রামনাথের বাড়ির ‘দখলদার’ ওয়াহেদকে আওয়ামী লীগ থেকে ‘বহিষ্কারের উদ্যোগ’

বানিয়াচং উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, তিনি ইউনিয়নের সভাপতি-সম্পাদককে বলেছেন তাকে বহিষ্কার করতে। তাদের দেওয়া বরখাস্তের চিঠি পেলে তা জেলা নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।

রাসেল চৌধুরীহবিগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Sept 2022, 01:54 PM
Updated : 13 Sept 2022, 01:54 PM

ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের হবিগঞ্জের বাড়ির ‘দখলদার’ আব্দুল ওয়াহেদকে আওয়ামী লীগ থেকে ‘বহিষ্কারের উদ্যোগের’ কথা জানিয়েছেন দলের বানিয়াচং উপজেলা সভাপতি আমির হোসেন মাস্টার।   

বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মাস্টার মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এ কথা জানান। 

রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িটি দীর্ঘদিন ধরে ‘দখলে’ রেখেছেন বানিয়াচং উত্তর পশ্চিম  ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াহেদ। 

চিরকুমার রামনাথ বিশ্বাস ভারতে মারা যাওয়ার পর বানিয়াচং গ্রামের বিদ্যাভূষণপাড়ার বিশাল এলাকাজুড়ে তার পৈত্রিক বাড়িটি পরিত্যক্ত ছিল। 

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রামনাথেরে পরিত্যক্ত বাড়িটি ওয়াহাব উল্লাহ নামে এক ব্যক্তি দখলে নেন। এর কয়েক বছর পর আব্দুল ওয়াহেদ ও তার ভাই ‘তালিকাভুক্ত আলবদর’ আবু ছালেক কিছু টাকা দিয়ে ওয়াহাব উল্লাহর কাছ থেকে দখল বুঝে নেন। কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই বাড়ির দখল তারা কেনা-বেচা করেন। আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু করলে আবু ছালেক এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। কিন্তু তার ভাই আব্দুল ওয়াহেদ ওই বাড়ি নিজের নামে ‘অবৈধভাবে’ নামজারি করান। তবে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী ও রামনাথ স্মৃতি সংসদের নেতাকর্মীরা বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আনলে সেই নামজারি বাতিল করা হয়। 

কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা কোনোভাবে এই প্রভাবশালী ব্যক্তির দখল থেকে এই বাড়ি মুক্ত করতে পারেননি বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ নেতা ও রামনাথ স্মৃতি সংসদের নেতাকর্মীরা জানান। 

বাড়িটি দেখতে গিয়ে এবং এ বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় পর্যটক ও সাংবাদিকরা হামলার শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ হামলা হয় গত রোববার বিকালে। 

এদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর রাজীব নূর, বানিয়াচং প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠের বানিয়াচং প্রতিনিধি মোশাহেদ মিয়া, হবিগঞ্জ সমাচারের বানিয়াচং প্রতিনিধি তৌহিদ মিয়া এবং দেশসেবা পত্রিকার বানিয়াচং প্রতিনিধি আলমগীর রেজার উপর হামলা হয়। 

এ অভিযোগে আব্দুল ওয়াহেদ ও তার তিন ছেলের বিরুদ্ধে তৌহিদ মিয়া বানিয়াচং থানায় মামলা করেছেন; ওই মামলায় ওয়াহেদের এক ছেলেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি হবিগঞ্জের বানিয়াচং গ্রামের বিদ্যাভূষণপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন রামনাথ বিশ্বাস। তার বাবা বিরজানাথ বিশ্বাস ও মা গুণময়ী দেবী। রামনাথ বানিয়াচংয়ের হরিশ্চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। সাইকেল নিয়ে তিনি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরেছেন তিন বার। সেসব অভিজ্ঞতা থেকে বাংলা ভাষায় ৪০টি ভ্রমণবিষয়ক বই লিখেছেন। ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর কলকাতায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। 

বিদ্যাভূষণপাড়ায় ৪ একর ৪৮ শতাংশ জায়গায় রামনাথ বিশ্বাসের বসতঘরের পাশাপাশি ছিল একটি দৃষ্টিনন্দন মন্দির ও পুকুর। বাড়িটিকে ঘিরে রেখেছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা আর সবুজ লতাপাতা। পুকুরে দখলদাররা মাছ চাষ করছেন। বর্তমানে বাড়িতে থাকা পুরনো সব ভবন ভেঙে ফেলেছে দখলদাররা। শুধু মন্দিরের একটি অংশ এখনও রয়ে গেছে। সেটিও একটু একটু করে ভাঙা হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান। 

বিদ্যাভূষণ পাড়ার বাসিন্দা কাউছার আহমেদ বলেন, “আব্দুল ওয়াহেদ একজন এলাকার প্রভাবশালী লোক। রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িটি তার অবৈধ দখলে রয়েছে। আর এক্ষেত্রে তিনি আওয়ামী লীগের পদ পদবী ব্যবহার করছেন। বর্তমানে তিনি ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে রয়েছেন। 

দুই নম্বর বানিয়াচং উত্তর-পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হায়দারুজ্জামান খান ধন মিয়া বলেন, “ওয়াহেদ একজন দখলদার। রামনাথ বিশ্বাসেরই বাড়িটি তিনি দখল করে রেখেছেন। অনেক সময় চেষ্টা করেও আমরা বাড়িটিকে দখলমুক্ত করতে পারিনি। তিনি কিছুদিন পরপরই বাড়িকে নিজের নামে নামজারি করে ফেলেন; কিন্তু আমরা সেটাকে বাতিল করাই।” 

স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গেরিলা দলের অন্যতম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দারুজ্জামান খান বলেন, “আব্দুল ওয়াহেদের বড়ভাই আবু ছালেক এই এলাকার চিহ্নিত আলবদর। বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন।” 

রামনাথ স্মৃতি সংসদ সভাপতি ও লোক গবেষক আবু সালেহ আহমেদ বলেন, “দখলদার আব্দুল ওয়াহেদ খুবই প্রভাবশালী; যে কারণে এলাকার কেউ এই বাড়িটি উদ্ধারের জন্য কোনো কথা বলে না। আমি রামনাথের স্মৃতিটুকু বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। সংস্কৃতি কর্মী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কয়েকবার তার ভুয়া নামজারি বাতিল করেছি। সবশেষ ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়েও একবার এটার নামজারি বাতিল করিয়েছি।” 

তিনি বলেন, “বছরখানেক আগে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম হাই কোর্টে রিট করব; কিন্তু স্থানীয়রা যারা আমাদের সাথে ছিলেন তাদেরকে আব্দুল ওয়াহেদ ভয়-ভীতি দেখিয়ে থামিয়ে দেন; যে কারণে আর হাইকোর্টে যাওয়া হয়নি।” 

বানিয়াচং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মাস্টার বলেন, “আমি রামনাথ স্মৃতি সংসদের একজন সদস্য। আমরা দীর্ঘদিন যাবত দাবি জানিয়ে আসছি রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িটি দখলমুক্ত করা হউক। দখলকারী ওয়াহেদের ভাই একজন রাজাকার। ওয়াহেদ সু-কৌশলে বহু বছর আগেই আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।” 

আমির হোসেন আরও বলেন, “আমি ইউনিয়নের সভাপতি ও সম্পাদককে বলেছি তাকে দ্রুত বহিষ্কার করতে। তাদের দেওয়া বরখাস্তের চিঠি পেলেই তা জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।” 

দুই নম্বর বানিয়াচং উত্তর-পশ্চিম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মুত্তাকিম বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন মাস্টার দ্রুত আব্দুল ওয়াহেদকে বহিষ্কার করতে বলেছেন।

“আমরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কমিটির সদস্যরা বসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে উপজেলা কমিটিকে জানাব।” 

বানিয়াচং প্রেসক্লাব সভাপতি মোশাহেদ মিয়া বলেন, “রামনাথের বাড়িতে গেলেই সাংবাদিক ও পর্যটকদের ওপর আক্রমণ করেন ওয়াহেদ মিয়া ও তার ছেলেরা। বিভিন্ন সময় বাড়িটিকে দেখতে গিয়ে পর্যটকরাও তাদের রোষানলে পড়েছেন, লাঞ্ছিত হয়েছেন তাদের হাতে।” 

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান বলেন, “বিষয়টি আমার জানা ছিল না; গণমাধ্যমে জেনেছি। কেউ আমাদের এ বিষয়ে অভিযোগ ও আবেদন দিলে বাড়িটির বিষয়ে খোঁজ-খবর নেব। তবে যেহেতু এটি সরকারি সম্পত্তি নয়, তাই আমরা ওইখানে ইন্টারফিয়ার করতে পারি না।”

আরও পড়ুন: