করতোয়ার পাড়ে স্বজনদের আহাজারি, বাড়ি বাড়ি মাতম

সোমবার ভোর সাড়ে ৫টায় নতুন করে উদ্ধার অভিযান শুরু হচ্ছে; রাজশাহী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম থেকে আসা ডুবুরি দল তল্লাশিতে অংশ নিচ্ছেন।

মো. শাকিল আহমেদসাইফুল আলম বাবুবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Sept 2022, 10:21 AM
Updated : 26 Sept 2022, 10:21 AM

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীর পাড়ে এখন নৌকা ডুবিতে নিহত স্বজনদের আহাজারি আর শোকের মাতম চলছে। তারা চান, যত দ্রুত সম্ভব প্রিয়জনের লাশটি উদ্ধার করে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হোক।

নৌকা ডুবির ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর শুধু করতোয়া নয়; আশপাশের পুনর্ভবা, আত্রাই নদীর পাড় ধরেও স্বজনদের ছুটতে দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডুবুরি দলের নৌকার সঙ্গে তাল মিলিয়েও অনেকে চলছেন ভাটির দিকে।    

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, স্রোতের টানে হয়তো লাশগুলো আশপাশের নদ-নদীতে চলে গেছে। করতোয়া নদী থেকে প্রচুর বালু ও পাথর উত্তোলন করে থাকে শ্রমিকরা। হতে পারে, লাশ সেই গর্তে পড়ে বালুতে ঢাকা পড়ে গেছে। 

এসব কারণে লাশ উদ্ধারে দেরি হচ্ছে বলে সোমবার দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন বোদা থানার ওসি সুজয় কুমার রায়। 

রোববার মহালয়া উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নৌকায় করে বোদা উপজেলার বরদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন উৎসবে যোগ দিতে। দুপুরের দিকে মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় একটি নৌকা উল্টে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, নৌকাটিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছিল। কিছু মানুষ সাঁতরে নদীর তীরে ফিরতে পারলেও অনেকে নিখোঁজ থাকেন। নৌকাডুবির পরপরই স্থানীয়রা নৌকা নিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নামেন তল্লাশিতে।

রোববার ২৫টি লাশ উদ্ধারের পর অন্ধকার হয়ে গেলে অভিযান স্থগিত করা হয়। সোমবার সকাল থেকে আরও ১৪টি লাশ উদ্ধার করা হয়। মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৯ জনে। সোমবার সাতটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ ও খানসামা থেকে। এখনও অর্ধশতের বেশি মানুষ নিখোঁজ রয়েছে বলে নিখোঁজদের স্বজন ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। 

সকালেই মাড়েয়া ইউনিয়নের গেদিপাড়া গ্রামের কৃষ্ণ রায় (৫৫) এসেছেন দুই ছেলের লাশের খোঁজে। তিনি জানান, নৌকা ডুবিতে নিখোঁজ রয়েছেন ছেলে জগদীশ রায় (২৫) এবং অষ্ট রায় (২০)।  

তিনি বলেন, “রোববার অনেক রাত পর্যন্ত ছিলাম। ছেলে দুটোরে পাইনি। আজও  সকালে আবার এসেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো খবরই নাই। কী হবে, ভগবান কী রাগ করিছে?”

মা বিজু বালা (৫০), কাকীমা সুমি রাণীর (৪৫) খোঁজে করতোয়া পাড়ে এসেছেন মণিকা রাণী (৩০)।

তিনি বলেন, “মা আর কাকীমা ছিল নিজের বোনের মতো। মা যেমন কোনো ভালো কিছু রান্না করলে আগে কাকীমাকে দিতেন, তেমনি ছিলেন কাকীমাও। তার বাসায় নতুন মেহমান আসলেও সেটা আগে মাকে জানাতেন।

“তারা তাদের বৌমাকেও মহালয়ার উৎসবে নিয়ে যাচ্ছিলেন। হায় কপাল! একসঙ্গে তারা নিখোঁজও হয়ে গেলেন। তাদের চিন্তায় বাবা সকাল পর্যন্ত কিছু মুখে দেননি। বাসায় সবাই পাগলপ্রায়।”

সকালেই নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে আরাজি শিকারপুর গ্রাম থেকে করতোয়া নদীর পাড়ে এসেছেন মধ্য বয়সী এক ব্যক্তি। তিনি জানান, তার পরিবারের এক সদস্য এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে লাশটি খুঁজে দেওয়ার অনুরোধ করছিলেন।

একই গ্রামের আরেক তরুণ (২৪) বলেন, রাতেই অনেকেই টর্চলাইট নিয়ে নদীর পাড়ে খোঁজ করেছেন। যদি কারো লাশ ভেসে উঠে। ভোর হওয়ার আগেই অনেকে এসেছেন লাশের খোঁজে।

