অফিস সহকারি মেয়েটি মাথা নুইয়ে কতিপয় কাগজ এগিয়ে দিলেন। মূলত কয়েকটি সিগনেচারের জন্য। সঙ্গে একটি খাম। খামের ভিতরে কিছু ক্যাশ। ইয়েন। হাত খরচের জন্য। ইয়েন হচ্ছে জাপানী মুদ্রা। ক্যাশের পরিমাণ ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার ছিল হয়তো, তা আজ আর মনে করতে পারছি না। তখন ১০০ ইয়েন সমান ৪০ টাকা ছিল।
একজন মনোবসু স্কলার বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ হাজার টাকা স্কলারশিপ পেতেন। সেই সময় এটা বেশ ভাল অঙ্কের একটি বৃত্তিই ছিল বলে মানতে হবে। কারণ, তখন টাকার মূল্য ছিল। সঞ্চিত টাকায় স্বল্পদামে বড় কিছু করাও যেত।
যাহোক, ইতিমধ্যে সকাল আর সকাল নেই। বেলা গড়িয়ে প্রায় দুপুর হতে চলেছে। ঢাকা ত্যাগের পর ২৪ ঘণ্টারও বেশি অতিবাহিত হয়েছে। ক্ষুধার জ্বালাও বেড়েছে। উদর একটি ফুটন্ত কড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। সেখানে শক্ত চাল দিলেও তা সিদ্ধ হয়ে যেতে পারে। অথচ এই ক্ষুধার জ্বালা ড. সাসাকি বা শরীফ কাউকেই তা বলতে পারছি না।
হাকোজাকি ক্যাম্পাসের পাশেই রয়্যাল হোস্ট। কিন্তু কী বা খাবো সেখানে? খাবারের যে মেন্যু আছে সেখানে, তা এককথায় মোটেই যুৎসই নয় আমার জন্য। কারণ, ছোটবেলা থেকে একটি অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। হালাল খাবার। মানুষ অভ্যাসের দাস। সহজে অভ্যাস বদলাতে পারে না। আমিও তা পারিনি। অথচ হালাল খাবার এখানে পাবো কোথায়? তাই উদরে চরম ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও গরুর স্টেকে কামড় বসাতে দন্ত সায় দেয়নি। শেষতক সালাদ নামক কিছু লতাপাতা চিবিয়ে তা চালান করতে হল উদরের ভিতরের চোঁ চোঁ শব্দগুলো থামাতে।
অথচ শরীফের খেতে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। নিজেকে সে মানিয়ে নিয়েছে। খাবারদাবার সে সাবাড় করে ফেলছে। শরীফের দিকে আমার ফুল প্লেটটিও এগিয়ে দিলাম। সে দারুণভাবে উপভোগ করলো তা। সুখের একটা ঢেঁকুরও তুলল। বলল, এতো ভাল ও দামী খাবার, অথচ তুই খেতে পারছিস না, বিদেশে তুই টিকবি কি করে?
যদিও টিকে আছি। আজও টিকে আছি। লতাপাতায় কামড় দিয়েই টিকে রইলাম।
এবার লাঞ্চ শেষে রয়েল হোস্ট থেকে আমরা সকলে বেরিয়ে পড়লাম। শরীফ ফিরে গেল তার ক্লাসে। সরাসরি হাকোজাকি ক্যাম্পাসের দিকে। প্রফেসর সাসাকি আমাকে নিয়ে চললেন ‘রিওগাক্সে কাইকান’ অভিমুখে, যেটির অর্থ ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হল’। দুপুরের মধ্যে আরও একটি নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হলাম। ‘রিওগাক্সে কাইকান’। সেখানে পৌঁছালাম আমরা মাত্র ২০-২৫ মিনিটের মধ্যেই। প্রফেসর সাসাকি আমাকে সেখানে ড্রপ করে এক মুহূর্ত আর দেরি করলেন না। আবার ফিরে গেলেন তিনি ইউনিভার্সিটিতে। যাবার মুহূর্তে ছোট্ট একটি বাক্য বলে গেলেন- ‘সি ইউ টুমরো।’
মধ্যরাতে ঠকঠক শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। শরীফ দরজার কড়া নাড়ছে।
বললো, ‘খাবি না? চল, আমার রুমে। পাঙ্গাস মাছের ঝোল আছে।’
পাঁচতলায় শরীফের রুম। আর নিচতলায় আমার রুম। ক্ষুধার্ত পেটে অমৃত স্বাদ লাগলো সেই পাঙ্গাসের। শরীফকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই। দারুণ রান্না ওর হাতের। আরেও একটি কারণে ওকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাতেই হবে। তা হচ্ছে জিতেন্সা। জিতেন্সা মানে বাইসাইকেল। জাপানিরা বাইসাইকেলকে জিতেন্সা বলেন। দৈনিক জীবনের পরম বন্ধু হচ্ছে জিতেন্সা। মধ্যরাতের মধ্যে আরও একটি নতুন জাপানি শব্দের অর্থও জানতে পারলাম। জিতেন্সা। জিতেন্সা তখন রিওগাক্সে কাইকানে (ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হল) স্বল্পমূল্যে পাওয়া যেত। শরীফ আমার জন্য একটি জিতেন্সা আগে থেকেই ম্যানেজ করে রেখেছিল।
