ভোট ঘিরে নৌকা এবং দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়া বাকিদের তেমন কোনো কার্যক্রম এখনও মাঠে দেখা যায়নি।
Published : 28 Dec 2023, 08:01 AM
বিএনপি নেই, দলের পক্ষ থেকেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বাধা নেই নৌকার মাঝি হতে না পারা আওয়ামী লীগ নেতাদের। ভোটকে ‘অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ দেখাতে দলের ডাকে সাড়া দিয়ে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তারাই এখন অনেক ক্ষেত্রে নৌকা প্রতীকের ‘চ্যালেঞ্জ’ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
মেহেরপুরের দুটি আসনেই নৌকাকে ‘চ্যালেঞ্জ’ করে ‘শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী’ হয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্যরা।
মনোনীত প্রার্থীরা দলীয় হলেও নির্বাচনের মাঠে তাদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সম্পর্ক যেন সাপে-নেউলে; ক্ষমতা পেতে একে-অপরকে হারাতে মরিয়া। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই অবস্থাকে অনেকে ‘রাগ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ’ হিসেবেও দেখছেন।
একই চিত্র মেহেরপুর-১ আসনে। সদর ও মুজিবনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে আওয়ামী লীগ তৃতীয়বারের মত প্রার্থী করেছে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ও মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফরহাদ হোসেনকে।
নৌকা প্রতীকের এ প্রার্থীর বিরুদ্ধে ট্রাক প্রতীক নিয়ে লড়তে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন দুইবারের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। দলের আরেক সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদিনও রয়েছেন এ দৌঁড়ে।
এ ছাড়া জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আব্দুল হামিদ, জেলা ন্যাশনাল পিপলস পার্টির সহসভাপতি তরিকুল ইসলাম লিটন, কৃষক মুক্তি জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক বাবুল মিয়া, জেলা জাকের পার্টির সভাপতি সাইদুল আলম, মুজিবনগর উপজেলা জাতীয় পার্টির (জেপি) আহ্বায়ক মওলাদ আলী খানও লড়বেন এই ভোটে।
ভোট ঘিরে নৌকা এবং দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়া বাকিদের তেমন কোনো কার্যক্রম এখনও মাঠে দেখা যায়নি। তার মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আব্দুল মান্নানকে বেশি সক্রিয় দেখা যাচ্ছে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে এরই মধ্যে নৌকার প্রার্থী ফরহাদ হোসেন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মান্নানকে শোকজ করে সর্তক করেছেন নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান মেহেরপুর যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ এইচ এম কবির হোসেন।
মেহেরপুর-১ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৩৭টি। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৪৯ হাজার ৫৫৬ আর নারী ভোটার ১ লাখ ৫০ হাজার ৪৮০। এখানে হিজড়া ভোট রয়েছেন একজন।
অধ্যাপক আব্দুল মান্নান ১৯৯১ সালে এবং পরে উপ-নির্বাচনে ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দুই দফায় সংসদ সদস্য ছিলেন।
১৯৯৬ সালে জয় পান বিএনপির আহমেদ আলী। তিনি মারা গেলে উপ-নির্বাচনে জয় পান আব্দুল মান্নান।
২০০১ সালে এই আসনে বিজয়ী হন আহমেদ আলীর ছেলে বিএনপির মাসুদ অরুণ।
আর আওয়ামী লীগের জয়নাল আবেদীন এই আসন থেকে ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নবম জাতীয় সংসদে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।
ফরহাদ হোসেন ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন। শেষবার তিনি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী হন।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী দুইবার এমপি নির্বাচিত হওয়ায় ভোটের মাঠে ‘শক্ত অবস্থানে’ থাকলেও দলীয় নেতাকর্মীদের ‘মূল্যায়ন না করার’ অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
আব্দুল মান্নানের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মিয়াজান আলী, সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রসুল, জেলা আওয়ামী লীগের আরেক সহসভাপতি আব্দুল মান্নান (ছোট), মুজিবনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান জিয়াউদ্দিন বিশ্বাস, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক পৌর মেয়র মাহফুজুর রহমান রিটনসহ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক ও বর্তমান নেতারা প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছেন।
অন্যদিকে ফরহাদের পক্ষে মাঠে সরব রয়েছেন মেহেরপুর সদর ও মুজিবনগর উপজেলার সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য, জেলা যুব মহিলা লীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা।
ফলে নির্বাচনে ফরহাদের সঙ্গে আব্দুল মান্নানের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে সেটা স্পষ্ট।
নির্বাচন নিয়ে দলে বিভক্তি ও দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নেতাদের কেন এই অবস্থান- এমন প্রশ্নে জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মিয়াজান আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফরহাদ হোসেন দলের নেতা-কর্মীদের ‘মূল্যায়ন’ তো করেনই না, বরং পকেট কমিটি করে দলকে নানাভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রতিমন্ত্রী দলের ঐক্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। তার কাছে চাটুকার ছাড়া দলের ত্যাগী নেতারা মূল্য পায়নি। অপমান-অপদস্ত হয়েছে দলের অসংখ্য নেতাকর্মী।
“ফলে এবারের ভোটে মেহেরপুরের ধ্বংসপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগকে পুনরুদ্ধারের জন্য নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে আমরা মাঠে নেমেছি।”
একই অভিযোগ করে জেলা আওয়ামী লীগের আরেক সহসভাপতি আব্দুল মান্নান বলেন, “এবারে জয়-পরাজয়টি হবে রাগ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দিয়ে।”
অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে নৌকার প্রার্থী ফরহাদ হোসেন বলেন, “যারা সবসময় দলের বিরুদ্ধে ছিল, মূলত তারাই নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ভোটাররা ওই সব নেতাদের ভালো করেই চেনেন। তাই ভোটে এর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না।
“কারণ তৃণমূল নেতারাসহ সব ইউপি চেয়ারম্যান ও দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা নৌকার পক্ষে মাঠে নেমেছেন।”
এদিকে দুইবারের এই সংসদ সদস্যকে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। কেউ কেউ পরিবর্তন চাইলেও কেউ কেউ আবার ফরহাদকেই সংসদ সদস্য দেখতে চান।
মেহেরপুর সদর উপজেলার শোলমারী গ্রামের মালোপাড়ার ফুরকান শেখ বলেন, “মানুষ এমপি-মন্ত্রী হলে কাছের মানুষরা দূরের হয়ে যায়। গাঁয়ের মানুষদের খেয়াল রাখে না; তাই আমি পরিবর্তন চাই এবার।”
অন্যদিকে উজলপুর গ্রামের খাঁ পাড়ার গণি মওলা বলেন, “ভোটে জিতে সবাই বড় লোক হবে এটাই সত্যি। তবে এতদিন আমরা শান্তিতে ছিলাম। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, ছিনতাই নেই এলাকায়। আমরা এমন অবস্থা আবার চাই।”
মুজিবনগর উপজেলার কেদারগঞ্জ গ্রামের উন্নয়নকর্মী আসকার আলী বিশ্বাস বলেন, “স্বাধীনতা পরবর্তী মেহেরপুর প্রথম মন্ত্রী পেয়েছে। যার কারণে গত ১০ বছরে মেহেরপুর একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়াসহ অবকাঠামো ও সড়ক যোগাযোগে অনেক উন্নতি করতে পেরেছে।
“আবার মন্ত্রী পেলে স্বাধীনতার সূতিকাগার ঐতিহাসিক মুজিবনগর কেন্দ্রীক মেহেরপুর বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি করে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে। এবারের ভোটে এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।”
এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মান্নানের দাবি, নেতাকর্মীদের ‘অনুরোধে’ তিনি ভোটের মাঠে লড়ছেন।
তার ভাষ্য, “পরিবারতন্ত্র ও পকেটতন্ত্রের কারণে বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি ‘ক্ষুদ্ধ’ হয়ে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাকর্মী আমাকে সমর্থন দিয়ে মাঠে নামিয়েছে। মূলত এই ভোটে সবাই পরিবর্তন চায়। ফলে জয়ী আমিই হব।”
মান্নানের পক্ষে জোয়ার কেমন তা জানতে যোগাযোগ করা হয় মেহেরপুর বড়বাজার ব্যবসায়ী সমিতির দপ্তর সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে।
ভোট নিয়ে উৎসাহ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “যদি সুযোগ পাই, পরিবেশ ভালো মনে হয়, তবে ভোট দিতে যাব। আমার পছন্দের কোনো প্রার্থী নেই। কারণ, ক্ষমতায় গেলে সবাই সম্পদের পাহাড় গড়ে। তাই আমরা চাই, ক্ষমতায় গিয়ে সবাই যেন, সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ পায়। সেটা বিবেচনায় নিয়ে এবারের ভোটে পরিবর্তনের পক্ষে আমি।”