এ নির্বাচনি এলাকায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভূমিলুণ্ঠন, সন্ত্রাস ও মাদকের বিস্তার। সমস্যাগুলোর কথা প্রায় সব প্রার্থীর বক্তব্যে উঠে এসেছে।
Published : 30 Dec 2023, 11:51 AM
এবার ত্রিমুখী লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছে ঢাকার অদূরে রূপগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে ভোটের মাঠ।
আসনটিতে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী গোলাম দস্তগীর বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তারই দলের নেতা শাহজাহান ভূঁইয়া।
এ দুই প্রার্থীকে ছাপিয়ে আলোচনায় আছেন তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার।
জেলার পাঁচটি সংসদীয় আসনের মধ্যে এবারের নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে।
এই আসনে মোট নয়জন প্রার্থী রয়েছেন। প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই প্রার্থীরা নির্বাচনি প্রচারে ব্যস্ত আছেন। তবে ভোটের মাঠে সবচেয়ে বেশি সরব গোলাম দস্তগীর গাজী, তৈমুর আলম খন্দকার ও শাহজাহান ভূঁইয়া।
তারা প্রতিদিন সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগের মধ্য দিয়ে ভোটারদের কাছে ভোট প্রার্থনায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। একইসঙ্গে চলছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগও।
গোলাম দস্তগীর গাজী এ আসনটিতে টানা তিনবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তিনি সরকারের বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর দায়িত্বেও আছেন।
যদিও ‘বীর প্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধার সামনে নির্বাচনি মাঠ এবার সহজ নয়।
মাঠের সমীকরণ বলছে, গোলাম দস্তগীর গাজী স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হলেও তার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার ও শাহজাহান ভূঁইয়াও এ নির্বাচনে শক্ত অবস্থানে আছেন।
প্রচারের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে নির্বাচনি মাঠ গরম রেখেছেন এই দুই প্রার্থী।
প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগে শাহজাহান ভূঁইয়ার এক সমর্থকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে নৌকার প্রার্থীর ছয় সমর্থককে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ।
এদিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই আসনটিতে প্রার্থিতা ঘোষণা করেন তৈমুর আলম খন্দকার।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক তৈমুর দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে বিগত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে বহিষ্কার হন।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির মহাসচিব নির্বাচিত হন। নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে দলীয় ‘সোনালী আঁশ’ প্রতীকের প্রার্থী হয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে, দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তিনবারের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়া।
প্রার্থী হতে শেষ মুহূর্তে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকেও পদত্যাগ করেন তিনি।
ভোটের মাঠের তথ্য বলছে, পৈত্রিক নিবাস রূপগঞ্জে হলেও তৈমুর আলম সবসময় শহরকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ব্যস্ত ছিলেন।
বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর দলটির নেতাদের সঙ্গেও তার তেমন সখ্য নেই। তার প্রচারে বিএনপির কোনো নেতাকে দেখা যায়নি। তাছাড়া তার নতুন দল তৃণমূল বিএনপিরও সাংগঠনিক ভিত্তি নেই।
গত কয়েকদিনের প্রচারে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। যদিও ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন বলে দাবি এই প্রার্থীর।
তবে স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব রয়েছে শাহজাহান ভূঁইয়ার। তিনি তিনবার উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। তাছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগেরও সাধারণ সম্পাদক।
আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কোনো নির্দেশনা না দেওয়ায় অনুসারী নেতা-কর্মীরাও তার পক্ষে ‘কেটলি’ প্রতীকের প্রচার চালাচ্ছেন। ফলে এ আসনে ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
শাহ্জাহান ভূঁইয়ার সমর্থক বলে পরিচিত দাউদপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম জাহাঙ্গীরের ভাষ্য, তৈমুর আলম খন্দকার মিডিয়ার কারণে আলোচিত হলেও রূপগঞ্জে ভোটের মাঠে ভোটারদের মাঝে তার কোনো প্রভাব নেই। আসনটিতে নৌকার প্রার্থীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শাহজাহান ভূঁইয়া।
তবে নৌকার প্রার্থীর সমর্থক একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা বলেছেন, রূপগঞ্জে সাংগঠনিকভাবে গোলাম দস্তগীর গাজীর প্রভাব রয়েছে। উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন পরিষদ ও দুটি পৌরসভার মধ্যে ছয় ইউপি চেয়ারম্যান ও এক পৌরসভার মেয়র রয়েছেন তার পক্ষে। ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাই নৌকার প্রচারে সরব। এমনকি জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও রূপগঞ্জে নৌকার পক্ষে প্রচারে অংশ নিচ্ছেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই বলেন, “এবারের নির্বাচনে দল থেকে সরাসরি নিষেধ না থাকায় কেউ কেউ নৌকার বিপরীতে গিয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে রূপগঞ্জে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষেই জনমত বেশি। পুনরায় সেখানে নৌকার প্রার্থীই বিজয়ী হবেন।”
কাঞ্চন বাজারে কথা হয় ওষুধ বিক্রেতা মো. মোস্তফা ও তার বন্ধু দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে। ভোটের মাঠের আলাপে আগ্রহ নেই বলে জানালেন তারা৷ বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় নির্বাচনের তেমন আমেজ নেই বলে মত দুই বন্ধুর৷
যদিও দীর্ঘ আলাপের এক পর্যায়ে এলাকার ভোটার হিসেবে তাদের ভাবনার কথা জানালেন।
মোস্তফা মনে করেন, “তৈমুর আলমকে নিয়ে গণমাধ্যমে বেশি আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু ভোটের মাঠে তার অবস্থা খুবই নাজুক। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কোনো দলের সমর্থকরাই তৈমুরকে ভোট দেবেন না।
তার মতে, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে লড়াই হবে গোলাম দস্তগীরের সঙ্গে শাহজাহান ভূঁইয়ার৷
প্রায় একই ধারণা দেলোয়ার হোসেনের। তবে তার কাছে মনে হয়েছে, সাংগঠনিক ভিত্তির কারণে গোলাম দস্তগীর গাজী এগিয়ে থাকবেন। শাহজাহান ভূঁইয়াকে নির্ভর করতে হবে বিএনপির ভোটের ওপর।
স্থানীয়দের ভাষ্য, বিগত ১৫ বছর সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীর আসনটিতে অবকাঠামোগত, শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছে।
কিন্তু উপজেলার সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ভূমিলুণ্ঠন, সন্ত্রাস ও মাদকের বিস্তার’। সমস্যাগুলোর কথা প্রায় সব প্রার্থীর বক্তব্যে উঠে এসেছে।
স্বতন্ত্র ও তৃণমূলের প্রার্থী এজন্য সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীকে দায়ী করেছেন। অন্যদিকে গাজীর দাবি, তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা ‘ভূমিদস্যুদের’ পৃষ্ঠপোষকতায় প্রার্থী হয়েছেন।
সম্প্রতি মুড়াপাড়ায় প্রচারে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “ভূমিদস্যুরা ওই প্রার্থীদের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। তারা একজন ‘পুতুল এমপি’ বানিয়ে রূপগঞ্জকে দখল করতে চায়।”
আসনটিতে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী।
তিনি বলেন, “আমি সবসময় এই রূপগঞ্জবাসীর কাছে ছিলাম, আগামীতেও থাকবো। এর প্রতিদান হিসেবে রূপগঞ্জবাসী আগেও আমাকে নির্বাচিত করেছেন, আগামীতেও করবেন। ভূমিদস্যুরা কখনই সফল হবে না। জনগণই তাদের বিরুদ্ধে রায় দেবে।”
তবে গোলাম দস্তগীরের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তৃণমূলের প্রার্থী তৈমুর আলম এবং স্বতন্ত্র শাহজাহান ভূঁইয়া।
জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, “আমি রূপগঞ্জবাসীর পক্ষে সবসময় ছিলাম৷ তাদের কাছে আমি পরীক্ষিত নেতা৷ আমি যখন তাদের কাছে যাচ্ছি, তারা আমাকেই ভোট দেওয়ার কথা বলছেন৷ নির্বাচনি পরিবেশ সুষ্ঠু থাকলে আশা করি, আমার পক্ষেই জনগণের রায় আসবে৷”
অপরদিকে, স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভূঁইয়া বলেন, “মাদক, সন্ত্রাসের কারণে রূপগঞ্জবাসী অতিষ্ঠ৷ আমি নির্বাচিত হলে রূপগঞ্জে সন্ত্রাস থাকবে না। এ অঞ্চলের মানুষ আমাকে তিনবার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছেন ৷ তারা এবার এমপি প্রার্থী হিসেবেও ভোট দেবেন।”
নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে নয় প্রার্থীর মধ্যে অন্য ছয়জন হলেন- জাতীয় পার্টির (লাঙল) সাইফুল ইসলাম, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের (চেয়ার) একেএম শহীদুল ইসলাম, জাকের পার্টির (গোলাপ ফুল) মোহাম্মদ যোবায়ের আলম ভূঞা, স্বতন্ত্র (ঈগল) গাজী গোলাম মূর্তজা, স্বতন্ত্র (আলমিরা) হাবিবুর রহমান, স্বতন্ত্র (ট্রাক) জয়নাল আবেদীন চৌধুরী।
বিপরীতে এখানে মোট ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৬১৬ জন ভোটার আছেন।
আগামী ৭ জানুয়ারি সাতটি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার ১২৮টি কেন্দ্রের ৮১৭টি কক্ষে এবার ভোট নেওয়া হবে বলে জানান নারায়ণগঞ্জ জেলায় রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক।
তিনি বলেন, “নারায়ণগঞ্জে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। আশা করি, আগামী ৭ জানুয়ারি সুন্দর একটি নির্বাচন জনগণকে উপহার দিতে পারব।”