দেশে বিদেশে: ফ্লোরিডা ও ডিজনি ওয়ার্ল্ড, পর্ব ১৪

আমরা যারা দেশে বসবাস করছি তাদের অনেকেই হয়ত ভেবে থাকি যে, আহ! একবার যদি দেশের বাইরে যেতে পারতাম তাহলে এটা সেটা কতো কি ঘুরে ফিরে দেখতে পারতাম। মনের কল্পনায় বিশ্বের সেরা দর্শনীয় স্পটগুলো দেখার আগ্রহ কার না থাকে!

মো. রওশন আলম, যুক্তরাষ্ট্র থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 March 2020, 09:36 AM
Updated : 12 March 2020, 09:36 AM

যেমন আগ্রার তাজমহলের কথা ধরুন। প্রায় চারশো বছর আগে সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী মমতাজ মহলের প্রতি গভীর ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ নির্মাণ করেছিলেন এ তাজমহল। বিশেষ আর্কিটেকচারে নির্মিত এ তাজমহল দেখার চাহিদা আজো মানুষের নিকট ফুরিয়ে যায়নি। বরং বেড়েছে।

প্রায় সাত থেকে আট মিলিয়ন মানুষ প্রতি বছর সেখানে ভিড় জমায়। সেরূপ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সীমানা দিয়ে প্রবাহিত নায়াগ্রা ফলস সৃষ্টির এক অসাধারণ সৃষ্টি যা দেখতে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে সেখানে। তেমনি চীনের প্রাচীর, মিশরের পিরামিড, জর্ডানের পেত্রা, মেক্সিকোর চিছেন ইটজা, ইতালির সেই হিস্টোরিক দ্য রোমান কোলোসিয়ামের মতো পৃথিবীর নামিদামি আলোচিত জায়গাগুলো ঘুরে দেখার বাসনা আমাদের কারো কারো মনে উঁকিঝুঁকি তো দিতেই পারে। এসব ছাড়াও দুনিয়ার এখানে সেখানে সৃষ্টির কত সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন সৃষ্টিই না রয়েছে, সেগুলো দেখার প্রবল আগ্রহ অবসরে আমাদের মনে জেগে উঠে।

যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে ধারণায় ছিল না এর ব্যাপক পরিধির ব্যাপারে। আগে থেকে তো জানাই ছিল যে, ৫০টি অঙ্গরাজ্য নিয়ে এর কাঠামো। এতো বিশাল দেশটি ঘুরে দেখার শখ আমার প্রথম থেকেই মনে লেগে ছিল। দেশটির একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের ভূপৃষ্ঠের অনেক অমিল বা আলাদা। কোথাও সমতল ভূমি থাকলেও, কোথাও বা উঁচুনিচু পাহাড়ি ভূমি। আবার কোথাওবা লালচে মাটির পাহাড় যেন আকাশ ছুঁয়েছে। আবার কোথাও ভূ-আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট হয়েছে কেনিউন যা কিনা ভূমি থেকে পাহাড় বা পাহাড় থেকে ভূমির দূরত্ব যেন আকাশ ছোঁয়া ব্যবধান তৈরি করে দিয়েছে।

এই দেশটির আয়তন এতোটা বিশাল যে, দেশের একপ্রান্তে শীতে শীতল ও বরফে জমে থাকলেও অপরপ্রান্তের মানুষরা টি-শার্ট ও বিকিনি পড়ে বিচের বালিতে ও পানিতে সময় কাটায়। একপ্রান্তে সূর্যোদয় উদিত হলেও অপরপ্রান্তের মানুষ শেষ রাতের ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে। বিচিত্র এই দেশটিতে যেদিন থেকে পা রেখেছি, সেদিন থেকেই এর আদ্যপ্রান্ত ঘুরে দেখার লোভ তাই সামলাতে পারিনি। কাজের ফাঁকে যখন ছুটির দিনগুলো আসে, পরিবার পরিজন নিয়ে তখন ঘুরে আসি দেশটির নানা প্রান্তে। কখনো বা উত্তর পূর্ব উপকূল, কখনো বা মিড ওয়েস্ট, কখনো বা দক্ষিণে, কখনোবা দেশটির ঠিক পশ্চিম প্রান্ত।

আজ বলব যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের একটি স্টেটের কথা। ফ্লোরিডার কথা। দারুণ আবহাওয়া এই ফ্লোরিডার। পৃথিবীর অন্য কোথাও সূর্য আপতিত না হলেও ফ্লোরিডার উপরে সূর্যের তির্যক প্রতিফলন থাকবেই। তাই ফ্লোরিডার নিকন্যাম বলা হয়ে থাকে ‘সানসাইন স্টেট’। এখানে শীত একেবারে নেই বললেই চলে। ট্রপিক্যাল স্টেট ফ্লোরিডা। রাস্তার দুধারে পাম ট্রিগুলো সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন আপনাকে অভিবাধন জানানোর জন্য। 

ফ্লোরিডার ভূমি সমতল। মূল ভূখণ্ডে পাহাড়-পর্বতের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে না। সাগরের পানি উষ্ণ এখানে। দারুণ উপভোগ্য। মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে জিহ্বার মতো এই অঙ্গরাজ্যটি ঠিক ঢুকে পড়েছে মেইনল্যান্ড থেকে মহাসাগরের ভিতরে। এর একপাশে আটলান্টিক মহাসাগর, অন্যপাশে গালফ অব মেক্সিকোতে আচ্ছাদিত হয়ে লেপটে আছে যেন ফ্লোরিডা। শীতে যেমন শীত সেভাবে অনুভূত হয় না, আবার গ্রীষ্মেও থাকে গরম। প্রচুর গরম। ভিজিটররা ঘুরার জন্য বেছে নেয় তাই শীত বা স্প্রিং এর মাসগুলো। ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল বা মে-জুনের দিনগুলো ভিজিটরদের পদচারণায় তাই মুখরিত হয়ে উঠে ফ্লোরিডার নানা প্রান্ত।

ফ্লোরিডার যে প্রান্তটি মেইনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত আছে, তা ঠিক জর্জিয়া ও আলাবামা অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে কানেক্টেড। অপর প্রান্ত মায়ামি থেকে মনে হবে সম্পূর্ণ ডিটাস্ট বা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মায়ামির সঙ্গে অতি চিকন হয়ে সুতোর মতো একটি অংশ লেগে আছে সাগরের ভিতরের ছোট্ট একটি দ্বীপের সঙ্গে। যার নাম ‘কি-ওয়েস্ট’। কি-ওয়েস্টের আশপাশকে ঘিরে আছে বাহামা দীপপুঞ্জ ও কিউবা। মনে হয় কল্পনার তৈরি ভেলা নিয়ে সেগুলোতে দুঃসাধ্য পাড়ি জমায়। মায়ামি ও কি-ওয়েস্ট থেকে বাহামা ও মেক্সিকোর দিকে প্রতিদিন চলছে ছুটে কত না ক্রুজ শিপ। ১৯১২ সালে আটলান্টিকের বুকে টাইটানিক নামের এক বিশাল শিপ যেমন ভেসেও ডুবেছিল, সময়ের পরিক্রমায় আজকের ক্রুজ শিপগুলো হয়ে উঠেছে আরো আধুনিক ও দুর্ভেদ্য, যা ভিজিটরদের যাত্রাকে করে তোলে স্মরণীয় ও রোমাঞ্চকর।

ফ্রেন্ডলি টেম্পারেচারের কারণে এই ফ্লোরিডাতেই নির্মিত হয়েছে ‘ডিজনি ওয়ার্ল্ড’। ওরল্যান্ডো শহরে। ১৯৭১ সালে। এখানে হাজার হাজার একর জমির উপরে নির্মিত হয়েছে ডিজনির থিম পার্কগুলো। ইউনিভার্সাল স্টুডিও, ম্যাজিক কিংডম, অ্যানিম্যাল কিংডম, এপকট নামের থিম পার্কগুলোতে মানুষের উপচেপড়া ভিড় থাকে প্রতিদিন সেই মিডনাইট পর্যন্ত। থিম পার্কের থিমগুলোকে শো হিসেবে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, জীবনের দুঃখ-কষ্টের দিনগুলো মস্তিষ্ক থেকে সাময়িকভাবে বিলীন হয়ে যাবে দূরের কোনো আকাশে। সুখের ভেলায় চড়ে মন চলে যাবে এক অসীম কল্পনার জগতে। অনুভূতি ও কল্পনার মিশ্রণে এক কোমল চাদরে ঢাকা পড়বে ব্রেন সেলগুলো। মানুষের চিন্তাশক্তিকে কত নিপুণভাবে সমৃদ্ধ করা হয়েছে, মিস্টার ডিজনির আন-ইমাজিনারি ইভেন্টগুলো তার এক একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।

আর্নল্ড সোয়ারজনেগারের টারমিনেটর-২ আপনারা নিশ্চয় দেখেছেন। এই মুভিটি একসময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুনাফা আয়ের খাতায় শীর্ষে ছিল। ফিল্মের স্ক্রিনে এর অভিনব দৃশ্যগুলো কি মনে পড়ে? কি করে অবিশ্বাস্য সেই দৃশ্যগুলো চিত্রায়িত করা সম্ভবপর হয়েছিল? দর্শকদের বোঝার জন্য কিছু দৃশ্য আরো কাছে থেকে অনুকরণীয় করে তোলা হয়েছে ইউনিভার্সাল স্টুডিওর এক থিয়েটারে- যা সত্যিই থ্রিলিং ও অ্যাডভেঞ্চার। আবার যারা যুক্তরাষ্ট্রের ‘এনবিসি চ্যানেলে’ ফিয়ার ফ্যাক্টর নামের ভয়ানক ফিয়ার অনুষ্ঠানটি দেখে থাকেন, সেসব ঘটনার অনুরূপ কিছু লাইভ দৃশ্য শো হিসেবে দেখানো হয় ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে। তেমনি এমআইবি যেমন আছে, আছে সুউচ্চ রোলার কোস্টারের মাঝে ২-মিনিটের এক হার্ট পাউন্ডিং জীবন ফিরে পাবার অনুভূতি অথবা নৌকায় চড়ে আর্টিফিশিয়াল সার্কের আক্রমণ থেকে বাঁচার এক আকুতি কিম্বা চলন্ত ট্রেনের মাঝে সত্যিকারের আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য এক সোরগোল চিৎকার, অথবা আর্টিফিশিয়াল সাইক্লোনকে সত্যিকারের সাইক্লোনের রূপে রূপান্তর করা হয়েছে যা কল্পনার জগৎকেই কেবল ভারি করে তুলেছে। মিস্টার ডিজনির থিম ইভেন্টগুলো চিন্তার খোরাক যোগায়।

ডিজনির থিম পার্কের ইলেকট্রিক প্যারেডগুলো এক অনন্য সাধারণ সংযোজন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মিউজিকের তালে তালে শত শত নর্তক-নর্তকী নানা ভঙ্গিমায় নেচে গেয়ে মাত করে রাখে পার্কের রাস্তাগুলো। তাদের সঙ্গে ইলেকট্রিক ভেহিকলগুলোর মুভমেন্ট চোখ ধাঁধানো যা কল্পনারও অতীত। হাজার হাজার মানুষ মুহূর্তের মধ্যে পার্কের ভিতরের রাস্তাগুলোর দুপাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে বা বসে শো উপভোগ করে। যে যেখানেই যে অবস্থায় অবস্থান করুক না কেন, প্যারেডটি কিন্তু তার পাশ দিয়েই যাবে। একটি প্যারেডের পরিধি প্রায় মাইলের চেয়েও বড় বা লম্বা। যাকে মিস করার কোনো সুযোগ নেই। নর্তকরা নাচের ফাঁকে আমাদের সঙ্গে হাতে হাত মেলায়, মুহূর্তের মধ্যে ক্যামেরার ফ্লাশবন্দি হয় তারা।

অ্যানিম্যাল কিংডমে ঢুকলে মনে পড়তেই পারে আফ্রিকার কোনো সাফারি পার্কের কথা। বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। সিংহ, বাঘের গর্জন ও তাদের উন্মুক্ত ঘোরাফেরা যেন তাদেরই স্বর্গরাজ্যে। খোলা গাড়িতে চড়ে এই হিংস্র প্রাণীগুলোর মাঝ দিয়ে যখন চলতে থাকবেন, অদ্ভুত এক থ্রিল কাজ করবে। সেখানে খাঁচায় অথবা প্রাণীভেদে তাদের স্ব স্ব পরিবেশে নানা কিসিমের প্রাণীকে আটকেও রাখা আছে।  আছে পেঙ্গুইন, ডলফিন।

অরলান্ডো থেকে খানিকটা দূরে একটি শহরের নাম টিটুসভিলে। জন এফ কেনেডি স্পেস সেন্টার এই টিটুসভিলেতে। স্পেস সাঁটলগুলো উৎক্ষেপিত হচ্ছে এখান থেকেই। পৃথিবী থেকে মহাকাশে। গ্রহ থেকে নতুন গ্রহের সন্ধানে কিম্বা চাঁদে অথবা মঙ্গল গ্রহে। নতুন নতুন গ্যালাক্সি বা মিল্কিওয়ের খোঁজে।

বিশ্বের সেরা কয়েকটি বিচের নাম আসলে সেখানে মায়ামির নাম চলে আসে। নর্থ ও সাউথ মায়ামি বিচ। সেখানের বালি ও পানিতে শরীর না ভেজালে বিচের মজা কি থাকে? হাজার হাজার মানুষের সমাগম সেখানে। মাইলের পর মাইল সেই বিচের বালিতে অর্ধনগ্ন নারী ও পুরুষরা শরীর যেন এলিয়ে দিয়েছে সূর্যতাপ নিতে। ওয়েস্ট পাম বিচ বা ডেইটনা বিচ বা কোকোয়া বিচ কোনটির সৌন্দর্য ও বিশালতা যেন কোনটির চেয়ে কম নয়।

(চলবে)

লেখক: বোস্টনের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত

ই-মেইল: alamrowshon@gmail.com

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!

আগের পর্ব