ভাষা শেখার জন্য যে টেকনিক, ব্যাকরণ থাকে, সত্যিকার অর্থে তা জানার জন্য একাগ্র মানসিকতা থাকলেই জাপানি ভাষা শেখা সম্ভব। তখন ফুকুওকাতে অনেক বাংলাদেশি ভাইবোনদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে মোখলেছুর রহমান, মো. শরীফ, ডা. শরীফ, ডা. সাইদ, মো. আসাদ রনি, মো. মতিন তালুকদার, শাহাদাত হোসেন রেজা, সুদীপ দা, মেজবাহউদ্দিনসহ আরও অনেককে দেখেছি যাদের জাপানি ভাষার প্রতি ছিল অসম্ভব দক্ষতা, যা কেবল অবাক করার মতোই নয়, অত্যন্ত প্রশংসার দাবি রাখে। আরও যারা অনেকে ছিলেন সেসময়, তাদেরও জাপানি ভাষা বেশ ভালো জানা ছিল, দৈনন্দিন জীবন তারা বেশ ভালভাবেই টেনে নিতে পারতেন। সেখানে আমিই বুঝি ছিলাম একমাত্র স্টুডেন্ট, যে কিনা জাপানি ভাষা না শিখে বা না জেনেই জাপানের ভূমিতে টানা ছয় বছরেরও অধিক সময় পার করে এসেছি। ও মাই গড!
আপনি হয়তো ভাবছেন যে, জাপানি ভাষা জানা না থাকলে কী করে জাপানে চলাফেরা করা সম্ভব? ভাষা না জানলেও সত্যিকার অর্থে জাপানে জীবন চালানো কঠিন বলে মনে হয়নি আমার। এর মূল কারণ হচ্ছে- জাপানিরা অতি হেল্পফুল বা সাহায্যকারী এক জাতি। চলার পথে আপনি তাদের কাছে যেকোনেও সমস্যার জন্য সাহায্য চেয়ে বসেছেন, দেখা গেছে তারা অনেক সময়ই হাতের কাজ ফেলে রেখে আপনার উপকারে এগিয়ে এসেছেন।
যাহোক, দ্বিতীয় দিন থেকেই ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াত শুরু হয়ে গেল। বাহন হচ্ছে জিতেন্সা। ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হল’ বা ‘রিওগাক্সে কাইকান’ থেকে কিউসু ইউনিভার্সিটির মায়েদাসি ক্যাম্পাসের দূরত্ব ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার। মায়েদাসি ক্যাম্পাসে ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স। সেখানেই আমার গবেষণাগার। চলাচলের মাধ্যম হিসাবে বাইসাইকেল তাই আমার নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গেল। মন্দ নয়। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার রাস্তা বাইসাইকেলে যাতায়াত করা স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্যও মন্দ নয়।
বাইসাইকেল রাইডিং সেসময় আমার ভীষণ ভাল লাগতো। সবচেয়ে বড় সমস্যা হতো তুষারপাতের সময়। যখন তুষারপাত হতো, তখন তা দেখতে অসম্ভব ভাল লাগতো। কিন্তু সেই স্নো ফল ও শো শো বাতাসের মাঝে যখন ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার রাস্তা বাইসাইকেলে করে যেতে হতো, প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার চাহিদা তখন আপনা আপনি উধাও হয়ে যেত।
উল্লেখ্য যে, জাপানে অনেক আন্তর্জাতিক মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। যেগুলোতে আধুনিক ও উন্নত গবেষণা হয়। তবুও সেখানে বিশেষ সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে কিছুটা আলাদা। এই সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটি বলা হয়ে থাকে।
কিউসু ইউনিভার্সিটি ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশেষভাবে মর্যাদা দেওয়া হয়, কারণ এগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাপানের সম্রাট। আর এগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মূলত ১৮৮৬ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে। বিশেষ মর্যাদার এই সাতটি ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটির নাম আমাদের অনেকেরই হয়তো জানা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- টোকিও ইউনিভার্সিটি, কিয়োটো ইউনিভার্সিটি, টোহোকু ইউনিভার্সিটি, কিউসু ইউনিভার্সিটি, হোক্কাইডো ইউনিভার্সিটি, ওসাকা ও নাগোয়া ইউনিভার্সিটি।
এছাড়াও সেসময় জাপান সম্রাট আরও দুটি ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মেইনল্যান্ড জাপানের বাইরে। একটি দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে ও অন্যটি তাইওয়ানে। সিউল ইউনিভার্সিটি এবং ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটি নির্মিত হয়েছিল সে সময়কার জাপান সম্রাটের মাধ্যমে। আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান জাপানের অনেকটা নিয়ন্ত্রণে ছিল।
কিউসু ইউনিভার্সিটির রয়েছে মাল্টিপল ক্যাম্পাস। প্রত্যেক ক্যাম্পাসে রয়েছে একাধিক ডিপার্টমেন্ট। সত্যিকার অর্থে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোনেও শাখা বা ডিপার্টমেন্ট নেই- যা কিউসু ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো বা গবেষণা হয় না। লিবারেল আর্টস, লিটারেচার, মেডিক্যাল, বায়োমেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, আইটি, ডেন্টাল, ফার্মাসিউটিক্যাল, কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, এগ্রিকালচার ইত্যাদি।
গবেষণার শত শত পাব্লিকেশন্স বের হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ল্যাবরেটরি থেকে। এদেশে এসে দেখলাম যে, প্রফেসরদের নাম খ্যাতি হয় এখানে তাদের গবেষণার মান কত ভাল, কত ভাল বিষয় নিয়ে গবেষণা তারা করেন, কত ভাল জার্নালে গবেষণার ফলাফল তারা প্রকাশ করে থাকেন, সে সবের উপর ভিত্তি করে।
একজন প্রফেসরের গবেষণার ফলাফল যখন নেচার বা সায়েন্স ম্যাগাজিন বা সেল এর মতো হাই ইমপ্যাক্ট জার্নালে প্রকাশিত হয়, তার নাম ডাক তখন আপনা আপনি দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পরে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমাদের বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষকদের পলিটিক্স নেই, সাদা-নীল-গোলাপি প্যানেল নেই। এদেশে শিক্ষকরা মূলত শিক্ষা ও গবেষণার কাজে তাদের মেধা নিয়োজিত রেখেছেন, পলিটিক্সে নয়।
যাইহোক, এক...দুই...তিন করে এক একটি সকাল অতিবাহিত হতে চললো স্বপ্নের দেশে। অচেনা জিনিসগুলোও ধীরে ধীরে চেনা হতে লাগলো। কিউসু ইউনিভার্সিটির ফার্মাসিউটিক্যাল ডিভিশনের দোরগোড়ায় পদচারণাও বাড়তে লাগলো। এদেশে কাজের চেয়ে কথা কম, কথার চেয়ে কাজ বেশি। তাই আমার গবেষণার বিষয়বস্তু নির্ধারিত হয়ে গেল অল্প সময়ের মধ্যেই। ডিএনএ -কে কেন্দ্র করে। ডিএনএ হচ্ছে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিয়িক এসিড।
মানবদেহের মধ্যে যখন ডিএনএ মিউটেটেড হয়, তা কী করে সনাক্ত করা যায়? শুধু তাই নয়, জেনেটিক ডিজ-অর্ডারের ফলে ক্যানসারের মতো যেসব দুরারোগ্য ব্যধি শরীরের মধ্যে বাসা বাঁধে, সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিষেধক নির্ণয়ের উপায় খুঁজে দেখা। স্বল্প ভাষায় যাকে ড্রাগ ডিসকোভারি বলা হয়ে থাকে। যদিও গবেষণার এসব বিষয়বস্তু সম্পর্কে আগে থেকে কিছুই জানা ছিল না আমার, তবুও এখন থেকে এসব না বুঝে এগুনোর পথ আর খোলা রইল না। উপায় যে নেই গোলাম হোসেন...।
তদুপরি বায়োকেমিস্ট্রির আরো বেসিক কিছু বিষয় আছে, যেগুলো মগজের নিউরণ সেলগুলোর মাঝে প্রবেশেরও চেষ্টা করতে হবে। যেমন, জেনেটিক কোড, জিন এক্সপ্রেশন, প্রোটিন সিন্থেসিস অর্থাৎ সেন্ট্রাল ডগমা অব বায়োকেমিস্ট্রি- যাকে বায়োলজিক্যাল পাথওয়েতে বলা হয়ে থাকে ট্রান্সক্রিপ্সন ও ট্রান্সলেশন। অর্থাৎ ডিএনএ যে মানবদেহের ব্লু-প্রিন্ট বা নীলনকশা, তা জানার আগ্রহ মনে সঞ্চারিত হল।
(চলবে)
আগের পর্ব
ছবি: লেখক
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, বোস্টনের ম্যাসাচুসেটসে একটি ওষুধ কারখানায় কর্মরত
ইমেইল: alamrowshon@gmail.com
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |