বিশাল তার আকার ও আয়তন। ডজন ডজন অ্যারোপ্লেন বা উড়োজাহাজ সজ্জিত করে রাখা আছে সেখানে। উড়োজাহাজ সৃষ্টিলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো আবিষ্কার করা হয়েছে, তাদের একটি করে নমুনা সেখানে নোঙ্গর করানো আছে। প্লেনগুলো দেখতে হাজার হাজার দর্শনার্থী সেখানে প্রতিদিন ভিড় করেন। কোন প্লেন কত উচ্চতায় ও দূরত্বে ফ্লাই করতে পারে, তার একটি হালকা বিবরণও দেওয়া আছে প্রতিটি প্লেনের নোঙ্গরের সাথে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে ডিজাইনের যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হয়েছে তাও আছে সেখানে। আজকের বোয়িং, অ্যায়ারবাস, তাও আছে। সিকিউরিটি চেক করে মিউজিয়ামের ভিতর প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়বে একটি কাঠের তৈরি উড়োজাহাজ। পৃথিবীর বুকে আবিষ্কৃত প্রথম উড়োজাহাজ এটি। রাইট ব্রাদার্স তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেই উড়োজাহাজে বসে আছেন। কাঠের তৈরি সে উড়োজাহাজে রাইট ব্রাদার্সের প্রতিকৃতি এমনভাবে বসানো আছে যেন মনে হবে যে, দুভাই প্লেন নিয়ে এক্ষুণি আবার উড়াল দিবেন আকাশের পথে। ঘুরে আসবেন ওহাইওর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে।
দুই ভাই-উইলবার রাইট ও অরভিল রাইট। রাইট ব্রাদার্সকেই বলা হয়ে থাকে উড়োজাহাজের প্রথম ইনভেন্টর। ১৯০৩ সালে তারা দুভাই মিলে পৃথিবীর বুকে এ অসাধ্য কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন। মানুষের মনে দীর্ঘদিনের যে কল্পিত স্বপ্ন লালিত ছিল- পাখির মতো ডানা মেলে ধরে পৃথিবীর এক গোলার্ধ থেকে আরেক গোলার্ধে উড়াল দেবার বাসনা ছিল, রাইট ব্রাদার্স সে স্বপ্ন ও কল্পনাকেই যেন বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। মাত্র একশ বছরের ব্যবধানে কতনা আধুনিক অ্যারোপ্লেন আবিষ্কৃত হয়েছে আজ! আজকের বোয়িং ৭৮৭ বা অ্যায়ারবাস- যাই বলি না কেন, সেসব অত্যাধুনিক উড়োজাহাজগুলো রাইট ব্রাদার্সের সেই কাঠের তৈরি উড়োজাহাজেরই এক একটি নতুন সংস্করণ। তাদের দুই ভাইয়ের কাছে পৃথিবীর মানুষের ঋণ কখনো শোধ হবার নয়। রাইট ব্রাদার্সকে তাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
ভাইকে বলতাম, ‘কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে এ উড়োজাহাজ?’ ভাই বলত, ‘ঢাকা থেকে সৈয়দপুর।’ আমাদের গ্রামটি না ঢাকার কাছে, না সৈয়দপুরের সন্নিকটে। বলা যেতে পারে একেবারে অজ পাড়া-গ্রাম। শহর থেকে দূরে- বহুদূরে। আমাদের গ্রামে বৈদ্যুতিক বাতি তখন ছিল না। হ্যারিকেন বা লম্প বা চেরাগের শিখায় আমরা তখন ভাইবোনরা বা গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করতাম। আমাদের গ্রামে রিকসা, কার বা বাস কোনো কিছুই সেসময় যেতো না। গ্রামের রাস্তায় ছিল কাদা।
মা-বোনদের জন্য তখন গ্রাম থেকে শহরে যাবার একমাত্র বাহন ছিল গরু বা মহিষের গাড়ি। আমার মাকে দেখেছি গরুর গাড়িতে চড়ে গোবিন্দগঞ্জ থানায় যেতে। মা মাসে একবার করে সেই গরুর গাড়িতে থানার অফিসে যেতেন। মাস শেষে চাকরির বেতন উঠাতে। গাইবান্ধা ছিল তখন মহকুমা। সেই মহকুমার মধ্যে গোবিন্দগঞ্জ থানার সর্বপশ্চিমের গ্রামটির নাম আলিগ্রাম। বৃষ্টি হলে মোটর সাইকেলে আলিগ্রামে যাওয়াও কঠিন ছিল। রাস্তার উপরও সাঁকো ছিল। এতটা দুরাবস্থা ছিল আমাদের সে সময়ের রাস্তাঘাটের। এমন গ্রামের এক দুরন্ত বালকের মনে উড়োজাহাজে চড়ার স্বপ্ন ছিল, তা কি করে হয়?