কিন্তু লাশ উদ্ধারের ধীর গতিতে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের বটতলি গ্রামের প্রভাত (৬৫) কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলেন, ছেলে কিশোর (৪৫), তার স্ত্রী কণিকা (৪০) ও ভাইয়ের মেয়ে পারুল ভগবানকে পূজা দিতে বরদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিল।

“কিন্তু নৌকায় লোক বেশি থাকায় আমি সাবধানে থাকতে বলেছিলাম। ওরাও ভগবানের নাম জপে জপে যাচ্ছিল। তীরে যেতে যেতে ভগবান বুঝি ওদের ছেড়ে চলে যায়। ডুবে যায় নৌকা। একশর বেশি লোক সবাই নদীতে ভেসে যায়।”

করতোয়া পাড়ে আরেক বৃদ্ধ জানান, তার বোন ও বোনের শাশুড়ির লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু বোনের মেয়ের লাশের জন্য তিনি নদীর পাড়ে এসেছেন।

এই বৃদ্ধ আরও জানান, আরাজি শিকারপুর গ্রামের একটি পরিবারের তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও দুজন নিখোঁজ রয়েছে। পরিবারটির মোট সাত সদস্য মন্দিরে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিল। নৌকা ডুবির পর দুই বোন অর্পিতা ও আলোকে উদ্ধার করা হয়েছে। অর্পিতার দুই মেয়ে নিখোঁজ রয়েছেন। পরিবারটিতে এখন শোকের মাতম চলছে। 

স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, বোদা উপজেলার ছত্রশিকারপুর গ্রামেরও একটি পরিবারের চারজন মারা গেছেন। এর মধ্যে দুজন নারী ও দুজন শিশু। তারা হলেন- গৃহবধূ তারা রায় (২২) ও লক্ষ্মী রানী রায় (২২), তারা রায়ের ছেলে দীপঙ্কর রায় (৫) এবং বিজন রায় (৭)।

হিমালয়ের পাদদেশ থেকে আসা করতোয়া নদী উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় এমনিতে খুব খরস্রোতা নয়; গভীরতাও খুব বেশি নয়। কিন্তু গত দুদিনের টানা বর্ষণের পর উজানের ঢলে নদীতে পানি বেড়েছে অনেকটা।

নিহতদের মধ্যে উপজেলার রয়েছেন মাড়েয়া গ্রামের হেমন্তের মেয়ে পলি রানী (১৪), নির্মল চন্দ্রের স্ত্রী শোভা রানী, শালডাঙ্গা খালপাড়ের কার্তিকের স্ত্রী লজ্জা রানী (২৫), দেবীগঞ্জের শালডাঙ্গা হাতিডোবা গ্রামের বাবুল চন্দ্র রায়ের ছেলে দিপংকর (৩), পশ্চিম শিকারপুর গ্রামের কালীকান্তর ছেলে অমল চন্দ্র (৩৫),  বোদার মাড়েয়া বামনপাড়ার সজিবের আড়াই বছর বয়সী ছেলে পিয়ন্ত, মহানন্দর স্ত্রী খুকি রানী (৩৫), দেবীগঞ্জের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের চণ্ডী প্রসাদের স্ত্রী প্রমিলা রানী (৫৫), দেবীগঞ্জের হাতিডোবার শিকারপুর গ্রামের রবিনের স্ত্রী তারা রানী (২৪), পাঁচপীর বংশীধর পূজারী গ্রামের প্রয়াত ভুড়া মহনের স্ত্রী শোনেকা রানী (৬০), বোদার মাড়েয়া শিকারপুর প্রধান পাড়া গ্রামের শ্রী মণ্টুর স্ত্রী কাঞ্জুনি রানী (৫৫), পাঁচপীর জয়নন্দ্র বজয়া গ্রামের মহানন্দ মাস্টারের মা প্রমীলা (৭০), দেবীগঞ্জ তেলিপাড়া গ্রামের প্রয়াত কলিন্দ্রনাথের স্ত্রী ধনো বালা (৪৭), পাচঁপীর বংশীধর গ্রামের রথেশ চন্দ্রের স্ত্রী সুমিত্রা রানী (৫৭), ময়দানদিঘীর চকপাড়া গ্রামের বিলাস চন্দ্রের স্ত্রী সফলতা রানী (৪০), বোদা উপজেলার মাড়েয়া বাসনহাট গ্রামের রমেশের স্ত্রী শিমলা রানী (৩৫), বোদা উপজেলার বড়শশী কুমারপাড়া গ্রামের হাচান আলী (৫২), একই উপজেলার আলোকপাড়া গ্রামের রমেশের শিশু কন্যা উশোশী, দেবীগঞ্জের হাতিডোবার নারায়নের শিশু কন্যা তনুশী, পাঁচপীর মদনহার গ্রামের রতন চন্দ্রের শিশু কন্যা শ্রেয়শী।

আরও পড়ুন: