সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের প্রথম নির্বাচনে আসনটিতে জয় পেয়েছিল বিএনপি। তবে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের ভোটে সৈয়দ নজরুলের বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রার্থী হওয়ার পর থেকে পাল্টে যায় চিত্র।
সুবক্তা সৈয়দ আশরাফ ধীরে ধীরে এমন একটি অবস্থান তৈরি করেন, যেখানে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা অনেক পেছনে পড়ে যায়।
আশরাফ এই আসনে জেতেন চারটি নির্বাচনে। তবে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ের সময় তিনি ছিলেন কোমায়। ভোটের পরপর তার মৃত্যুর খবর আসে।
২০১৯ সালে উপ-নির্বাচনে আশরাফের বোন লিপিকে মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, এবারও তাকেই নৌকা দেওয়া হয়েছে।
কার পাশে কে
এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ খুলে দেওয়ার পর আসনটিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সাফায়াত ছাড়াও তার চাচাত ভাই সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটো মনোনয়নপত্র জমা দেন।
সাফায়াতের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে বাতিল হয়ে গেলেও নির্বাচন কমিশনে আপিলে তিনি প্রার্থিতা ফিরে পান। এরপর টিটো তাকে সমর্থন দিয়ে ভোট থেকে সরে দাঁড়ালে ভাই ও বোনের মধ্যে লড়াইয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
সৈয়দ পরিবারে এই বিভক্তি বিভেদ তৈরি করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগেও। একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগারে পরিস্থিতি বিব্রতকর হয়ে উঠছে। বাড়ছে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা।
লিপির পক্ষে আছেন তার দুই ভাই সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম ও সৈয়দ শরীফুল ইসলাম এবং বোন সৈয়দা রাফিয়া নূর রুপা।
অপরদিকে সাফায়েতের পক্ষে আছেন তার চাচাত ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক টিটো।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিল্লুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক এম এ আফজাল, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মামুন আল মাসুদ খান, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সাত্তার, জেলা যুবলীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বকুল, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন মোল্লা সুমন নৌকার প্রার্থী লিপির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
অপরদিকে জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক এ কে এম শামসুল ইসলাম খান মাসুম, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওলাদ হোসেন, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী, হোসেনপুর পৌরসভা চেয়ারম্যান আব্দুল কাইয়ুম খোকন, হোসেনপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সোহেল আছেন সাফায়েতের পক্ষে।
দুই প্রার্থী কে কী বলছেন
সাফায়েত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভাই-বোন সবার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ রয়েছে। তবে তাদের সঙ্গে আমার আদর্শিক মতপার্থক্য রয়েছে। গত পাঁচ বছর এলাকায় কোনো উন্নয়ন হয়নি। ভাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাই তার অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করতেই আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি।”
অন্যদিকে লিপি বলেন, “জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের আমলে আমার নির্বাচনি এলাকায় অনেক উন্নয়ন হয়েছে। চলমান উন্নয়নের ধারাকে বজায় রাখতে ভোটাররা পুনরায় নৌকায় ভোট দেবে।”
সৈয়দ নজরুলের আরেক ছেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ শরীফুল ইসলাম বোনের পক্ষ নিয়ে সাফায়েতকে ‘দলছুট’ আখ্যা দিয়েছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা চার ভাই-বোন একসঙ্গে আছি। ছোটবোন লিপির পক্ষে কাজ করছি।”
নারী নেতৃত্ব নিয়ে বক্তব্যে তোপের মুখে সাফায়াত
নির্বাচনি প্রচার শুরু হওয়ার আগে আগে নারী নেতৃত্ব এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে নিয়ে সাফায়েতুল ইসলামের মন্তব্য এলাকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
গত ১৭ ডিসেম্বর সাফায়েতুল এক বক্তৃতায় বলেন, “মহিলারা নৌকার মাঝি হতে পারেন না।”
এর প্রতিক্রিয়ায় জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মানসুরা জামান নূতন বলেন, “এই বক্তব্য জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ সব নারীর জন্যই অবমাননাকর। আওয়ামী পরিবারের সন্তান হয়ে যারা নারীদের প্রতি এ ধরনের বিদ্বেষ পোষণ করেন, তারা আর যাই হোক শেখ হাসিনার সৈনিক হতে পারেন না।”
সাফায়াতের বিরুদ্ধে ‘আদর্শহীনতার’ অভিযোগ এসেছেন ভোট ভাই সৈয়দ শরীফুল ইসলামও। তিনি বলেছেন, “তারা অস্ত্র আর টাকার গরম দেখাচ্ছে। আমরা নেমেছি আদর্শ নিয়ে। আমরা সততার সঙ্গে নির্বাচন করছি।”
তবে সাফায়াতের পক্ষে থাকা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওলাদ হোসেন বলেন, “এটা সঠিক নয়, মিথ্যা কথা। টাকা ও অস্ত্রের গরম উনারা কোথায় দেখলেন? উনারা এসব কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। এসব কথায় মানুষ বিশ্বাস করবে না।”
তিনি বলেন, “বিগত পাঁচ বছরে এলাকায় উন্নয়ন হয়নি বলেই আমরা পরিবর্তনের জন্য সাফায়েতুল ইসলামকে নিয়ে মাঠে নেমেছি। জনগণের ভোটে ভালো ব্যবধানেই তিনি বিজয়ী হবে বলে আশা করছি।”
এই আসনের মোট ভোটার ৫ লাখ ১৩ হাজার ৯৭৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৬০ হাজার ৪০৫ জন এবং নারী ভোটার ২ লাখ ৫৩ হাজার ৫৭১ জন। হিজড়া ভোটার রয়েছে তিনজন।
এখানে মোট সাতজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অন্য পাঁচজন হলেন- জাতীয় পার্টির আব্দুল হাই (লাঙল), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি আনোয়ারুল কিবরিয়া (আম), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের আব্দুল আওয়াল (ছড়ি), ইসলামী ঐক্যজোটের আশরাফ উদ্দিন (মিনার) এবং বাংলাদেশ কংগ্রেসের মোবারক হোসেন (ডাব)।
আরও পড়ুন:
সেনদুর্গ অটল থাকবে, না নৌকার ঘাঁটি?
নরসিংদী-১: নৌকার বিপক্ষে ‘লোকমান-প্রভাব’ কতটা খাটবে
‘ভাগ্যবান’ শান্তর সঙ্গী ‘সেই বিভেদ’
নতুন ইতিহাসের অপেক্ষায় মুরাদের জামালপুর-৪
টাঙ্গাইল-৪: লতিফ সিদ্দিকীর প্রত্যাবর্তন, নাকি নৌকার ধারাবাহিকতা?
সাবেক দুই এমপির চ্যালেঞ্জের মুখে প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ
নারায়ণগঞ্জ-১: বস্ত্রমন্ত্রীকে লড়তে হবে তৈমুর-শাহজাহানের বিরুদ্ধে