১৯৯৭ সাল, ২২ জানুয়ারি। প্রথম প্লেনে উঠার দিন। মনের মাঝে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হবার দিন। আলিগ্রামের সেই ছোট্ট বালক আজ যুবক। ২৭ বছরের মানব। সে এতদিনে গ্রাম থেকে শহরে পা রেখেছে। শহর থেকে ঢাকায়। ঢাকা থেকে এবার ফুকুওকার পথে। জাপান যাওয়া উপলক্ষে আজই হতে চলেছে আমার প্রথম প্লেন-যাত্রা। সেই অনুভূতিতে মনের মাঝে এক ধরণের শিহরণ তো অবশ্যই কাজ করছিল। যদিও একটু আগেই ঢাকা অ্যায়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে এনওসি নিয়ে একটি মস্তবড় ধকল পার করে এসেছি। সেই ধকল সামলিয়ে প্লেনে উঠা মাত্র আমার মনে হতে লাগলো যে, প্লেন যেন নোঙ্গর থেকে ডিটাস্ট হয়ে গেল। ভাবলাম, আমিই বুঝি ছিলাম ধকল সামলিয়ে প্লেনে উঠা শেষ যাত্রী।
সিটে বসে সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতেই আমার পাশের সিটে বসা ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তিনি একজন কোরিয় যুবক, বয়স ৩৫ বা ৪০ হবে হয়তো। ইংরেজি জানেন। নাম তার কিম না ফিন, কিছু একটা হবে হয়তো, তা আজ আর মনে করতে পারছি না। অযাচিত কিছু কুশল বিনিময় হলো তার সঙ্গে। সে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’ উত্তরে বললাম, ‘জাপানের ফুকুওকা শহরে। পড়াশুনা করতে।’ তার অভিব্যাক্তি দেখে মনে হলো না ফুকুওকা তার পছন্দের কোনো জায়গা।
প্লেন এবার রানওয়ের উপর দিয়ে যেতে শুরু করেছে। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। দোয়া-দরুদ সবই পড়ছি। খুব কম সময়ের মধ্যে বেশি বেশি করে দোয়া-দরুদ পড়ে ফেলছি। ঘন ঘন পড়ছি। এবার প্লেন উড়তেও শুরু করেছে। জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। ভালভাবে দেখতেও পারছি না। উঁকিঝুঁকি মারছি। প্লেন মুহূর্তের মধ্যে ভূমি থেকে আকাশে উঠে গেল। শুভ্র মেঘগুলো ভেদ করে ব্যাংককের পথে উড্ডীয়মান।
দেশ ছেড়ে যাচ্ছি। ভাবতেই বুকে একটা ধাক্কা লাগলো। কষ্টে বুক যেন ভেঙ্গে যেতে লাগলো। মনটাকে পাথরের মতো শক্ত একটি কঠিন বস্তু মনে হতে লাগলো। আমি আমার প্রিয় দেশটিতে আর নেই। বাংলাদেশের মাটি থেকে অনেক উঁচুতে, শূন্যে। যে ঢাকাতে গত আট নয় বছর টানা সময় কাটিয়েছি, সেই ঢাকা থেকে প্লেন এখন আকাশে। এ মুহূর্তে আকাশই আমার পথ। শূন্য থেকে প্লেনের জানালার দিকে তাকানোর চেষ্টা করছি। শুধু শূন্যই মনে হচ্ছে সবকিছু। মনের মধ্যে কিছু কিছু কঠিন শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে। বিদায় ঢাকা। বিদায় বাংলাদেশ, বিদায় আমার ভালোবাসা। ঢাকার আকাশের মেঘ-বৃষ্টি-রোদ-রংধনু এসব যেন অতীতের পাতায় ঠাঁই নিল।
ব্যাংকক অ্যায়ারপোর্টে বসে থাকতে থাকতে ক্ষুধায় এবার পেট জ্বলতে শুরু করেছে। সঙ্গে যে তিনশো ডলার আছে, তাতে আর হাত দিলাম না। কিছুই কিনলাম না। আলাউদ্দিন সুইটমিটের শুকনা কিছু মিষ্টি আছে সঙ্গে থাকা হ্যান্ডব্যাগের ভিতরে। জাপানিদের বাংলাদেশি মিষ্টি খাওয়াবো বলে কিনেছিলাম। কিন্তু নিজের উদরে ক্ষুধার যন্ত্রণা যেভাবে তেতে উঠেছে, তাতে জাপানিদের মিষ্টি খাওয়ানোর কথা আপাতত আর ভাবতে পারছি না। আমাদের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ক্ষুধা নিয়ে কবিতা লিখেছেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ বড়ই খাঁটি কথা বলেছেন তিনি। মিষ্টির প্যাকেট ফুটো করেছি। একটা একটা করে মিষ্টি বের করছি, আর তা উদরের ভিতর মুহূর্তের মধ্যে চালান করে দিচ্ছি। শর্করা খেলে মনে ফূর্তি লাগে। শরীরটাও বেশ চাঙ্গা চাঙ্গা লাগছে এবার, নেক্সট প্লেনে উঠার প্রস্তুতি চলছে।
আলো ঝলমলে ব্যাংকককে ‘রাতের শহর’ বলা হয়ে থাকে। একসময় মাদক ব্যবসার ক্ষেত্রে ‘গোল্ডেন ট্রাই-অ্যাঙ্গেল’ নামের যে তিনটি দেশের নাম শোনা যেত, তাদের মধ্যে থাইল্যান্ড অন্যতম। অপর দুটির নাম মিয়ানমার ও লাওস। ব্যাংকক থাইল্যান্ডের রাজধানী। অনেকেই চিকিৎসা নিতে সেখানে যান। আমার বাবা অন্তত দুবার এসেছিলেন ব্যাংককের রুটনিন হসপিটালে তার চোখের গ্লকুমার চিকিৎসা নিতে।
ব্যাংককে ট্রানজিটের সময় ফুরিয়ে এসেছে এবার। ব্যাংকক থেকে কান্সাই অ্যায়ারপোর্টের প্লেনে উঠার লাইনে দাঁড়িয়েছি। সেই যাত্রাপথ শেষ হলে আরো একটি লাইনে দাঁড়াতে হবে। কান্সাই টু ফুকুওকা ইন্টারন্যাশনাল অ্যায়ারপোর্ট, ডেসটিনেশন। ফুকুওকাতেই ফাইনাল ডেসটিনেশন। সূর্যোদয়ের দেশে আগমন।
(চলবে)
আগের পর্ব
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, বোস্টনের ম্যাসাচুসেটসে একটি ওষুধ কারখানায় কর্মরত
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |