দেশে বিদেশে: টোকিওতে কিছুক্ষণ, পর্ব ৭

হঠাৎ করে নয়, মাস দেড়েক আগেই প্ল্যান। টোকিওতে যেতে হবে। উদ্দেশ্য কনফারেন্সে জয়েন করা, সায়েন্টিফিক কনফারেন্স।

মো. রওশন আলম, যুক্তরাষ্ট্র থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Jan 2019, 10:47 AM
Updated : 8 Jan 2019, 10:47 AM

বিদেশের মাটিতে সায়েন্টিফিক কনফারেন্স মানে গবেষকদের এক ধরণের মিলনমেলা। পোস্টারের মেলা। টক শোর মেলা। টক শো বললে ঠিক বাংলাদেশের রাজনীতির মতো টক শো নয়। ওরাল প্রেজেন্টেশন যাকে বলে। হাজার হাজার গবেষক বা সায়েন্টিস্ট সেসব কনফারেন্সে যোগ দেন।  লোকাল বা ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্টিস্ট। গবেষকরা সারা বছর গবেষণার কী ফলাফল পেলেন, তা তারা বিশাল সাইজের পোস্টারের মাধ্যমে প্রিন্ট করে কনফারেন্সে নিয়ে আসেন।

আর যারা প্রেজেন্টেশন দিচ্ছেন, তারাও ঠিক তাই। তারাও একজনের পর আরেকজন ওরাল প্রেজেন্টেশন দিয়ে যাচ্ছেন। মানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা তাদের গবেষণার মূল্যবান রেজাল্টগুলো বর্ণনা করে যাচ্ছেন। শত শত বা হাজার হাজার সায়েন্টিস্ট বা গবেষক সেসব পোস্টার ঘুরে ঘুরে দেখছেন, শুনছেন, শিখছেন। কনফারেন্স থেকে তারা যে জ্ঞানের ভাণ্ডার সংগ্রহ করলেন তা তারা পরবর্তীতে তাদের নিজস্ব গবেষণায় প্রয়োগ করে থাকেন।

আমাদের দেশে ছোটবেলায় গরু ছাগলের হাট দেখেছি, মেলা দেখেছি, কোরবানির হাট দেখেছি। সেখানে যেমন গৃহস্থরা হাজার হাজার গরু ছাগল নিয়ে আসতেন, যার ছাগল বা গরু যতো ভালো বা সুন্দর বা গায়ে গতরে গোস্ত ভালো থাকতো, সেসবের দাম ততো বেশি ছিল। আর এখানে? বিজ্ঞানমেলা। গবেষণার ফলাফলের মেলা। এখানে যার পোস্টারে যত ভালো গবেষণার ফলাফল, অথবা যার প্রেজেন্টেশনে যত ভালো ডাটা, তার নাম ডাক তত বেশি, তিনি তত বড় নামি-দামি সায়েন্টিস্ট বা প্রফেসর।

আমি সেবারই প্রথম টোকিওতে যাই। সময়টা ছিল ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে। সেটাই ছিল আমার প্রথম কোনো ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্টিফিক কনফারেন্সে যোগদান। ফুকুওকা থেকে টোকিওর হানেদা অ্যায়ারপোর্টে ২-৩ ঘণ্টার আকাশপথ। সেখান থেকে ট্রেন ও সাবওয়েতে করে সরাসরি টোকিও শহরের ভেতরে কনফারেন্স সেন্টার। আমার সঙ্গে রয়েছেন আমার প্রফেসর ও ম্যানটর ড. সাসাকি এবং সহকারী প্রফেসর ড. ফুমি নাগাতসুগি।

আমরা সবাই তখন কিউসু ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করি। আমাদের গবেষণার বিষয়বস্তু ডিএনএ ঘিরে। ডিএনএর টুকিটাকি বিষয় নিয়ে জানা। আমি ডিএনএ কেমিস্ট্রিতে তখন একেবারেই নতুন বা আনকোরা। তাই যা কিছু দেখি ও শুনি তার সবকিছুই আমার কাছে নতুন লাগে। জানার আগ্রহ থেকে সেই পোস্টারগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাই ছিল আমার প্রধান এবং একমাত্র কাজ। ডিএনএর মাইনর ও মেজোর গ্রুভ বাইন্ডিং ড্রাগগুলোর বৈশিষ্ট্য বা ক্যারেকটারিসটিক কী ধরণের হয় তা জানার আগ্রহ তো ছিলই।

আগে থেকেই এটা জানা ছিলো যে, টোকিও একটি ঘনবসতি শহর। পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে বেশি ঘনবসতি যে কয়টি শহর আছে তার মধ্যে টোকিও একটি। তাই টোকিও ঘুরে দেখার বাসনা তো একটু ছিলই। কনফারেন্স উপলক্ষে সে আশা একটু পূরণ তো হতে চলেছে। তাই টোকিও আসার আগেই ফোন করেছিলাম বন্ধু সুসানকে। ড. আবু বিন হাসান সুসান। বর্তমানে সুসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের একজন শিক্ষক। একজন ভালো শিক্ষকই কেবল নয় সুসান, সে একজন অত্যন্ত ভালো ও দক্ষ গবেষক বা সায়েন্টিস্ট। সুসান সেসময় ইয়োকোহামা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতো। দীপা হলো সুসানের স্ত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুসান ও দীপা আমার ক্লাসমেট ছিল। অমায়িক মেয়ে। হাতের রান্না ভালো।

টোকিওর পাশের শহর হচ্ছে ইয়োকোহামা। দৃষ্টিনন্দন একটি শহরের নাম ইয়োকোহামা। টোকিও শহর থেকে ইয়োকোহামা শহরকে পৃথক করা বড়ই দুরূহ। যেমন দুরূহ সাভার বা গাজীপুরকে ঢাকার থেকে পৃথক করা। সাগরতীরের উপর দাঁড়ানো রাতের ইয়োকোহামাকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই কত না সুন্দর ও আলোকিত করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ইয়োকোহামাকে। দূর থেকে মনে হবে বাস্তব নয়, একটি আর্ট।

মাত্র চল্লিশ মিনিটের ট্রেন জার্নি হচ্ছে টোকিও থেকে ইয়োকোহামা। আর সিঙ্কান্সেনে গেলে মাত্র পনের মিনিট। সুসান আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল ইয়োকোহামা স্টেশনে। ওকে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম। ইউনিভার্সিটিতে থাকতে হালকা পাতলা সাইজের সেই সুসান যেন একেবারে তার স্ত্রীর যত্নে ও ইয়োকোহামার আলো বাতাসে বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। দুজনে কোলাকুলি করার সময় টের পেলাম, ভুড়িটা ওর উপরের দিকে একটু জেগে উঠেছে। সুসানের ইনোসেন্ট হাসিটা ওর প্লাস পয়েন্ট। এবার সোজা গেলাম ওদের বাসায়।

ওদেরও নতুন সংসার তখন। জাপানের ছোট্ট কাঠের বাসায় তাদের নতুন সংসার। সেখানে টেবিলের উপরে দীপা সাজিয়ে রেখেছে হরেক রকমের বাঙালি মাছ ও মাংসের তরকারি। সেসব দেখামাত্রই আর থাকতে পারছি না। তর একেবারেই আর সইছে না। মাছের ঝোল দেখে জিহ্বার ঝোল ওষ্ঠ বেয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়ার মতো অবস্থা। কোনটি খাবো আর কোনটি খাবোনা, তা বাদ-বিচার করার মতো সময় আর নেই। কোনোরকমে হাত মুখ ধুয়েই পানাহার। ঐশী, জাপানে ঐশী মানে ডেলিসাস অর্থাৎ সুস্বাদু। আহ! দীপার হাতের রান্নার সেই সুস্বাদ এখনো জিহ্বায় যেন লেগে আছে।

অনেকদিন পর ওদের সঙ্গে ইয়োকোহামাতে দেখা। খাওয়া দাওয়ার পর একথা ওকথা সেকথা অনেক কথা। কথায় কথায় রাত গভীর, ঘুমের আবেশ, চোখের পাপড়ি আর মেলে ধরা যাচ্ছে না। স্লিপ।

পরদিন সকালে চললাম সি-প্যারাডাইস অভিমুখে। আমি একাই গেলাম। এটি একটি অ্যামিউজম্যান্ট পার্ক। যেখানে আনন্দের জন্য তৈরি করে রাখা হয়েছে নানান ধরণের ইভেন্ট। থ্রিলিং। অ্যাডভেঞ্চার। এ ইভেন্টগুলোতে না উঠলে বোঝা বড় দায় যে- মানুষকে আনন্দ দেবার জন্য কতটা ইন্টারেস্টিং অরে সেগুলোকে ইন্সটল করা হয়েছে। এক একটি ইভেন্টের স্থায়িত্বকাল থাকে মাত্র ২-৩ মিনিট। অথচ মনে হবে দু-তিন মাস বা বছর। ইভেন্টে উঠলেই মনে হবে কখন তা শেষ হবে। যেমন রোলার কোস্টার। লাইন ধরে ছেলে-মেয়ে এবং তাদের সঙ্গে মা-বাবারাও রোলার কোস্টারে উঠার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন। শরীরটা রোলার কোস্টারের সিটের সঙ্গে টাই করে বেঁধে রাখা হচ্ছে যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে। উঠার আগে মনে হবে এমন কিছুই নয়। বোঝার উপায় নেই যে কী দুঃসহ থ্রিলিং অপেক্ষা করছে তাদের জন্য সেখানে।

কারণ উঠার পর একটি ঘোরানি দেবার পর পরই মনে হবে- দু’মিনিট সময় এতো দীর্ঘ কেনো? কেনো তা শেষ হয় না? শুধু চিল্লানি ছাড়া গলা দিয়ে আর কিছুই বেরুবে না। আপনি না চিল্লালেও আপনার গলা দিয়ে ‘ও বাবারে’ ‘ও মারে’ শব্দগুলো বের হবেই। কখনো ‘ও দাদারে, ও নাতিরে, ও আল্লাহ্রে’ যার মুখ দিয়ে যা আসে। মজাটা সেখানেই। অ্যাডভেঞ্চার সেখানেই। ভেরি থ্রিলিং। অ্যাঞ্জয়েবল। স্বল্প সময়ের মধ্যে ইভেন্টের কজ অ্যান্ড ইফেক্টটা এতো বেশি থাকে যে, হার্টবিট যায় যায় অবস্থা।

আমার মনে পড়ে যে, আমার স্ত্রী তখন ফুকুওকাতে। আমার মেয়ে রিনভি তখনো ভূমিষ্ঠ হয়নি, উদরে। রোলার কোস্টারের একটি ঘোরানি দেবার পর আমার মনে হচ্ছিল যে, মেয়েটির মুখ বুঝি আর দেখে যেতে পারলাম না। প্রথম রোলার কোস্টারে ওঠা। যাই হোক, বয়স্ক এবং ছোট বাচ্চাদের এসব ইভেন্টে উঠা নিষেধ। যাদের হার্টের সমস্যা তাদেরও। তবে ভেরি ভেরি ইন্টারেস্টিং।

সি-প্যারাডাইসে আরো অনেক কিছু দেখার আছে। যেমন অ্যাকুরিয়ামটি অসাধারণ। সাগরের তলার বিভিন্ন প্রজাতির লাল-সবুজ-হলুদ-নীল রঙের মাছসহ কতো যে প্রাণি সেখানে বিচরণ করছে, এক কথায় অসাধারণ। ডলফিন শো তো আছেই। আরো কতো কি! আহ! এরই নামই বুঝি জাপান যা আমার আপনার কল্পনার সীমানাকেও ছাড়িয়ে যাবে। অথচ জাপানিদের কল্পনার সীমানায় তা ধরা দেবে। সেসব অনুধাবন বা উপভোগের জন্য তার একটি অনুরূপ ইন্সটল করে রাখাও হয়েছে।

পরদিন সুসান, দীপাসহ চললাম ইয়োকোহামার সাগর উপকূলে। ল্যান্ডমার্ক টাওয়ারটির চূড়াতেই আগে উঠলাম আমরা সকলে। এই টাওয়ারটির সত্তর তলায় চল্লিশ সেকেন্ডে উঠা যায়। লিফটে উঠার আগে ভিজিটরদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে- এটিই পৃথিবীর মধ্যে ফাস্টেস্ট বা দ্রুততম লিফট। কানে প্রেসার অনুভূত হবে যা আপনি লিফটে উঠার ১৫ সেকেন্ডের মধেই টের পেতে থাকবেন। ৭০ তলায় উঠে বাইনোকুলারের মাধ্যমে বা খালি চোখে সাড়া ইয়োকোহামার অসাধারণ সৌন্দর্যকে দেখার এক অভিনব ব্যবস্থা। আহ! কি মনোরম।

সাগর উপকূলে দর্শনার্থীদের জন্য নানা উপভোগ্য ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। আমি মাইনাস ষাট ডিগ্রির একটি আইস কোটেড ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। সেখানে এতো নিম্ন তাপমাত্রায় মিউজিয়ামের মতো করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সাগরের ভেতরের কিছু প্রাণির নিদর্শন, দেখে অভিভূত হবার মতো অবস্থা। কিন্তু আপনি কতক্ষণই বা টিকবেন সেই ঘরে? মাইনাস ষাট ডিগ্রিতে শরীরের ভেতরে একটু পরই যে শুরু হবে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।

এরপর চললাম আমরা বে-ব্রিজটি দেখতে। ইয়োকোহামার এক প্রান্ত থেকে ব্রিজটি কানেক্ট হয়েছে টোকিওর ওদিকটায়। সাগর ভেদ করে কয়েক মাইল দীর্ঘ এ ব্রিজটিকে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন করে। আমরা রাতের জমকালো লাল নীল হলুদ বাতির ঝলকানো আলোয় ব্রিজটির পরিপূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগের জন্য একটি ট্যাক্সি ভাড়া নিলাম। ব্রিজটির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে দেখলাম। জাপানিদের নির্মাণশৈলী কতটা না সুন্দর তা দেখার অভিজ্ঞতা হলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানিরা যুক্তরাষ্ট্রের টেকনোলোজি ব্যবহার করলেও যুক্তরাষ্ট্রকে যেন ছাড়িয়ে গেছে তারা।

এমন আনন্দঘন জার্নির পর কনফারেন্সের কথা কি আর মনে পড়ে? গোল্লায় যাক সায়েন্স আর ডিএনএ। আমি এবার হানেদা অ্যায়ারপোর্ট হয়ে ফিরতি প্লেনে ফুকুওকার পথে। পরবর্তীতে অন্তত পাঁচ থেকে সাতবার নানা কাজে যাওয়া পড়েছিল টোকিওতে। সেসব কিস্তি নিয়ে আসবো পরবর্তী পর্বগুলোতে।

(চলবে)

আগের পর্ব

লেখক: বোস্টনের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কারখানায় কর্মরত

ইমেইল: alamrowshon@gmail.com

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!