দেশে বিদেশে: টোকিও ডিজনিল্যান্ডের কাহিনী, পর্ব-৮

ডিজনিল্যান্ডের নাম আমরা অনেকেই শুনে থাকবো। যখন দেশে ছিলাম তখন বিটিভির একটি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ছিল, যা না দেখে থাকতে পারতাম না। ম্যাগাজিনটির নাম ‘ইত্যাদি’।

মো. রওশন আলম, যুক্তরাষ্ট্র থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Jan 2019, 09:24 AM
Updated : 11 Jan 2019, 09:24 AM

প্রিয় উপস্থাপক হানিফ সংকেত ইত্যাদির মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান দেখাতেন। ভীষণ ভালো লাগতো সেসব দেখে। মনে হতো আহ! একবার যদি ওসব জায়গায় যেতে পারতাম, ঘুরে দেখতে পারতাম, মনের মাঝে যে অপূর্ণ স্বাদগুলো ছিল তার খানিকটা হয়তো পূরণ হতো। ঠিক সেই ইত্যাদির মাধ্যমেই জানতে পারি ডিজনিল্যান্ডের কথা। ক্যালিফোর্নিয়ার ডিজনিল্যান্ড।

যদিও পরে জানতে পাড়ি যুক্তরাষ্ট্রের দু’প্রান্তে রয়েছে দুটি ডিজনি পার্ক। ক্যালিফোর্নিয়ার ডিজনি পার্কের নাম ‘ডিজনিল্যান্ড’। আর ফ্লোরিডার অরলান্ডোতে রয়েছে ‘ডিজনিওয়ার্ল্ড’। একটির অবস্থান প্যাসিফিক মহাসাগরের উপকূলে, অপরটি আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে। দেশে থাকতে তখন মনের মাঝে অব্যক্ত আশা ছিল, না বলা কথা ছিল, যদি কখনো একবার সুযোগ আসে, এ ডিজনিপার্কগুলো ঘুরে দেখার সে সুযোগ মিস করবো না। আহ! সে সুযোগ কবে আসবে?  

দেশ থেকে প্রথমেই পা বাড়িয়েছি- যুক্তরাষ্ট্র নয়, জাপানের দিকে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ডিজনিল্যান্ড ও ডিজনিওয়ার্ল্ড দেখার আকাঙ্খা অনেকটা অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে আপাতত। তাতে কি? জাপানেও রয়েছে ডিজনিল্যান্ড। টোকিওর সন্নিকটে। এ সুযোগ মিস করা যাবে না। লেটস গো টু ডিজনিল্যান্ড। যদিও ডিজনিল্যান্ডের পাশেই রয়েছে ‘ডিজনি সি’। কিন্তু সেদিকে আমাদের ভ্রূক্ষেপ মোটেও নেই। ডিজনিল্যান্ডেই যেতে হবে। ডিজনিল্যান্ড ও ডিজনি সি মিলে ডিজনি রিজোর্ট।

আমার ক্লাসের অনেক বন্ধু ইতিমধ্যে জাপানে গিয়েছে পড়াশোনা করতে। সৌভাগ্যবান ছিলাম আমি এই কারনে যে, সেসব বন্ধুদের কেউ কেউ তখন পিএইচডি করছে, কেউবা পোস্ট ডক্টরেট। জাপানের চারটি মেইন আইল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে আমরা তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তবুও ইমেইলের মাধ্যমে দারুণ একটা যোগাযোগ ছিল তখন আমাদের মধ্যে। সেসব বন্ধুদের মধ্যে আমরা তিন বন্ধু ও পরিবার মিলে যুতসই একটা প্ল্যান করে ফেললাম। টোকিও ডিজনিল্যান্ড ঘুরে দেখার প্ল্যান। 

সুসান ও দীপা। ওরা দম্পতি। ওরা থাকতো তখন ইয়োকোহামাতে। টোকিওর পাশের শহর হচ্ছে ইয়োকোহামা। ইয়োকোহামা ইউনিভার্সিটিতে সুসান তখন পিএইচডি শেষ করে পোস্ট ডক্টরেট করছিল। শহীদ ও এনি দম্পতি। ওরা থাকতো সিকুকু আইল্যান্ডের ছোট্ট একটি শহর কচিতে। শহীদ তখন কচি ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতো। আর আমি? আমার ও সাথীর বসবাস তখন কিউসু আইল্যান্ডের ফুকুওকা শহরে।

যেমন প্ল্যান আমাদের তেমনি তার ইমপ্লিমেন্ট। সুসান-দীপা যেহেতু ডিজনিল্যান্ডের পাশেই থাকে, প্ল্যানটি ইমপ্লিমেন্ট করা তাই সহজই হয়ে গেলো। সুসান-দীপা তখন থাকতো বেশ বড় একটা কোয়ার্টারে। সেখানে থাকার রুমগুলো যত না বড় বড় ছিল, তার চেয়েও বড় ছিল ওদের মন ও আন্তরিক আতিথিয়তা। তাই আমরা ফুকুওকা থেকে চারজন- আমি, সাথি, মেয়ে রিনভী ও ছেলে রাকীন প্লেনে উড়ে গেলাম টোকিওতে ওদের বাসায়।

আর শহীদরাও - শহীদ, এনি ও তাদের ছেলে সামিন চলে আসলো কচি থেকে। জমে গেল। জমজমাট। একসঙ্গে জমজমাট আড্ডা। একেবারে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে থাকতে যেসব আড্ডা দিয়েছি, সেসব স্মৃতিতে যেন ফিরে আসলো। ছোটো ছোটো পিচ্চিদের কোলাহলে সুসানের বাসাটা আন্দোলিত হতে থাকলো। আর আমরা সিনিয়ররা- ভুঁড়িভোজনের দিকেই বেশি নজর দিতে থাকলাম। 

টিকিট কাটা হয়ে গেল। আমার একজন জাপানি বন্ধু ছিল আমাদের সঙ্গে। নাম মরিশিতা। সে আমাদেরকে টিকিট কাটার ব্যাপারে সহায়তা করলো। আমাদের ভ্রমণসঙ্গী আরো বেড়ে গেল। ইউসুফ, ফখরুদ্দীন ও নজরুল। তিনজনই তখন টোকিওতে পিএইচডি করতো। ইউসুফ ও ফখরুদ্দীন ছিল আমার ক্লাসম্যাট, জানের দোস্ত। আর নজরুল আমাদের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ছোট ভাই। এতো লাজুক ও ভদ্র ছেলে এ জগতে সহজে মেলে না। ওরা ডিজনিল্যান্ডে যাওয়ার সঙ্গী হওয়ায় দারুণ জমে গেল। বন্ধু ড. ইউসুফ বর্তমানে খুলনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের একজন প্রফেসর। ড. ফখরুদ্দীন একজন বিসিএস ক্যাডার, একটি সরকারী কলেজের প্রফেসর।

পরদিন সকালে ট্রেনযোগে আমরা সকলে চললাম ডিজনি অভিমুখে। মাঝে মধ্যেই ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। লাইনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা। দারুণ অনুভূতি কাজ করতে লাগলো। ডিজনিতে ঢুকেই কোন দিক দিয়ে ডিজনির ইভেন্টগুলো দেখা শুরু করবো আমরা সেটা সুসান ইতিমধ্যে নির্ধারণ করে রেখেছে। ডিজনিল্যান্ড এতো বড় এবং তার ভিতরে এতো ইভেন্ট রয়েছে যে সেগুলো একদিনে দেখে শেষ করাটা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার।

সুসান বেশ চালু। সে বিভিন্ন ইভেন্টের ফার্স্ট পাস পটাপট সংগ্রহ করে ফেলছে। যেখানে ফার্স্ট পাস পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে আমরা দলবল নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি। আমরা সুশৃঙ্খলভাবে কীভাবে ডিজনি ঘুরে দেখব, তার দায়দায়িত্ব সুসান তার কাঁধে আগেভাগেই নিয়ে নিয়েছে। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে চলাফেরা লাইনে দাঁড়ানো কোনো চিন্তাভাবনাই করতে হচ্ছে না, সব সুসানের ঘাড়ের উপরে ছেড়ে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে আছি।  

ডিজনিল্যান্ডের ডিজাইনটা এতটা থ্রিলিং করে নির্মাণ করা হয়েছে যে আপনি যতক্ষণ ওর ভিতরে অবস্থান করবেন ততক্ষন জাগতিক সব চিন্তা ভাবনা আপনার মাথা থেকে উধাও হয়ে যাবে। স্বপ্নের এক জগতের নাম ডিজনিল্যান্ড। যাকে কাগজ ও কলমের মাধ্যমে তুলে আনা সম্ভব নয়। রূপকথার এ স্বপ্নিল জগতে ডুবে থাকতে তাই কার না মন চায়?

ডিজনিল্যান্ডের গেটেই রয়েছে ব্রুসিউর অর্থাৎ পার্কের ম্যাপ ও তার ভিতর কোনদিকে কী আছে তার সূচিপত্র। সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, ডিজনিল্যান্ডটির ভিতরে কয়েকভাগে বিভক্ত। যেমন টুমরো ল্যান্ড, ওয়ান্ডার ল্যান্ড, অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড, ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ড ইত্যাদি। আরো আছে মিকি মাউস, সিন্ডারেলা ক্যাসল, টাইম টু টাইম মন মাতানো প্যারেড, আরো কতো কি! মিকি মাউসের প্রতি চিলড্রেনের থাকে বিশেষ আকর্ষণ। মিকির কাছে যাওয়া, একটু ছুঁয়ে দেখা, লাইটিং এর মাধ্যমে ওর সৌন্দর্য উপভোগ করা- যা এক অভূতপূর্ব ব্যাপার।

ছোট বাচ্চাদের নিয়ে অনেক রাইডে উঠেছি সেখানে, বাচ্চাদেরকে সেসব রাইড থেকে টেনে আনা দায়। ওরা যেন বারবার যেতে চায়। কিন্তু সে সময় যে নেই। কারণ নেক্সট রাইডটি যে ইন্সটল করে রাখা হয়েছে আরো আকর্ষণীয় ও স্বপ্নময় করে। একটি রাইডে দুবার যাওয়া মানে সময়ের অপচয় মাত্র। একটি রাইড অন্য রাইডের চেয়ে কম থ্রিলিং নয়। অনেক রাইডে রয়েছে বিশাল লাইন। কমসে কম দু’ঘণ্টা। প্যাঁচে প্যাঁচে লাইন দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। না পিছে আসার সুযোগ, না সামনে যাবার। কী আছে সেসব ইভেন্টে? মিস্টার ডিজনি কাল্পনিক ও স্বপ্নিল জগতের যে থ্রিলিংগুলো বিন্যস্ত করেছেন এসব রাইডে তা যে দেখতেই হবে। তাই দু’ঘণ্টার লাইন এমন আর কি!

বিশাল উঁচু থেকে আপনার দেহটাকে কোস্টারের সঙ্গে বেঁধে ফেলে দেওয়া হচ্ছে সরাসরি পানির ভিতর যাকে নাম দিয়েছে তারা ‘স্প্লাশ মাউনটেইন’। জীবনটা শরীর থেকে বের হয়ে যায় যায় অবস্থা, তবুও বের হয়ে যাবে না। দারুণ এক অনুভূতি, তাই না? এখানেই কৃতিত্বটা হচ্ছে মিস্টার ডিজনির। আবার নৌকায় চড়ে আর্টিফিশিয়াল নদীর মধ্য দিয়ে আপনি যাচ্ছেন কোনো দূরের জগতে। ইনডোর ঘরের মাঝে এমন এক স্বপ্নময় জগতের রচনা করে রাখা হয়েছে যেখানে নৌকা চলছে মাঝিমাল্লা ছাড়াই তার আপন গতিতে। ক্যানেলের দু’পাশের স্বপ্নপুরির দেশের স্বপ্নময় প্রাণিরা আপনার চোখকে ধাধিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মুহূর্মুহু নানা অঙ্গিভঙ্গি করে, অথচ আপনার চোখ একটি নির্দিষ্ট কিছুর উপরে আপনি মোটেই ধরে রাখতে পারছেন না। লাইটিং এর জগত অথবা যাদুর এক জগত মনে হবে। কোনটি ছেড়ে কোনটির দিকে তাকাবেন আপনি?

ডিজনি প্যারেডের কথা যদি না উল্লেখ করি তাহলে ডিজনির কিছুই দেখিনি মনে হবে। প্যারেড দেখার জন্য মানুষ দুই-এক ঘণ্টা আগে থেকেই একটি সুন্দর জায়গা দখল করে বসে পড়েন। ইলেকট্রিক প্যারেড। যেখানে মিকি, সিনড্রেলা, প্রিন্স ও প্রিন্সেস সেজে রঙে-ঢঙে ডিজনির প্যারেড স্কোয়াড নেচে-গেয়ে আপনাকে মাতিয়ে তুলবে। সারা ডিজনির রাস্তাগুলো মিউজিকের তালে তালে তারা হেঁটে হেঁটে নেচে-গেয়ে চলবে। এ প্যারেড না দেখলে কলমের ভাষায় বুঝানোর উপায় নেই যে, কতটা মনোমুগ্ধকর ছিল তা। আমি পৃথিবীর আরো নানা অ্যামিউজম্যানট পার্কে গিয়েছি, সেখানে প্যারেড দেখেছি, কিন্তু টোকিও ডিজনিল্যান্ডের সেই প্যারেডের সৌন্দর্য আমি অন্য কোথাও খুঁজে পাইনি।

টোকিও ডিজনিল্যান্ডে বছরের সারা সময়ই লোকে লোকারণ্য থাকে। স্কুলের ছেলেমেয়েরা ছুটির দিনগুলোতে উপচে পড়ে সেখানে। যেহেতু শিশুদের কথা চিন্তা করেই এ ডিজনিল্যান্ডের আবিষ্কার, সেই মিস্টার ডিজনি আসলে কে ছিলেন, তা কি জানতে মন চাইছে না আপনাদের? তার নাম ওয়াল্টার এলিয়াস ডিজনি। সংক্ষেপে ওয়াল্ট ডিজনি। তার জন্ম ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের শিকাগো শহরে। ১৯০১ সালে। পৃথিবীর মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রথম অ্যানিমেশন প্রোগ্রামার। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতেন তিনি। ইলাস্ট্রেটর উপাধি তিনি পেয়েছিলেন মাত্র ১৮ বছর বয়সেই। তার নির্মাণের এক আলোচিত চরিত্রের নাম ‘মিকি মাউস’। তার প্রথম নির্মাণ ছিল ক্যালিফোর্নিয়ার ডিজনিল্যান্ড। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ১৯৫৫ সালে।

দ্বিতীয় পার্কটি নির্মাণের কাজ শুরু করেন ১৯৬৬ সালে এবং এ বছরই মিস্টার ডিজনি পরলোকগমন করেন। তবুও পার্কটি চালু হয় ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের অরলান্ডোতে ১৯৭১ সালে। এটির নাম ‘ডিজনি ওয়ার্ল্ড’। আর টোকিও ডিজনিল্যান্ডটি চালু হয় ১৯৮৩ সালে।

(চলবে)

আগের পর্ব

লেখক: বোস্টনের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কারখানায় কর্মরত

ইমেইল: alamrowshon@gmail.com

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!