‘অতিরিক্ত যাত্রীতে’ করতোয়ায় নৌকা ডুবি, ইঙ্গিত তদন্ত কমিটির

তদন্ত দল নৌকা ডুবির ঘটনায় উদ্ধার যাত্রী, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাতকার নিচ্ছে।

সাইফুল আলম বাবুপঞ্চগড প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Sept 2022, 12:51 PM
Updated : 26 Sept 2022, 12:51 PM

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের করতোয়া নদীতে ডুবে যাওয়া নৌকাটি ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে এ ঘটনায় গঠিত জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি।

রোববার দুপুরে আউলিয়া ঘাটে নৌকা ডুবির ঘটনায় সোমবার বিকাল পর্যন্ত ৪৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল।  ঘটনার পর পরই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দীপঙ্কর রায়কে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

নৌকা ডুবির পর অনেকেই অভিযোগ করছিলেন, প্রায় ৩০ ফুটের নৌকাটিতে প্রায় দেড় শতাধিক যাত্রী ছিলেন। তদন্ত দল নৌকা ডুবির ঘটনায় উদ্ধার যাত্রী, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাতকার নিচ্ছে।

বিকালে তদন্ত কমিটির প্রধান দীপঙ্কর কুমার রায় বলেন, “আমাদের তদন্ত চলমান আছে। তবে প্রাথমিকভাবে অতিরিক্ত যাত্রী থাকায় নৌকাডুবি হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।”

তদন্ত কাজ শেষ হলে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলা যাবে বলে জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। 

রোববার মহালয়া উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নৌকায় করে বোদা উপজেলার বরদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন উৎসবে যোগ দিতে। দুপুরের দিকে মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় একটি নৌকা উল্টে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, নৌকাটিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছিল। কিছু মানুষ সাঁতরে নদীর তীরে ফিরতে পারলেও অনেকে নিখোঁজ থাকেন। নৌকাডুবির পরপরই স্থানীয়রা নৌকা নিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নামেন তল্লাশিতে।

হিমালয়ের পাদদেশ থেকে আসা করতোয়া নদী উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় এমনিতে খুব খরস্রোতা নয়; গভীরতাও খুব বেশি নয়। কিন্তু গত দুদিনের টানা বর্ষণের পর উজানের ঢলে নদীতে পানি বেড়েছে অনেকটা। এ ছাড়া এই নদী থেকে অবাধে বালু ও পাথর উত্তোলন করা হয়। ফলে নদীর স্থানে স্থানে বেশ বড় ধরনের গর্ত রয়েছে। 

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, নৌকাটি যখন ঘাট থেকে ছেড়ে যায় তখনও সেখানে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের লোকজন উপস্থিত ছিল। কিন্তু নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী উঠলেও তারা তাতে কোনো বাধা দেননি।

কয়েকজন প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে সরকারের এই লোকজন সেখানে থেকে কী লাভ হলো?

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় একজন তরুণ (২০) জানান, তিনিও ওই নৌকায় করে মন্দিরে যাওয়ার জন্য এসেছিলেন। তার সঙ্গে মোটরসাইকেল ছিল। কিন্তু নৌকায় যাত্রী অনেক বেশি ছিল। যে কারণে তিনি আর যেতে পারেননি।

তিনি আরও বলেন, “মাঝ নদীতে যাওয়ার পরই নৌকাটি কাত হয়ে উল্টে যায়। তখন এপারে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই নেমে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। পরে অবশ্য পুলিশ আর ফায়ার সার্ভিস আসে।”

আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, নৌকাটিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছিল। নৌকা ডুবির পর পার থেকে অনেকেই নৌকা নিয়ে গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেন।

স্থানীয়দের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে বোদা থানার ওসি সুজয় কুমার রায় বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে বলেন, “মহালয়া উপলক্ষে সবাই ছিলেন উৎসবমুখর পরিবেশে। পুলিশ থাকলেও পারাপারে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না।

“তবে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে সতর্কভাবে চলাচলে সংশ্লিষ্টদের মৌখিকভাবে বলা হয়। এরপরও এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা কখনো কারো কাম্য নয়।”

তদন্ত কমিটির সদস্য ও বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোলেমান আলী বলেন, “কমিটি এরই মধ্যে কাজ করছে। আমরা ওই পথে সচরাচর পারাপার হওয়া স্থানীয় লোকজন, ঘটনার দিন দায়িত্বরত এবং হতাহতদের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছি। আশা করি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একটি সুষ্ঠু প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে পারব।”

স্থানীয়রা জানান, বরদেশ্বরী মন্দিরে প্রতি বছরই মহালয়া উপলক্ষে হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে। আশপাশের ৮-১০ জেলার পুণ্যার্থীরা এখানে আসেন। ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবের কারণেই মন্দিরটি এলাকায় বিশেষভাবে পরিচিত। অনেক নারী-পুরুষ মানত আদায় করার জন্য সন্তানদের নিয়ে অনেকে আসেন। প্রতিবারই এই উৎসবে নারী ও শিশুদের উপস্থিতি থাকে লক্ষ্যণীয়।  যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি।

স্থানীয়দের দীর্ঘদিন ধরেই দাবি ছিল, এমন একটি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে একটি সেতু নির্মাণের। জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে এলাকাবাসীকে আশ্বাসও দেন। কিন্তু সেতুর ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সেতুটি হলে এখানে জেলার ইতিহাসে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না বলেই মনে করছেন তারা।

সোমবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় পঞ্চগড়-২ (বোদা-দেবীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য  ও রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন আউলিয়ার ঘাটে পূর্ব প্রতিশ্রুত ওয়াই আকৃতির সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া দ্রুত কার্যকরের ঘোষণা দেন। এ সময় তার সঙ্গে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খানও উপস্থিত ছিলেন।

এ সময় রেলপথ মন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী বেদনাদায়ক এ দুর্ঘটনা সম্পর্কে অবগত আছেন এবং তিনি নিহতদের  ও আহতদের  পরিবারকে গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। ও হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনীয় পুনর্বাসনেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেন।

এর আগে জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম নিহতদের স্বজনদের ২০ হাজার টাকা এবং আহতদের চিকিৎসায় ১০ হাজার টাকা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু মো. রেজাউল করিম শামীম বলেন, এরই মধ্যে হতাহতরা জেলা প্রশাসকের প্রতিশ্রুত অর্থ পেয়েছেন। সরকারের প্রতিশ্রুত অর্থও তারা পেতে শুরু করেছেন।

এ দিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশাসন) লেফটেন্যান্ট কর্ণেল জিল্লুর রহমান বলেন, অভিযান আগামীকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে।

আরও পড়ুন:

Also Read: করতোয়ার পাড়ে স্বজনদের আহাজারি, বাড়ি বাড়ি মাতম

Also Read: উৎসবের মুহূর্ত শোকে স্তব্ধ

Also Read: পঞ্চগড়ের নৌকা ডুবি তদন্তে কমিটি, খোলা হয়েছে তথ্যকেন্দ্র

Also Read: পঞ্চগড়ে তীর্থযাত্রার নৌকা ডুবে মৃত্যু বেড়ে ৪৭

Also Read: করতোয়ায় নৌকাডুবি: ৪০ কিলোমিটার দূরে আত্রাইয়ে মিলল ৭ লাশ

Also Read: পঞ্চগড়ে তীর্থযাত্রার নৌকা ডুবে মৃত্যু বেড়ে ৩২

Also Read: পঞ্চগড়ে তীর্থযাত্রার নৌকা ডুবিতে লাশ বেড়ে ২৪