দেশে বিদেশে: জাপানে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো, পর্ব-৫

বিদেশের প্রাথমিক দিনগুলোতে জাপানিজদের সততা ও সহানুভূতি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। বিদেশ থেকে পড়তে যাওয়া ছাত্রদের জাপানিরা বেশ সহযোগিতা করে থাকেন এবং আপন করে নেন। একজন নতুন বিদেশি ছাত্রকে যতটুকু প্রাথমিক সহযোগিতা করার প্রয়োজন হয়, তার চেয়েও হাজারগুনবেশি করে থাকেন তারা।

মো. রওশন আলম, যুক্তরাষ্ট্র থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Nov 2018, 06:22 AM
Updated : 24 Nov 2018, 06:22 AM

জাপান যে উন্নত একটি দেশ, তা আমাদের অজানা নয়। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় গড়া। বিশেষ করে শিক্ষার জন্য যা যা উপকরণ দরকার হয়, তার সবগুলোই আছে তাদের। তাই সেদেশের ছেলেমেয়েরা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে পড়াশুনা করতে পারেন। মডার্ন টেকনিকগুলোরসঙ্গে তাদের পরিচয় হয় ছোটবেলা থেকেই। বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা ও গবেষণা হাতে কলমে তাদের শেখানো হয়। তাই স্কুল-কলেজ থেকেই নিজের প্রতি যে আস্থা বা কনফিডেন্স লেভেল সৃষ্টি হয় তা নিয়ে তারা বড় হতে পারে।

অন্যদিকে, তৃতীয় বিশ্বের ছাত্রদের মেধাশক্তি থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞান শিক্ষা ও মডার্ন টেকনিকগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ সহজে তাদের মেলে না।ল্যাবরেটরি বা গবেষণার সঙ্গে সংযুক্ত মডার্ন ইন্সট্রুমেন্ট বা টেকনিকের ব্যবহার আমাদের কাছে অনেকটা স্বপ্নের চেয়েও অনেক বেশি বলে মনে হয়। আমি আমার নিজের কথায় বলতে পারি। বিশেষ করে স্কুলে যখন পড়েছি, তখন কতোটুকুই বা সুযোগ পেয়েছি ল্যাবরেটরিতে হাতে কলমে শেখার? জলাশয় বা পুকুর থেকে ধরা ব্যাঙ বা কেঁচো ধরে এনে তার নাড়িভুঁড়ি কেটে দেখা ছাড়া এমনকি বায়োলজি প্রাকটিক্যাল শেখার সুযোগ ছিল আমাদের? আবার যখন ইউনিভার্সিটিতে গেলাম, তখনই বা কতটা সুযোগ ছিল আমাদের গবেষণা হাতে কলমে শেখার?

একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। রয়াল সাবজেক্ট রসায়নে। মাস্টার্স থিসিস যেসব ছাত্র করতেন বিশেষ করে জৈব রসায়নে (অরগানিক কেমিস্ট্রি), তাদের রসায়নের বিক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হতেই হয়। বিক্রিয়ার ফলে যেসব নতুন নতুন যৌগের সৃষ্টি হয়, তাদের স্ট্রাকচারও জানতে হয়। ডাক্তাররা যেমন থার্মোমিটার দিয়ে রোগীর শরীরের তাপমাত্রা নির্ণয় করে থাকেন, তেমনি অরগানিক কেমিস্টরা প্রোটন ও কার্বন-১৩ এনএমআর (নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স) ও মাস স্পেকট্র্স্কপির মাধ্যমে নতুন নতুন যৌগের স্ট্রাকচার নিরূপণ করে থাকেন।রসায়ন বিভাগে সেসময়ে আমাদের একটিমাত্র এনএমআর ইন্সট্রুমেন্ট ছিল। তাও মাত্র ৬০ মেগাহার্টজ, অতি পুরানো ও সেকেলে। আমরা ছাত্ররা সেই এনএমআর ইন্সট্রুমেন্টে হাতও দিতে পারতাম না। অলিখিত বারণ ছিল। যদি নষ্ট হয়ে যায় সে ভয়ে। বলতে পারেন যে, আমরা ছাত্ররা তখন ভয়ে ভয়ে ভয়ের শিক্ষায় বড় হয়েছি। সেই এনএমআর ইন্সট্রুমেন্টটি অপারেট করার জন্য বেতন দিয়ে একজন অপারেটর রাখা ছিল। একটু ভেবে দেখুন তো, ছাত্ররা যদি একটি ইন্সট্রুমেন্টে হাতই দিতে না পারেন, তাহলে তারা হাতে কলমে শিখবে কী করে?

অথচ জাপানে যখন প্রথম আসলাম তখন দেখলাম যে, এমন কোনো কাজ নেই যে স্টুডেন্টরা তা নিজে নিজে করছেন না। আত্মবিশ্বাসের মাপকাঠিটা তো সেখানেই। নিজে কোনো কাজ না করে আত্মবিশ্বাস কি বাড়ানো যায়? যাই হোক, জাপানে আসার পর ভয়ের সংস্কৃতি যেমন কেটে যেতে লাগলো, ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাসও বাড়তে থাকলো। ওরা পারলে নিজে কেন পারবো না? যেহেতু শেখার জন্য এখানে ইকুয়াল সুযোগ আছে, তাকে কাজে লাগানোই উত্তম।

জাপানের ল্যাবরেটরিতে এসে দেখলাম যে, মডার্ন ইন্সট্রুমেন্টের ছড়াছড়ি। বিএস, এমএস লেভেলের স্টুডেন্টদের কাছে এনএমআর ইন্সট্রুমেন্ট অপারেট করা যেন একটা খেলনা পুতুলের মতো। পুরনো মডেল বিধায় ৬০ মেগাহার্টজ এনএমআর সেখানে চোখে পড়েনি। ন্যূনতম ৪০০ অথবা ৬০০ মেগাহার্টজ প্রোটন এনএমআর ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা হরহামেশা নাড়াচাড়া করছেন। ইতোমধ্যে কিউসু ইউনিভার্সিটির ফার্মাসিউটিক্যাল ফ্যাকাল্টির ছাত্রের খাতায় নাম লিখেছি। সুযোগ সৃষ্টি হলো আধুনিক টেকনিকগুলো জানার ও শেখার।

শুধু এনএমআর-ই নয়, সার্কুলার ডাইক্রুইজম, মালদি-টফ-মাস, ইএসআই, পেপটাইড সিন্থেসাইজার, সলিড ফেজ সিন্থেসাইজার, ডিএনএ-আরএনএ সিন্থেসাইজার,  ইউভি, ক্রোমাটোগ্রাফিক সেপারেশন ইত্যাদি ছিল ল্যাবের সাধারণ টেকনিক। এগুলোর প্রতি ধীরে ধীরে দখল আসতে লাগল। ল্যাবে দৈনন্দিন জীবনও সহজ হতে লাগলো।  কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে আর হলো না। নিজের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতির জায়গাগুলোও ক্রমান্বয়ে পূরণ হতে শুরু করলো।

দেশে বিদেশে যেখানেই আমরা বসবাস করিনা কেন, নতুন পরিবেশে অন্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব  স্থাপন ও সুসম্পর্ক অতিব জরুরি। বন্ধুত্ব হচ্ছে জীবনের এক বড় অংশ। বন্ধুহীন জীবনে তৃপ্ততা থাকতে পারেনা। কেউ সহজে বন্ধু বানিয়ে ফেলতে পারেন, কেউ পারেন না। মানুষ কেন যে সহজে আমার বন্ধু হয়ে যায় তাও আমার জানা নেই। তবে সেইসূত্র মতেই খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে জাপানে ল্যাবের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। তাদের সঙ্গেসুসম্পর্ক বিদেশ জীবনে আমার প্রাথমিক দিনগুলিকে সহজ করে দেয়। জাপানি স্টুডেন্টদের সহায়তা আমার কখনোই ভুলবার নয়, আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।

আমার গবেষণার ম্যনটর ছিলেন ড. সিগেকি সাসাকি। আমার জীবন চলার পথের এক অনুঘটক ও অনুপ্রেরণা। তিনি হচ্ছেন অতি পরিশ্রমী  একজন মানুষ। অধ্যাপক হওয়ার পরও একজন মানুষ কতো পরিশ্রম করতে পারেন, তার উজ্জ্বল এক উদাহরণ হচ্ছেন ড. সাসাকি। তার সঙ্গে পরিচয় না হলে‘পরিশ্রম যে সৌভাগ্যের প্রসূতি’ তা দেখার ও জানার অভিজ্ঞতা অনেকটায় অসম্পূর্ণ থেকে যেত।

১৯৯৭ সালে দেশ থেকে প্রথম যখন জাপান নামের এই স্বর্গদেশে ঢুকে পড়লাম, মনে হল ‘সততার খনির’ এক দেশে যেন ঢুকে পড়েছি। জাপানিরা যে কতো সৎ ও দেশপ্রেমিক জাতি, তা ওই দেশে না পা বাড়ালে সত্যিই অজানা থেকে যেত। আমাদের দেশেও নিজেদের পরিবারের বা আশপাশের এমন কেউ কেউ থাকেন, যারা সৎ মানুষের মডেল। কিন্তু জাপানিদের দেখলে মনে হবে প্রত্যেকেই যেন সততার মডেল। সততা ও সত্য কথা বলা তাদের মগজের অংশ। তাদের মস্তিষ্কের নিউরন সেলগুলোকে অ্যানালাইসিস করলে হয়তো দেখা যাবে যে সেগুলো কেবল সৎ সেলে ভরে গেছে, বদ সেলগুলো প্রবেশের সুযোগই পায়নি।

ধর্মে কিন্তু জাপানিরা মুসলিম নয়। মূল ধর্ম তাদের শিন্তো ও বৌদ্ধ। অথচ সত্যের বিপরীতে মিথ্যা নামের যে একটি শব্দ ডিকশনারিতে আছে, তাও যেন তাদের জানা নেই। সেভাবেই শিশুরা সেখানে বড় হতে থাকে। যদিও সত্যকথা বলার শিক্ষা হচ্ছে সব ধর্মেরই শিক্ষা। আমরা কতটুকু তার চর্চা করে থাকি?

আরো একটি কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। তা হচ্ছে বিভাজন। জাপানে যখন প্রথম যাই সেখানে সমাজে বিভাজনের কোনো বড় রেখাপাত চোখে পড়েনি। অথচ আমাদের দেশের বিভাজনের চিত্র আমাদের অজানা নয়। আমরা বিভাজনের মধ্যেই বড় হয়েছি। আমাদের সমাজে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত মানুষ দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এই বিভাজন দীর্ঘদিন থেকে দেশে বিদ্যমান। কথায় আছে, রাজনীতির মধ্যে পলিটিক্স ঢুকে গেছে।

দীর্ঘদিন জাপানে থেকে দেখলাম যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পলিটিক্সের কোনো বালাই নেই। শিক্ষকদের মাঝে সেখানে বিভাজনের কোনো রেখাপাত চোখে পড়েনি। কোনো স্টুডেন্ট পলিটিক্সও সেখানে দেখিনি। শিক্ষকদের যে জ্ঞান গরিমা তা সর্বদা নিবেদিত কেবল ছাত্রদের জন্য, মূলত শিক্ষা ও গবেষণাকেন্দ্রিক। জীবন চলার পথে আমাদের অনেক অন্তরায় আছে। তা সত্ত্বেও দেশটা কোথাও আটকে বা পিছিয়ে নেই। হয়তো আরো উৎরে যেতে পারতো। শিক্ষাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছোট খাটো যেসব অসঙ্গতি ও বিভাজন রয়েছে, সেগুলোর ব্যবধান যদি কমিয়ে আনা যেত।

(চলবে)

আগের পর্ব

ছবি: লেখক

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, বোস্টনের ম্যাসাচুসেটসে একটি ওষুধ কারখানায় কর্মরত

ইমেইল: alamrowshon@gmail.com