নিখোঁজদের ব্যাপারে তথ্য জানতে রোববার একটি গণশুনানির আয়োজন করা হচ্ছে বলে জানান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক৷
Published : 31 Aug 2024, 05:23 PM
নিখোঁজ ছোট ভাইয়ের সন্ধান পেতে টানা চারদিন গাজী টায়ারস কারখানার সামনে অপেক্ষা করেছেন জাকির হোসেন৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ভবনে ঢুকে ভাই মনির হোসেনের জুতো জোড়া খুঁজে পেলেও মেলেনি কোনো দেহাবশেষ৷
তাই মায়ের অনুরোধে ‘জুতো আর পোড়া ভবন থেকে একমুঠো ছাই’ হাতে সুনামগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন জানিয়ে জাকির বলেন, “মায় কইছে, বাবার হাড়গোড়ও তো পাইলি না, একমুঠ ছাই নিয়া আসিস৷”
শুক্রবার মোবাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলার সময় কাঁদতে কাঁদতে তিনি আরও বলেন, “কয়টা দিন ধইরা অপেক্ষাই তো করছি৷ আমার তরতাজা ভাইটার হাড়গোড়ও পাইলাম না, এই দুঃখ আমার আজীবন থাকবো৷ হাড্ডি-কঙ্কাল পাইলেও তো মনটারে বুঝ দিতে পারতাম৷ কিচ্ছুই তো দিতে পারল না৷”
নিখোঁজ মনিরকে মৃত ধরে নিয়ে শুক্রবার জুমার পর সুনামগঞ্জ সদরের আমপাড়া গ্রামে ‘গায়েবানা জানাজা’ পড়ানো হয়েছে বলে জানান জাকির৷
জাকিরের ২৮ বছর বয়সী ছোটভাই মনির গাজী টায়ারস কারখানাটিতে চাকরি করতেন৷ স্ত্রী ও তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে কারখানার পেছনে মৈকুলী গ্রামে ভাড়াবাসায় থাকতেন৷
মনিরের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, ৫ অগাস্ট প্রথম দফায় এ কারখানাটিতে হামলা হওয়ার পর কারখানাটির উৎপাদন কাজ বন্ধ থাকায় আর কাজে আসেননি মনির৷ জুলাই মাসের বেতনও তার বকেয়া রয়েছে।
তবে ২৫ অগাস্ট রাতে কারখানাটিতে হামলার খবর পেয়ে আগুন দেওয়ার আধ ঘণ্টা আগে বন্ধুদের সঙ্গে আসেন মনির৷ ভবনটির তৃতীয় তলায় ছিলেন তিনি৷ আগুন লাগার পর বন্ধুরা বেরিয়ে যেতে পারলেও আটকা পড়েন মনির৷
যদিও কারখানা কর্তৃপক্ষের দাবি, আগুনের ঘটনায় তাদের কোনো কর্মী নিখোঁজ বা হতাহত হননি৷
জাকির জানান, ভাইয়ের নিখোঁজের খবর পেয়ে টানা চারদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টানা চারদিন গাজী টায়ারস কারখানার সামনে অপেক্ষা করেছেন।
এর মধ্যে বুধবার দুপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের চোখ এড়িয়ে ভবনের তৃতীয় তলা পর্যন্ত উঠেছিলেন৷ তখন ভবনের তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্ত নিচতলায় (বেজমেন্টে) ছোট ভাইয়ের জুতা জোড়া খুঁজে পেয়েছেন৷ এই জুতা মাসখানেক আগে তিনিই কিনে দিয়েছিলেন৷
জাকির বাড়ি ফিরে গেলেও এখনো অনেক স্বজনই প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে পুড়ে যাওয়া কারখানার সামনে প্রতিদিনই হাহাকার করছেন। সুযোগ পেলে নিরাপত্তা প্রহরীদের বাধা সত্ত্বেও কারখানার ভেতরে ঢুকে ভবনটি থেকে কেউ কেউ পোড়া ছাই-মাটি নিয়ে যাচ্ছেন।
‘যার সন্তান যায় সে ছাড়া আমার কষ্ট কেউ বুঝবো না’
শুক্রবার বিকালেও কারখানার প্রধান ফটকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের ভিড় দেখা যায়৷ জীবিত পাবার আশা ছেড়ে দিয়ে প্রিয়জনের দেহাবশেষটা পাবার অপেক্ষার কথা জানান তারা৷ উদ্ধার অভিযান না হওয়াতে ক্ষোভ ঝাড়েন কেউ কেউ৷
সন্তানের খোঁজ না পেয়ে ক্ষুব্দ কুলসুম বেগম বলেন, “তারা যদি না পারে তাহলে আমরা গিয়ে খুঁজবো৷ যদি বিল্ডিং ভাইঙা গায়ে পড়ে, পড়ুক৷ তাও তো মনে একটা সান্তনা থাকবো৷ তারা তো আমার কষ্ট বোঝে না৷ যার সন্তান যায় সে ছাড়া আমার কষ্ট কেউ বুঝবো না৷”
তারাব পৌরসভার গঙ্গানগর এলাকার বাসিন্দা কুলসুমের ছেলে মো. সজীব (২০) ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাতেন৷
নিখোঁজদের উদ্ধারে কোনো তৎপরতা দেখছেন না অভিযোগ করে যারপরনাই ক্ষুব্দ আরেক স্বজন রাশিদা বেগম বলে, “বাংলাদেশে আর কোথাও কি কহনো আগুন লাগে নাই, নাকি গাজীর ফ্যাক্টরিই প্রথম? এতগুলা মানুষ নিখোঁজ, তাগোরে খুঁজবো না? মানুষ না পাউক হাড়গোড় তো দিবো৷”
রাশিদা তার বৃদ্ধ স্বামী আব্দুল বাতেনকে নিয়ে সোমবার ভোর থেকে ছেলে আমান উল্লাহর ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে কারখানার গেটে এসে দাঁড়াচ্ছেন।
পরিবারের সদস্যরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার একাধিক হাসপাতালে খোঁজ করেছেন, লাভ হয়নি৷
গত ২৫ অগাস্ট বিকাল থেকে লুটপাটের পর রাত ৯টার দিকে নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী এলাকার গাজী টায়ারস কারখানায় আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা৷ প্রায় ৪০ ঘণ্টা ধরে জ্বলে সেই আগুন।
এ ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছে বলে দাবি তাদের স্বজনদের৷
নিখোঁজদের ব্যাপারে তথ্য জানতে রোববার গণশুনানি
আগুনের ঘটনার ছয়দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সংস্থা নিখোঁজদের তালিকা প্রকাশ করেনি। ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করায় ভবনটিতে কোনো অনুসন্ধানও চালানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস৷
তবে নিখোঁজদের ব্যাপারে তথ্য জানতে আগামী ১ আগস্ট একটি গণশুনানির আয়োজন করা হচ্ছে বলে জানান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক৷ এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি কারখানার প্রধান ফটকেও সাঁটানো হয়েছে৷
জেলা প্রশাসক বলেন, নিখোঁজদের প্রকৃত সংখ্যা জানতে একটি চূড়ান্ত তালিকা তৈরির জন্য কাজ করছেন তারা। সেজন্য তদন্ত দল শনিবার নিখোঁজদের স্বজনদের নিয়ে একটি গণশুনানির আয়োজন করেছে। প্রতিটি ব্যক্তির বিষয়ে আলাদা করে যাচাই-বাছাই চলছে। পরে নিখোঁজদের প্রকৃত তালিকা প্রকাশ করবেন তারা।
এর আগে আগুনের ঘটনার তদন্তে গত মঙ্গলবার জেলা প্রশাসন ৮ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে৷
পুরানো খবর
গাজী টায়ারস: ভবনের বেজমেন্টে আগুন পৌঁছায়নি, সেখানে কোনো ‘ভিক্টিম’ নেই
গাজী টায়ারস: ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে ঢুকে উদ্ধার অভিযান চালানো ‘খুবই বিপজ্জনক’
গাজী টায়ারসে উদ্ধার অভিযান নিয়ে সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার
গাজী টায়ারসে আগুন-লুটপাট: জেলা প্রশাসনের ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি
গাজী টায়ারস: ৪ দিনেও শুরু হয়নি উদ্ধার অভিযান
গাজী টায়ারসে আগুন-লুটপাট: জেলা প্রশাসনের ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি
গাজী টায়ারসে আগুন: এবার নিখোঁজদের তালিকা করছে প্রশাসন ও শিক্ষার্থ
'আমার ভাইয়ের লাশটাও পাইতেছি না গো'
গাজী টায়ারস: ৩২ ঘণ্টা পর নিভেছে আগুন, ভবন ধসের শঙ্কা
গাজী টায়ারস: মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো, তারপর লুটপাট-আগুন
গাজী টায়ার: ২২ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে, তবে পুরোপুরি নেভেনি
গাজী টায়ারস: ২১ ঘণ্টায়ও নেভেনি আগুন, লুটপাট চলছেই
লুটপাট-নাশকতা: ১৪ ঘণ্টায়ও নিয়ন্ত্রণে আসেনি গাজী টায়ার কারখানার