শুধু কি তাই? বিয়ার ও মদ্যপান তাদের কাছে দুধভাতের মতোই মনে হতে লাগলো। শুক্রবার এলেই পার্টির ধুম পড়ে যায় সেখানে। শুধু একটু উসিলা দরকার। আমি যেহেতু নতুন ছাত্র, প্রথম সপ্তাহ এখনো পারই হয়নি, তাই পার্টি অনিবার্য। সেলিব্রেট করা যাকে বলে। কাছের একটি রেস্টুরেন্টে গেলাম আমরা সবাই, ডিনার। শুধু ডিনার বললে ভুল হবে। আমার জন্য প্রথম কোনো পার্টিতে জয়েন সেখানে। ভিন্ন কালচারে এটাই প্রথম। দেশে থাকতেও এসবে আমি অভ্যস্ত ছিলাম না।
কোনো চেয়ার টেবিল নেই সেই রেস্টুরেন্টে। যদিও টেবিল চেয়ারেরও অভাব নেই সেখানে। জাপানিরা যে মাটিতে বসে পাটির (তাতামির) উপরে খাবার-দাবার করেন তা জানা ছিল না আমার। এবার সবাই বিয়ার অর্ডার দিল। বড় বড় গ্লাস। কমসে কম ওয়ান লিটার সাইজ। ধুম ধাম করে গিলে ফেলছে ছেলে-মেয়েরা। আমি তো একেবারে অবাক। এতো লিকুইড কোথায় যাচ্ছে? জাপানিরা সাইজে ছোট, কিন্তু এদের উদরের ব্লাডারটা মনে হয় অনেক বড়। তাই অনেক বিয়ার সেখানে ফিট হতে পারে বোধ হয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, বিয়ার গিলে কেউ পাগলও হচ্ছে না, আবার ফিট হয়েও পড়ে যাচ্ছে না, মাতলামিও করছে না। খুব নরমাল। যেন সবকিছু স্বাভাবিক। আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না যে, এসব বিয়ারে কতো পারসেন্ট অ্যালকোহল আছে? উত্তরে হাতের আঙুল বাঁকা করে বুঝিয়ে একজন বললেন যে, ‘সুকুসি’ মানে একটুখানি। যার অর্থ বুঝে নিতে হলো ৭-৯% হবে হয়তো। তাও তো একেবারে কম নয়।
আমার নামের শেষ অক্ষর ‘আলম’ হলেও কেউ আলম উচ্চারণ করতে পারেন না। বলেন ‘আরাম সান’। আমি বলি ‘আলম’, আর ওরা বলে ‘আরাম’। আমি যতবার বলি ‘আলম’ ওরা ততবার বলে ‘আরাম সান’। আমি প্রথমে ভাবলাম, বেটারা কি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছে নাকি? কিন্তু তা আসলে নয়। জানতে পারলাম যে, জাপানিরা ‘ল’কে ‘র’ উচ্চারণ করে আর ‘র’কে ‘ল’ উচ্চারণ করেন। মহা এক ঝামেলা। আমি যদি বলি আমার নাম ‘আরাম’, তাহলে তারা ঠিকই বলতে পারেন ‘আলম’, আর যদি বলি ‘আলম’ ওরা বলে ‘আরাম সান’। মহাবিপদ, বিপদ সংকেত একেবারে দশে দশ। নিজের নাম আলমকে এখন ‘আরাম’ বলি কীভাবে?
আমাকে ওরা বলল, কী ড্রিংকস আমি অর্ডার করতে চাই। বললাম, কোকাকোলা। এটাই আমার প্রিয় ড্রিংকস। তারপর নানা প্রশ্ন শুরু হয়ে গেল। পেয়ে বসলো আমাকে। একের পর এক প্রশ্ন, বিয়ার কেন ড্রিংক করি না? অ্যালকোহল কেন নয়? মাংশ খাই না কেন? ভাবলাম বিড়াল তো বিয়ের প্রথম রাতেই মারতে হয় যাতে বউ ভয়ে ভয়ে থাকে- স্বামী যে ক্ষমতাবান তা তো দেখাবার একমাত্র সুযোগ বিয়ের প্রথম রাতেই বিড়াল মেরে। যেহেতু এটাই প্রথম পার্টি জাপানে, তাই এক এক করে ধীরে ধীরে উত্তর দেওয়া শুরু হয়ে গেল। হালাল হারাম কী, কেন শুকরের গোস্ত খাই না, জবাই করার সময় আল্লাহর নাম কেন নিতে হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। বলতে পারেন ওই একদিনই জীবনে হুজুর সেজে গেলাম, সব উত্তর সোজা সাপটা পটাপট দেওয়া হয়ে গেল। আমাকে মদ বা বিয়ার পানের জন্য জোরাজুরি করার প্রয়োজন আর তাদের পড়ল না। নিরাপদ।
এবার কাম্পাই। কাম্পাইয়ের পালা। আমার হাতে কোকের গ্লাস। সঙ্গে আইস ও লেবু। ওদের হাতে বিয়ারের গ্লাস। একসঙ্গে সবাই বলে উঠল কাম্পাই। আমিও কিছু না বুঝেই জোরে বলে বসলাম, কাম্পাই। জানতে চাইলাম, কাম্পাই মানে কী? সোজা উত্তর চিয়ার্স। ওরা একটানে বিয়ারের গ্লাস শেষ করে ফেলল। সঙ্গে, আহ! মানে প্রশান্তির ঢেকুর। একজন স্টুডেন্ট গ্লাস উবুড় করে দেখাল, এক ফোঁটাও অবশিষ্ট নেই।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে, ছাত্র-শিক্ষকরা এ পার্টিতে যেন বন্ধুর চেয়েও বন্ধু। মন খুলে কথা বলছেন। একটু আগেই তারা কেমিস্ট্রির জটিল রিয়াকশন ল্যাবে শুরু করে দিয়ে এসেছেন, অথচ এখন সেসব ভুলে নানা গল্পে তারা মেতে উঠলেন। কাম্পাই, কাম্পাই। আমাকেও নানাভাবে প্রশ্ন করে জর্জরিত করে ফেললেন। বিয়ে করেছি কিনা। তোমোদাচি (গার্লফ্রেন্ড) আছে কিনা- এটাই যেন অন্যসব প্রশ্নকে ছাপিয়ে মুখ্য প্রশ্ন হয়ে রইল। কে আগে কাকে প্রপোজ করেছি? প্রপোজ করার সময় অনুভূতি কেমন ছিল? কবে আসবে আমার স্ত্রী? তার নাম কী? নামের অর্থ কী? আমার নামের কী অর্থ? আমার নামের সঙ্গে তার নামের অর্থের মিল আছে কিনা? বয়স কতো তার? আমার বয়স? ইত্যাদি ইত্যাদি ফানি প্রশ্ন। শরমে সত্যিই আমার চোখ যেন নিচু হয়ে আসতে লাগলো।
জাপানে পার্টি ধাপে ধাপে শুরু হয়। একেক ধাপে একেক লিকার। প্রথমে বিয়ার। আমি ভাবলাম এতো বিয়ার পান করলো ওরা, তারপর খাবারও তো কম খেল না, প্রায় দু ঘণ্টা ধরে। এরপর হয়তো সবাই চলে যাবে যার যার বাড়িতে। কিন্তু না। তা হলো না। এবার তারা শুরু করলো, আরেক ধাপ, উপরের ধাপ- ‘সাকে’ ড্রিংকস। কঠিন তরল। জাপানি মদ হচ্ছে ‘সাকে’। খুব স্ট্রং লিকার। আমার প্রফেসর (সাসাকি সাহেব) নন-স্টপ পাবলিক। তাকে থামানোর পাবলিক নেই। সে ইতোমধ্যেই ‘সাকে’ প্রুফ হয়ে গেছেন। কোনো লিকার তার শরীরে তেমন আর ধরে না। খুব স্বাভাবিক সে। আমি তো ভয়ই পেয়ে গেলাম যে, এতো ড্রিংকস করছে সে, বাড়ি যাবে তাহলে সে কী করে? জানতে পারলাম যে, তার স্ত্রী স্টেশন থেকে তাকে পিক করতে আসবেন। নো ড্রাইভ।
পার্টি শেষে সবাই যেন পুরো শক্তিতে ঘরে ফিরে গেল। আমি বাইসাইকেলে চলে আসলাম ডরমিটরিতে। কাল শনিবার। সকাল নটায় সেমিনার আছে। রিয়াকশন মেকানিজমের উপর ডিসকাশন সেমিনার। অর্থাৎ ‘জার্নাল অব অরগানিক কেমিস্ট্রি’ বা ‘আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির’ জার্নাল থেকে একটি আর্টিকেল চুজ করে একজন ছাত্র প্রতিটি রিয়াকশনের মেকানিসটিক পাথওয়ে বর্ণনা করবেন। ভাবলাম, এতো ড্রিংকস করেছে ওরা রাতে, সেমিনার হয়তো বাতিল হয়ে যাবে। কেউ ঠিক টাইম মতো হয়তো ইউনিভার্সিটিতে আসতে পারবে না।
আমার অনুমান একশতে একশভাগ অসত্য প্রমাণিত হলো। সকাল নটায় দেখলাম ছাত্র-শিক্ষক সবাই সেমিনার রুমে নোটখাতা চা কফি নিয়ে হাজির। কাল রাতে যে এতো কিছু ওরা গিলেছিল, তার কোনো ছিটেফোঁটা কারো চেহারার মধ্যে নেই। সবাই ফ্রেশ। আমি বরং উল্টো গিয়ে আমার প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ঠিক আছো তো? মানে কাল রাতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?
হো হো করে হেসে উঠল সে। রিয়াকশন মেকানিজম সেমিনারও শুরু হয়ে গেল।
(চলবে)
আগের পর্ব
ছবি: লেখক
লেখক: বোস্টনের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কারখানায় কর্মরত
ইমেইল: alamrowshon@gmail.com