শুভ মহালয়ার মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার মর্তে আগমনের ক্ষণ গণনা শুরু হয়। সেই দেবীপক্ষের সূচনায় পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বরদেশ্বরী মন্দিরে বসে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসব। দেবী আবাহনের সেই উৎসবেই প্রতি বছরের মতো যাচ্ছিলেন শত শত পুণ্যার্থী।
কিন্তু করতোয়া নদী পাড়ির সময় সেই উৎসবের রং মুহূর্তেই রূপ নেয় শোকে। নৌকা ডুবে মারা যান ২৪ জন; এখন পর্যন্ত ৩০ জনের নিখোঁজের তালিকা দিয়েছেন স্বজনরা।
হিমালয়ের পাদদেশ থেকে আসা করতোয়া নদী উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় এমনিতে খুব খরস্রোতা নয়; গভীরতাও খুব বেশি নয়। কিন্তু গত দুদিনের টানা বর্ষণের পর উজানের ঢলে নদীতে পানি বেড়েছে অনেকটাই।
আর ধারণ ক্ষমতার অনেক বেশি তীর্থযাত্রী উঠে যায় নৌকায়। মাঝ নদীতে নৌকা ডুবির কারণে হতাহতের ঘটনা তাই এত বেশি বলে মনে করছে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।
বোদা উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের ত্রিশোর্ধ্ব এক যুবক করতোয়া নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের বলছিলেন, “গতকাল থেকে এখানে মহালয়ার উৎসব শুরু হয়েছে। যে কারণে আশপাশের অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন নদী পাড় হয়ে মন্দিরে যাচ্ছিল। আজ যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে গেছে। এতে অনেক লোক মারা গেছে। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে। আমার পাশের গ্রামের এক পরিবারের সাতজনের মধ্যে চারজন মারা গেছেন।”
নৌকা ডুবির ঘটনার সময় মাড়েয়া ঘাটের পাড়েই ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আজম আলী। তিনি ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া নৌকাটি ডুবে যেতে দেখেছেন।
তিনি বলেন, “এই ঘাটে অনেক লোকজন পারাপার হয়। পূজা উপলক্ষে এখন হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রচুর লোকজন পার হচ্ছে। এর মধ্যে আজকে হঠাৎ নৌকা ডুবে গিয়ে অনেক লোকজন মারা গেছে। আমি ১৬-১৭টা লাশ উঠতে দেখছি।”
নদী পার হয়ে মন্দিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বাড়ি থেকে এসেছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের এক নারী (৪০)। কিন্তু ভীড়ের কারণে তিনি পরের নৌকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর এতেই তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
ওই নারী বলছিলেন, “নৌকাটি হঠাৎ কাত হয়ে যায় এবং পরে ডুবে যায়। মানুষ চিৎকার করছে। আমরা এখান থেকে শুনছি। তারা সবাই পূজা দিতে যাচ্ছিল। আমিও আসছিলাম। এখন তো এই অবস্থা।”
স্থানীয়রা জানান, বরদেশ্বরী মন্দিরে প্রতি বছরই মহালয়া উপলক্ষে হাজার হাজার মানুষের আগমন ঘটে। আশপাশের ৮-১০ জেলার পুণ্যার্থীরা এখানে আসেন। ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবের কারণেই মন্দিরটি এলাকায় বিশেষভাবে পরিচিত। অনেক নারী-পুরুষ মানত আদায় করার জন্য সন্তানদের নিয়ে অনেকে আসেন। প্রতিবারই এই উৎসবে নারী ও শিশুদের উপস্থিতি থাকে লক্ষ্যণীয়।
এখন পর্যন্ত যে ২৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তার মধ্যে ১২ জন নারী, আটজন শিশু আর চারজন পুরুষ। ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ ছাড়া বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদে জরুরি তথ্যকেন্দ্র খোলা হয়েছে। যে কোনো প্রয়োজনে ০১৭০৮-৩৯৭৭১৮ ও ০১৭১৯-৩৪৭১৭৩ এই নম্বরে যোগাযোগ করতে বলেছে জেলা প্রশাসন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় একজন তরুণ (২০) জানান, তিনিও ওই নৌকায় করে মন্দিরে যাওয়ার জন্য এসেছিলেন। তার সঙ্গে মোটরসাইকেল ছিল। কিন্তু নৌকায় যাত্রী অনেক বেশি ছিল। যে কারণে তিনি আর যেতে পারেননি।
তিনি আরও বলেন, “মাঝ নদীতে যাওয়ার পরই নৌকাটি কাত হয়ে উল্টে যায়। তখন এপারে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই নেমে উদ্ধার কাজ শুরু করেন। পরে অবশ্য পুলিশ আর ফায়ার সার্ভিস আসে।”
আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, নৌকাটিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছিল। নৌকা ডুবির পর পার থেকে অনেকেই নৌকা নিয়ে গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করেন।
নদীর পাড়ে আসা ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ জানান, তার ছেলে ও শ্যালকের স্ত্রীর লাশ পাওয়া গেছে। শ্যালক হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তবে তার অবস্থা ভাল না।
আহতদের উদ্ধার করে সঙ্গে সঙ্গে বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার খবর পেয়ে জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন।
স্বজনদের খোঁজ নিতে অনেকেই নদীর পাড়ে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শোকার্তদের আহাজারি চলছে বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও।