তারা দেশের মানুষ, কাছের মানুষ। তাছাড়া নিজ ভাষায় সেখানে কথা বলা, একটু হাতের ভেজা মসুরের ডালে এক সন্ধ্যা ভোজন করা, অথবা দিন শেষে ফোনে হায়-হ্যালো বলা, সবকিছু মিলে মনে একটা প্রশান্তি দেয় বৈকি! আমি যখন প্রথম জাপানে যাই, ফুকুওকা শহরে গিয়ে আমার ভীষণ ভালো লাগে। সেখানে যেতে না যেতেই পরিচয় হয় জোফার ভাইয়ের সঙ্গে। পরে তিনি বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
ফুকুওকাতে তখন খুব বেশি স্টুডেন্ট ছিল তা নয়। বিশ পঁচিশ জনের মতো। কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ডাক্তার, কেউ কৃষিবিদ। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছিলাম কিছু গ্র্যাজুয়েট। সেসব স্টুডেন্টের সমন্বয়ে গঠিত ছিল ‘ফুকুওকা বাংলাদেশ কমিউনিটি’। তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন কিউসু ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। তাছাড়া আরো কিছু ভাই ছিলেন সেখানে, যারা শিক্ষাজীবন শেষ করে প্রফেশনাল জীবনযাপনও শুরু করেছেন। তাঁদের সবার আন্তরিকতা-আতিথিয়তা মুগ্ধ করার মতো। নতুন কেউ ফুকুওকাতে গেলে মোটামুটি দাওয়াতের একটা ধুম পড়ে যেত। একজন নতুন ছাত্রের মনকে চাঙ্গা রাখার জন্য যা ছিল দারুণ অনুভূতির, একাকীত্ব ঘুচানোর জন্য এক মহাঔষধ বলা যেতে পারে।
জাপানের ইউনিভার্সিটিতে মার্চ মাসে অনেক স্টুডেন্টের ডিগ্রি শেষ হয়ে যেত। পিএইচডি ডিগ্রির কথা বলছি। যেসব বাংলাদেশি স্টুডেন্ট ডিগ্রি পেতেন সেই সেশনে, তারা মার্চ-এপ্রিল মাসে দেশে চলে যেতেন। বাংলাদেশি কমিউনিটি তাঁদের বিদায়ী অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান। আবার জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে যেসব নতুন স্টুডেন্ট সেখানে পড়তে আসতেন, তাঁদের জন্যও ছোটখাটো একটা নবীন বরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। অনেক সময় বিদায়ী ও নবীন বরণ অনুষ্ঠানটিকে সমন্বয় করে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো।
আমাকে এ ধরণের একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বরণ করে নেওয়া হলো। আমি সত্যিই অভিভূত হয়ে গেলাম। ভাবিদের হাতের রান্নায় সে অনুষ্ঠান সুস্বাদু খাদ্যের এরোমায় মোহনীয় হয়ে উঠল। একদিকে একদল দেশি ভাইবোনের বিদায়, আরেকদিকে নতুনদের আগমন। আবেগঘন এক পরিবেশ। দারুণ। বিদেশে এমন আয়োজন থাকলে কার না ভালো লাগে। সেসময় জোফার ভাই ছিলেন এসবের পিছনে মূল আয়োজক। দারুণ একজন সংগঠক তিনি।
উপরে জোফার ভাইয়ের নাম উল্লেখ করেছি। তার কথা একটু আলাদা করে না বললেই নয়। জোফার ভাইকে আমি দেশে থাকতে কখনো চিনতাম না বা জানতাম না। অথচ ফুকুওকাতে প্রথম দেখাতেই তিনি আপন হয়ে গেলেন। অমায়িক ও দারুণ এক বন্ধুসুলভ মানুষ জোফার ভাই। পরোপকারী মানুষ জোফার ভাই। নিজের চেয়ে অন্যকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে ভালবাসতেন তিনি। যতদিন একসঙ্গে ছিলাম আমরা ফুকুওকাতে, কখনোই দূরের কোনো মানুষ মনে হয়নি জোফার ভাইকে। আপন মানুষ। এমন ক্যারেক্টারের একজন মানুষ ছিলেন তিনি, যাকে ভালো না লেগে পারে না। তার মতো সৎ মানুষ পাশে থাকলে, নিজের প্রতি আস্থা আরো বেড়ে যায়। উনি ময়মনসিং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। তখন পিএইচডি করতেন কিউসু ভার্সিটির কৃষি ফ্যাকাল্টিতে। বয়সে তিনি আমার সিনিয়র ছিলেন। অথচ বন্ধুর মতো বড় ভাই। যার কাছে সব বলা যায়।
রিউগাক্সে কাইকান বা ইন্টারন্যাশনাল হল (ডরমিটরি) থেকে কিউসু ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াতের পথেই ছিল জোফার ভাইয়ের বাসা। তখন আমি ফুকুওকাতে একাই ছিলাম। আমার স্ত্রী দেশ থেকে ফুকুওকাতে তখনো আসেনি। তার আসতে আরো প্রায় দুই তিনমাস সময় লেগে যাবে। তার আসার জন্য ফুকুওকার ইমিগ্রেশনে তখন প্রোসেসিং চলছিল। বলতে দ্বিধা নেই যে, রান্না-বান্নায় ছিলাম একেবারেই আনকোরা। দেশে থাকতে কখনোই চুলোর ধারে কাছে আমি ভিড়িনি। রান্নায় কতটুকু লবণ বা ঝাল বা মশলা দিতে হয় এবং কখন সেগুলো যোগ করতে হয়, তা জানার ক্ষমতা আমার তখন ছিল না। ইউটিউবের মাধ্যমে বাংলাদেশি রান্নার রেসিপি দেখে দেখে রান্না করবো, ২২-২৩ বছর আগে আমাদের সে সুযোগও ছিল না।
যেহেতু জোফার ভাইয়ের বাসা কিউসু ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াতের পথেই ছিল, তাই তার বাসায় হুট করে যেতে আমার কোনো বারণ ছিল না। তিনি অনেক সময় হুটহাট করে ফোনও দিতেন। খোঁজও নিতেন। রওশন চলে আসো। তোমার ভাবির রান্নাটা আজ দারুণ হয়েছে। যে কথা সেই কাজ। বাইসাইকেলের গতি তখন বেড়ে যেত তার বাসা অভিমুখে। সিরাজগঞ্জের মানুষের হাতের রান্না দারুণ, প্রশংসার দাবি রাখে।
ভাবির বাড়ি সিরাজগঞ্জ। আমার শ্বশুরবাড়ির দেশ। যত্নটা তাই একটু বেশি পেতাম। মাছ-মাংসের দু এক পিস আমার প্লেটে বাড়তি হিসেবে অটোম্যাটিক চলে আসতো। ভাবিও ছিলেন দারুণ মানুষ। বাংলাদেশে তিনি একজন বিসিএস ক্যাডার জব করতেন। জোফার ভাইকে সঙ্গ দিতে তাই উড়ে এসেছিলেন ফুকুওকাতে। জোফার ভাই ও ভাবির আন্তরিক আতিথিয়তা কখনোই ভুলবার নয়।
যাই হোক, যেহেতু ছোট কমিউনিটি ছিল ফুকুওকা, আন্তরিকতার কোনো ছেদ ছিল না আমাদের মাঝে। এমনও দেখেছি যে, বাংলাদেশ থেকে যখন কোনো বিশেষ ব্যক্তি এসেছেন, তাকে অভ্যর্থনা বা সম্মান জানানোর জন্য আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোনো ঝগড়া বিবাদ ছিলো না। বিদেশে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে সাধারণত বাংলাদেশের পলিটিক্সের একটা প্রভাব থাকে, কিন্তু সেরকম কোনো ভাইরাস তখন ফুকুওকাতে ছিলনা। মনে পড়ে যে, শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেসময় গিয়েছিলেন ফুকুওকাতে। তিনি শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের সুনামের মাধ্যমে পরিচিত একটি মুখ। হাজার হাজার গরিব ও অসহায় মানুষ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সহজে লোন নিয়ে ভাগ্যের পরিবর্তন করতেন। ড. ইউনুস তখন নোবেল পুরস্কার পাননি। অথচ তার পরিচিতি ছিল বিদেশে ব্যাপক।
এমন একজন মানুষকে ফুকুওকাতে কাছে পেয়ে আমরা বাংলাদেশ কমিউনিটি অভিভূত হয়ে গেলাম। সকল ভাবিরা তাঁদের হাতের সেরা খাবারটি রান্না করে নিয়ে আসলেন। সুঘ্রাণে ঘরময় হয়ে গেলো। আমরা ছেলেরা তাকে অভ্যর্থনার যাবতীয় আয়োজন সেরে ফেললাম। গ্রামীণ ব্যাংককে ঘিরে তাকে নানা প্রশ্ন করা হলো। কিভাবে ভাগ্যের পরিবর্তন করতে সক্ষম হচ্ছেন দরিদ্র নারীরা? তার ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের রহস্য আসলে কী? অর্থদাতা সংস্থাগুলো কার? ইন্টারেস্ট বেশি হওয়া সত্ত্বেও তা পরিশোধ কতটা সহজ বা জটিল? কী কী খাতে গ্রামীণ ব্যাংক লোন দিচ্ছে? গ্রামের দরিদ্র নারীর স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের ব্যাপারে ভবিষ্যৎ প্ল্যান কী? ইত্যাদি নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে আগ্রহী হয়েছিলাম আমরা। ছোট্ট একটা রুমে গাদাগাদি করে বাচ্চাকাচ্চাসহ কি যে এক আবেগঘন অনুষ্ঠান। নিরহংকার একজন মানুষ ড. ইউনুস। আমার দু’বছরের মেয়ে রিনভীকে কোলে নিয়ে আদর করলেন। দারুণ এক অনুভূতি। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ পড়তে থাকলো অবিরামভাবে।
আরেকবার আমাদের মাঝে অভিনেতা রইসুল ইসলাম আসাদ এসে হাজির হলেন। তিনি এসেছিলেন ফুকুওকাতে। তাকে পেয়ে আমরা যার পর নাই খুশি। তিনি এমনিতেই ছিলেন আমার একজন প্রিয় অভিনেতা। এমন অভিনেতার সঙ্গে কথা বলতে কার না ভালো লাগে। তাকে ঘিরে কথার যেন শেষ নেই। দারুণ সময় কেটেছিল সেদিন আমাদের।
বিদেশের মাটিতে সাধারণত ঈদ হয় বেশ পানসে। কারণ, দেশে থাকতে ঈদে আমাদের কতো আনন্দে সময় কাটতো। বিশেষ করে কলেজে পড়ার সময় আমরা বন্ধুরা ঈদের নামাজ পড়ে বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঈদের খাবার খেতাম। সারাদিন হৈ-হুলোড় করে সময় কেটে যেত। যখন ফুকুওকার এই ছোট্ট কমিউনিটিতে আসলাম, অবাক হলাম যে আমাদের বাংলাদেশের ঈদের কালচারটি যেন এখানে অক্ষরে অক্ষরে অক্ষুন্ন আছে। নামাজ শেষে দল বেঁধে আমরা এক একটা বাড়িতে হানা দিতাম। আমরা বাংলাদেশিদের মূলত খুব অল্প দূরত্বের মাঝেই ছিল বসবাস। হেঁটে বা বাইকেলে চলতাম আমরা সবাই। খাওয়া, আড্ডা......আহ।
তারপর দিনশেষে সন্ধ্যায় থাকতো আবার ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। রিউগাক্সে কাইকানের অডিটোরিয়ামটি থাকতো আগে থেকেই বুক করা। সেখানে জমায়েত হতাম আমরা সবাই। সবাই যেন এক পরিবার। বাংলাদেশি পরিবার। গানে গানে ভরে যেত সন্ধ্যা। যার গলায় যা আসে। দারুণ সময় ছিল সে দিনগুলো। কথায় আছে না, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। আসলে ছোটখাটো নানা উৎসবেই মেতে থাকতাম আমরা তখন ফুকুওকাতে। কখনো বা সেগুলো দেশকে রিপ্রেজেন্ট করার মতো করে।
যেমন, ফুড ফেস্টিভালের কথায় ধরা যাক। আমরা কিউসু ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের মধ্য থেকে কয়েকজন স্টুডেন্ট ও তাঁদের পরিবার ‘ইন্টারন্যাশনাল ফুড ফেস্টিভালে’ জয়েন করলাম। আমার স্ত্রী সাথীও ইতিমধ্যে ফুকুওকাতে এসেছে। সেও এই ফুড ফেস্টিভালে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের একজন। ফুকুওকার দাজাইফু নামক এক স্থানে এই ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভালের আয়োজন হলো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্টুডেন্টরা সে ফেস্টিভালে অংশগ্রহণ করল, তাঁদের দেশের ফুডকে তুলে ধরল। নানা দেশের হরেক রকম ফুড।
আমরা বাংলাদেশ গ্রুপ থেকে তখন নাসরিন আপা (বর্তমানে বাংলাদেশের একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক), শাহাদাত হোসেন রেজা ভাই (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক), আসাদ রনি (বর্তমানে টোকিওর একটি ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত), মেজবাহ উদ্দিন (বর্তমানে জাপানে কর্মরত), আমি এবং আমার স্ত্রী সাথী- সেই ফুড ফেস্টিভালে জয়েন করলাম। আমার দায়িত্বটা ছিল অতি সহজ। বাজার-সদা করে দেওয়াটাই মূলত আমার কাজ। কারণ, আমি যদি রান্নায় অংশগ্রহণ করি, বাঙালি সুস্বাদু খাদ্যের মান অটুট কি থাকবে? নাকি ধূলিসাৎ হবে? আমি ছাড়া সবাই ছিলেন রান্নার ব্যাপারে পটু। তাঁদের হাতের রান্নার সুস্বাদ দেশকে উপস্থাপন করার মতোই।
তারা সবাই মিলে অনুষ্ঠানের আগের দিন কিছু প্রস্তুতি আগেভাগে নিয়ে রাখলেন। মূলত দেশের পিঠা জাতীয় কিছু খাবার প্রস্তুতিতে। যেমন পাটিসাপটা, অন্যান্য নানা বাংলাদেশি খাবার, ডাল ভাত থেকে শুরু করে বিরানি, রেজালা কোনো কিছুই আর বাদ রইল না। হরেক আইটেমে ভরে উঠল খাবারের স্টল। দেশি বিদেশি খাবারে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। মানুষ খাবেন এবং খাবারের মান সম্পর্কে মতামত দিবেন। শত শত দেশের খাবারের মাঝ থেকে বিচারকমণ্ডলী তিনটি দেশের খাদ্যকে সেরা নির্বাচিত করবেন।
আমাদের রাঁধুনিরা সে মান ধরে রাখতে সক্ষমও হলেন। দেশের মান তারা উজ্জ্বলও করেছিলেন। বাংলাদেশ টিমকে সার্টিফিকেট দেওয়া হলো। টিমের একজন সদস্য হিসেবে আমাকেও সার্টিফিকেট দেওয়া হলো। আহ, সে দিনগুলো ভুলি কি করে? আরো যারা ছিলেন তখন ফুকুওকাতে যেমন, ডা. শরীফ ভাই, রহমান ভাই, আমজাদ, আনিস, মতিন ও মঞ্জু ভাই, ডা. সজীব ও সাইদ ভাই, খবির, আসাদ ও আশরাফ ভাইদের কথা কি ভুলে থাকা যায়? ভাই ও ভাবিদেরকে নিয়ে না হয় বিস্তারিত থাকবে কোনো এক পর্বে।
(চলবে)
আগের পর্ব
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |