বৃহস্পতিবার কারখানায় বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল যাচ্ছে; তাদের মতামতের ভিত্তিতে উদ্ধার অভিযান শুরু করার কথা বলছে ফায়ার সার্ভিস ও প্রশাসন।
Published : 29 Aug 2024, 12:43 AM
দিনভর লুটপাট শেষে রোববার রাতে যখন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রূপসীতে গাজী টায়ারসের কারখানায় অগ্নিসংযোগ করা হয়, তখন সেখানে এসে নিখোঁজ হন মো. আমান উল্লাহ (২১)৷
তারপর থেকে তিন দিন ধরে ছেলের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে কারখানা এলাকায় ঘুরছেন আব্দুল বাতেন ও রাশিদা বেগম দম্পতি৷
চার ভাই-বোনের মধ্যে সেজো আমান স্থানীয় একটি ব্যাটারি তৈরির কারখানায় কাজ করতেন৷ পরিবারের সঙ্গে তারাব বিশ্বরোড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন এ তরুণ৷
আমানের খোঁজ পেতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বেশ কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ করেছেন পরিবারের সদস্যরা৷ কোথাও খোঁজ পাননি৷
আগের তিন দিনের মত বুধবার সন্ধ্যা ৭টার দিকেও কারখানাটির ফটকের সামনে রাশিদা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ‘কারখানার ভেতরে কারও লাশ পাওয়া গেছে কি-না’ জানতে চান৷
ইতিবাচক উত্তর না পেয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে এ বৃদ্ধা বলেন, “চাইর দিন ধইরা তারা করতেছে কী? কত মানুষ দেহি বড় বড় খালি গাড়ি লইয়া আহে আর যায়। তারা কি কিচ্ছু করে না? আমার পোলাডারে তো পামুই না জানি, কঙ্কালটা পাইলেও তো আত্মাডা ঠান্ডা হইতো৷ হেইডাও তো দিতেছে না৷”
সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী রোববার ভোরে গ্রেপ্তারের পর দুপুর থেকে তার মালিকানাধীন গাজী টায়ারসের কারখানাটিতে লুটপাট চালায় আশপাশের শত শত মানুষ। পরে রাতে তারা কারখানার মূল ভবনটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। প্রায় ৪০ ঘণ্টা ধরে জ্বলে সেই আগুন। এরই মধ্যে ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। প্রতিদিনই নিখোঁজদের খোঁজে কারাখানা চত্বরে ভিড় করছেন স্বজনরা।
দীর্ঘ এই সময়েও কারখানাটির ভেতরে উদ্ধার অভিযান শুরু না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। তোলেন নানা প্রশ্নও।
তবে ফায়ার সার্ভিস ও জেলা প্রশাসন বলছে, আগুনে ভবনটি ‘অনিরাপদ হয়ে পড়েছে’, তাই বৃহস্পতিবার বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বুধবার সকাল থেকে উৎসুক জনতার পাশাপাশি স্বজনদের কারখানার সামনে ভিড় না করার অনুরোধ জানান নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা৷
এ অনুরোধে অনেক স্বজন বিরক্তি প্রকাশ করেন৷ ক্ষোভও ঝাড়তে দেখা যায় কাউকে কাউকে৷
নিখোঁজ আমানের মা রাশিদা বেগম বলেন, “আমার পোলা পাইতেছি না, আর আমারে কইতেছে, ভিত্রে কেউ নাই, যান গা৷ নিখোঁজ মানুষরে দিতারে না, খালি মানু খেদাইয়া দেয়৷ বাইর কইরা দেয়৷ তারা তো কিছু কয় না৷ বাবা, তোমরা তো ভিত্রে যাও, আমার বাবার খবরডা লইও৷”
কিন্তু কেউ ভেতরে যেতে পারছে না; ফলে রাশিদা বেগমও আর ছেলের কোনো খোঁজ পাননি।
‘এখন তো হাড্ডি ছাড়া কিচ্ছু পামু না’
নিখোঁজ মনির হোসেনের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে সন্ধ্যায় তার ভাই জাকিরকে কারখানাটির ভেতরে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়৷ মনির গাজী টায়ারস কারখানার শ্রমিক ছিলেন বলে দাবি জাকিরের৷
৫ অগাস্টে প্রথম দফায় এ কারখানাটিতে হামলা হওয়ার পর কারখানাটির উৎপাদন কাজ বন্ধ থাকায় আর কাজে আসেননি মনির৷ জুলাই মাসের বেতনও তার বকেয়া রয়েছে বলে জানান জাকির৷
২৫ অগাস্ট রাতে কারখানাটিতে আগুন দেওয়ার আধাঘণ্টা আগে বন্ধুদের সঙ্গে আসেন মনির৷ ভবনটির তৃতীয় তলায় ছিলেন তিনি৷ আগুন লাগার পর সঙ্গে থাকা তিন বন্ধু বেরিয়ে যেতে পারলেও মনির আটকা পড়েন৷
মনিরের ভাই জাকির বলেন, “একদিন পর উদ্ধারে গেলেও তো লাশটা পাইতাম৷ এখন তো হাড্ডি ছাড়া কিচ্ছু পামু না৷”
ফায়ার সার্ভিস ও নিরাপত্তায় থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বুধবার দুপুরে ভবনটির ভেতরে ঢুকেছিলেন বলে দাবি করেন ইউসুফ আলী৷ তার ১৯ বছর বয়সী ভাতিজা মো. মজনু ইসলাম নিখোঁজ৷
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, “প্রতিদিন আসতেছি, প্রতিদিনই ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি৷ উদ্ধার তো কাউরে করতেছে না৷ সাহস কইরা আজকা সিঁড়ি দিয়ে তিনতলা পর্যন্ত গেছিলাম৷ অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না৷ আমি যদি যাইতে পারি, প্রশাসনের লোকজন কেন যাইতে পারে না?”
বিকালে কারখানাটি পরিদর্শন শেষে প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলছিলেন, “ভবনটি অনিরাপদ থাকায় উদ্ধার অভিযান শুরু করা যাচ্ছে না৷ উদ্ধার অভিযান শুরু করা যাবে কি-না তা জানতে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷”
হামিদুর রহমানের কথাগুলো দাঁড়িয়ে শুনছিলেন ইউসুফ৷
প্রশাসনের লোকজন একটু সরে গেলে ইউসুফ প্রতিবেদকের কাছে জানতে চান, “কালকে কি তারা (ভবনে) ঢুকবে ভাই? নাকি কালকেও বলবে পরশুর কথা? এত দেরি কেন করতেছে? তারা কি চায় না, আমরা আমাদের মানুষগুলার হাড্ডিটা অন্তত পাই?”
বুধবারও নিখোঁজ তালিকা করেছে প্রশাসন
সোমবার স্বজনরা এসে দায়িত্বরত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের কাছে তাদের নাম-ঠিকানা জমা দিয়েছিলেন, যেন খোঁজ পেলে তাদের জানানো হয়। কিন্তু পরে ফায়ার সার্ভিস সেই তালিকার বিষয়টি অস্বীকার করে।
সেই পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার সকাল থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা কারখানার ফটকের সামনে নিখোঁজদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। তারা নিখোঁজ ব্যক্তিদের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র রেখে তালিকাভুক্ত করছিলেন। বিকালে তারা ১২৫ জনের নাম স্বজনদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন বলে সাংবাদিকদের জানান।
এদিন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে রূপগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু তারা মঙ্গলবার কতজনের তালিকা করেছেন সেটি জানাতে চাননি।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তারা শিক্ষার্থীদের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা করবেন।
বুধবারও কারাগারের ফটকের ভেতরে রূপগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্বজনদের কাছ থেকে নিখোঁজদের নাম রাখছেন। তারা নিখোঁজ ব্যক্তির ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র রেখে তালিকাভুক্ত করছেন। কিন্তু তালিকায় কতজনের নাম এসেছে এ ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হননি সংশ্লিষ্টরা।
তবে এদিন বৈষম্যমূলক ছাত্র আন্দোলনের কাউকে আর তালিকা করতে দেখা যায়নি। তারা সেখানে ছিলেনও না।
তালিকাভুক্ত নিখোঁজের সংখ্যা না বললেও সকালে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “যে ব্যক্তি এসে বলছেন যে, তার স্বজন নিখোঁজ আছেন তাদের নাম-ঠিকানা আমরা লিপিবদ্ধ করছি৷ আমরা প্রকৃত সংখ্যা বলতে পারছি না৷ তবে আগুনের সময় ভবনটিতে শতাধিক ব্যক্তি ছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন৷
“যদিও নির্দিষ্ট কোনো প্রুফ আমরা পাইনি৷ কিন্তু এখানে একজন মানুষ থেকে থাকলেও সেটি গুরুত্ব সহকারে নেব৷ আমাদের মূল চেষ্টাটা হল ভেতরের অবস্থাটা কী তা দেখা৷”
তবে তিনি এর সঙ্গে যোগ করেন, ফায়ার সার্ভিসের ড্রোন, বড় মই (টিটিএল) দিয়ে ভবনের ভেতরে একাধিকবার অনুসন্ধান চালানো হয়েছে৷ ভবনটির চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত মেঝে ধসে পড়েছে৷ কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো মরদেহের সন্ধান মেলেনি।
“এখানে যেহেতু অনেক বেশি কেমিকেল পুড়েছে, সুতরাং কোনো মানুষ যদি আদৌ থেকেও থাকে তা অক্ষত অবস্থায় পাওয়ার সম্ভাবনা তেমন নেই৷ কেননা অন্তত ২২ ঘণ্টা টানা আগুন জ্বলেছে৷ যেখানে তিন-চার ঘণ্টার মধ্যেই একটা মানুষের দেহ পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ার কথা।”
বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা যাচ্ছেন বৃহস্পতিবার
গাজী টায়ারসে আগুনের ঘটনার চার দিন পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত ছয়তলা ভবনটিতে উদ্ধার অভিযান শুরু করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস৷ ভবনটির অবস্থা ‘অনিরাপদ’ থাকায় উদ্ধার অভিযান শুরু করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তারা৷
বিকালে প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি কারখানাটি পরিদর্শন করে জানিয়েছে, উদ্ধার অভিযানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে বৃহস্পতিবার৷
স্থানীয় জনবলের মাধ্যমে উদ্ধার অভিযান চালানোয় সক্ষম না হলে জাতীয়ভাবে অভিজ্ঞদের সহযোগিতা চাওয়া হবে, প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ দলকে ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়ছেন তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান৷
নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ছাইফুল ইসলাম বুধবার সন্ধ্যায় বলেন, “আগুন নেভানো গেলেও ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে৷ এ ব্যাপারে আমরা সিদ্ধান্ত দিতে পারছি না৷ বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল বৃহস্পতিবার আসবে৷ তারা সিদ্ধান্ত দেবেন৷”
ভবনে আবারও আগুন
এদিকে, সন্ধ্যা ৭টার দিকে কারাখানার ষ্ষ্ঠ তলার ভবনটিতে আবারও আগুন জ্বলতে দেখা গেছে৷
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল মন্নান বলেন, “কিছুটা ফ্লেম এখনো রয়েছে৷ কারণ, সব তো প্ল্যাস্টিক আর রাবার, এগুলো গলে গলে পড়ে আবার উত্তাপ থেকে আগুন ধরে যায়৷
“তবে, এ আগুন ছড়ানোর কোনো সুযোগ নেই৷ আমরা কাজ করছি৷”
আরও পড়ুন
গাজী টায়ারসে উদ্ধার অভিযান নিয়ে সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার
গাজী টায়ারস: ৪ দিনেও শুরু হয়নি উদ্ধার অভিযান
গাজী টায়ারসে আগুন-লুটপাট: জেলা প্রশাসনের ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি
গাজী টায়ারসে আগুন: এবার নিখোঁজদের তালিকা করছে প্রশাসন ও শিক্ষার্থ
'আমার ভাইয়ের লাশটাও পাইতেছি না গো'
গাজী টায়ারস: ৩২ ঘণ্টা পর নিভেছে আগুন, ভবন ধসের শঙ্কা
গাজী টায়ারস: মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো, তারপর লুটপাট-আগুন
গাজী টায়ার: ২২ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে, তবে পুরোপুরি নেভেনি
গাজী টায়ারস: ২১ ঘণ্টায়ও নেভেনি আগুন, লুটপাট চলছেই
গাজী টায়ারস: ৪ দিনেও শুরু হয়নি উদ্ধার অভিযান
লুটপাট-অগ্নিসংযোগ: ১৪ ঘণ্টায়ও নিয়ন্ত্রণে আসেনি গাজী টায়ার কারখানার আগুন