দেশে বিদেশে: মেরিল্যান্ডের পথে, পর্ব ১০

নর্থ আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে দাঁড়িয়ে আছে মেরিল্যান্ড। দীর্ঘ ‘চিসাপেক বে’ বয়ে গেছে নর্থ মেরিল্যান্ডের বুক চিরে। ঠিক ভার্জিনিয়া অভিমুখে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছোট-বড় আরো শতাধিক নদ-নদী।

মো. রওশন আলম, যুক্তরাষ্ট্র থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2019, 07:56 AM
Updated : 12 Nov 2019, 07:56 AM

যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণের দিকে সবচেয়ে দীর্ঘ হাইওয়ে-৯৫ মেরিল্যান্ডের বুকের উপর দিয়ে চলে গেছে এদিক ওদিকে। শিক্ষাদীক্ষা ও গবেষণায় অগ্রসরমান একটি স্টেটের নাম মেরিল্যান্ড। সেই স্টেটে আসার জন্য যাত্রা করেছি। সরাসরি জাপান থেকে। সময়টা ছিল ২০০৩ সাল। ২৮ ফেব্রুয়ারি। যুক্তরাষ্ট্রে এর আগে কখনোই আসিনি। এখানে আসার জন্য অদম্য যে ইচ্ছে ছিল তাও নয়। তবুও আসতে হলো।

‘ইউনাইটেড স্টেইটস অব আমেরিকাকে’ বলা হয় যুক্তরাষ্ট্র। এটি এমন একটি দেশ যার মূল ভিত্তি টেকনোলোজি ও গবেষণার উৎকর্ষতা। হাজার হাজার গবেষক আসেন বিদেশ থেকে এদেশে। এদেশের ন্যাশনাল ইন্টারেস্টে তারা প্রতিনিয়ত অবদান রাখছেন গবেষণা ও আবিষ্কারের মাধ্যমে। বিজ্ঞানের নানা পরিধিতে এ গবেষকদের বিচরণ। বায়োলজি, কেমিস্ট্রি, মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং এককথায় বিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই যার গবেষণা এদেশে হচ্ছে না। আমার কাজও গবেষণা।

সমগ্র আমেরিকার গবেষণার উৎকর্ষে একটি প্রতিষ্ঠান বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ফান্ডিং করে থাকে, যার নাম ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ’ বা এনআইএইচ। এটি সরকারি বা ফেডারেল প্রতিষ্ঠান। ২৭টি ন্যাশনাল রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সমন্বয়ে গঠিত এই এনআইএইচ। অন্তত বিশ হাজারেরও বেশি ইমপ্লয়ি বিভিন্ন পেশায় চাকরি করছেন এখানে। ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অন এজিং’ বা এনআইএ নামের একটি প্রতিষ্ঠান আছে যা ওই ২৭টির মধ্যে একটি। এখানেই আমার গবেষণার কাজ। এই প্রতিষ্ঠানটির লোকেশান হচ্ছে বালটিমোর শহরের জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ভেতরে। এখানে তিন বছরের জন্য আমাকে গবেষণা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ২০০৩-২০০৬। এনআইএইচ রিসার্চ ফেলো।

দীর্ঘ যাত্রার পথ মেরিল্যান্ড। জাপানের ফুকুওকা এয়ারপোর্ট থেকে ওসাকার কান্সাই এয়ারপোর্ট। তারপর নর্থ-ওয়েস্ট এয়ারলাইন্সে মিশিগানের ডেট্রয়েট এয়ারপোর্ট। একটানা প্রায় ১৪ ঘণ্টার ফ্লাইট। সঙ্গে স্ত্রী, সাড়ে চার বছরের কন্যা রিনভী ও দুবছরের পুত্র রাকীন। স্বপ্নের এই দেশে সপরিবারে আগমন ঘটল ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩।

ডেট্রয়েটে ছিল দুই ঘণ্টার ট্রানজিট। প্লেন থেকেই দেখা যাচ্ছিল তুষারে ঢাকা পড়েছে শহর। শুধু সাদা আর সাদা। মেঘ আর ভূমির রঙে কোনো বিভেদ নেই। শুভ্রতায় ভরা আকাশ ও জমিন।

পরের প্লেনটি উড়বে বালটিমোরের উদ্দেশ্যে। বালটিমোর-ওয়াশিংটন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট বা বিডব্লিউআই। বালটিমোর, মেরিল্যান্ড স্টেটের একটি বড় শহর। বিডব্লিউআই এয়ারপোর্টে প্লেনটি ল্যান্ড করলো ঠিক বিকেলে। ইমিগ্রেশন ক্রস করে বের হয়ে আসাটা ছিল সময়সাপেক্ষ ব্যাপার তখন। অনেক ফর্মালিটিজ। কারণ মাত্র দুবছর আগে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এক বিভীষিকা বয়ে গেছে এ দেশটির উপর দিয়ে যা ৯/১১ নামে পরিচিত।

এই দিবসে ১৯ জন সন্ত্রাসী চারটি এয়ারপ্লেন হাইজ্যাক করেই কেবল ক্ষান্ত ছিল না, সেই প্লেনগুলো নিয়ে তারা আছড়ে পড়েছিল টুইন টাওয়ার, পেন্টাগন ও পেনসিলভানিয়ার এক জঙ্গলে। প্রায় ৩ হাজার নিরীহ মানুষ সেইদিন প্রাণ হারিয়েছিল। সেই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রে আসা মুসলিম দেশের অন্তত ২৬ দেশের মানুষগুলোর ইমিগ্রেশনের উপর কড়াকড়ি আরোপ ছিল। বাংলাদেশ ছিল সেই ২৬ দেশের একটি। তাই বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে ইমিগ্রেশনে সেই ঝক্কি ঝামেলা পার করে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আসা ছিল সময়সাপেক্ষ একটা প্রসিডিউর।

এয়ারপোর্টের বহির্গমন এরিয়াতে অপেক্ষা করছিলেন ড. মাইকেল সাইডম্যান এবং ড. জামালউদ্দিন। ড. সাইডম্যান হচ্ছেন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের (এনআইআইচ) একজন সায়েন্টিস্ট। তিনি প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর। তিনিই আমার রিসার্চ ম্যানটর। তার ল্যাবরেটরিতেই আমার কর্মক্ষেত্র। আর ড. জামালউদ্দিন একজন বাংলাদেশি সায়েন্টিস্ট। তার সঙ্গে আমার পরিচয় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার সময় থেকে। উনি ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডে পোস্ট ডক্টরেট করছিলেন। দারুণ হাসিখুশি একজন মানুষ তিনি। দিল তার দরিয়ার মতো বড়। তাকে মেরিল্যান্ডে পেয়ে সত্যিই ধন্য ছিলাম আমি। স্বপ্নের দেশে নেমে প্রাথমিক পথচলা অনেক সহজ করে দিয়েছিলেন জামাল ভাই।

দুজনের দু’ গাড়িতে আমরা ভাগ ভাগ করে বসে পড়লাম। আমি উঠেছি ড. সাইডম্যানের গাড়িতে। আর আমার ফ্যামেলি চেপে বসলো জামাল ভাইয়ের গাড়িতে। বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা প্রায়। রাস্তায় কোনো ধুলিকণা নেই। তুষারপাতে সব ঘনীভূত হয়েছে। আসতে আসতে সাইডম্যান বলছিলেন যে, গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে এতো স্নো অতীতে পড়েনি। এটি রেকর্ড। গাড়ি চলছে। রাস্তার দুপাশে যেদিকে দৃষ্টি যায় যতদূর যায়, শুধু স্নো আর স্নো। জাপানেও তুষারপাত দেখেছি, কিন্তু এতো স্নো দেখিনি। সত্যিই ভয়াবহ।  

প্রায় ঘণ্টাখানেকের বেশি লেগে গেল এয়ারপোর্ট থেকে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে পৌঁছাতে। ‘কি-ল্যান্ডিং’ এপার্টমেন্ট। নামটি বড়ই চমৎকার। কি-ল্যান্ডিং।  দুই বেড, দুই বাথ- একটি ফুল, একটি হাফ। ড্রইং রুম বেশ বড়সড়। রেফ্রিজারেটর, চার বার্নারের চুলা, ওয়াসার, ড্রায়ার, ডিশ ওয়াসার- সবই আছে অ্যাপার্টমেন্টে। জাপানের তুলনায় সবকিছু বড় বড় লাগছে এখানে। মানুষও বিশাল সাইজের। জাইগানটিক। অ্যাপার্টমেন্টের অফিস সহকারী মেয়েটিকে দেখে চমকে উঠলাম। নাম কেলি। এতো স্থূলাকার সাইজের ভদ্র মহিলা অতীতে আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। যদিও টিভির পর্দায় হলিউড মুভিতে বিশেষ চরিত্রে এরূপ সাইজের মানুষ দেখেছি, বাস্তবে নয়। এবার স্বচক্ষে দেখছি, চোখের সামনে।

দারুণ রসিক মহিলা কেলি। আমার স্ত্রীর (সাথী) সঙ্গে তার খাতির জমে গেল প্রথম দেখাতেই। হাতে অ্যাপার্টমেন্টের চাবি বুঝে দেবার আগে কেলি বুঝিয়ে দিলো কোথায় জিম আছে, কোথায় সুইমিং পুল, কোথায় চিলড্রেনদের প্লে গ্রাউন্ড, ব্লা...ব্লা...ব্লা। সাথী কেলিকে বলল, তুমি কি জিম করো? কেলি দারুণ একটা হাসি দিল। প্রাণখোলা হাসি। যত বড় দেহ তার চেয়ে বহু বড় তার হাসি। নিষ্কলুষ হাসি- প্রাণখোলা।

জার্নি হয়েছে লম্বা। শরীর ক্লান্ত। এবার ক্লান্ত দেহ আর চাইছে না জেগে থাকতে। সাইডম্যান দোকান থেকে খাবার, ওয়ানটাইম প্লেট গ্লাস ড্রিংকস যা এনেছিল, সেসব ফ্লোরে বসে আমরা সাবাড় করে ফেললাম। তারপর যে যার মতো চলে গেলেন। আমাদের ক্লান্ত দেহ মেঝেতে ঘুমের ঘোরে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। রিনভী-রাকীন দুই ভাই-বোন না খেয়ে আগেই ঘরের এক কোণে ঘুমিয়ে পড়েছে।

মাঝখানে শনি-রোববার। ছুটির দিন। এই দুদিন পরেই ল্যাবে যেতে হবে। গাড়ি নেই, কিনতে হবে। তবে বাস সার্ভিস আছে কি-ল্যান্ডিং অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সরাসরি জন্স হপকিন্স পর্যন্ত। সুতরাং অফিসে বা ল্যাবে যাবার আপাতত কোনো চিন্তা নেই। বড় চিন্তার বিষয় হচ্ছে বাজার সদা করা। সবচেয়ে কাছের যে গ্রোসারি সোপ, তা প্রায় দেড়  দু-মাইল দূরে। গাড়ি ছাড়া গ্রোসারি করা দুঃসহ ব্যাপার এখানে। চাল-সবজি-তেল-দুধ-ডিম এসব কিনে হাতে বয়ে নিয়ে আসা সত্যিই কষ্টকর। উবার সার্ভিস তখন চালু ছিল না। ট্যাক্সিও এতো অল্প দূরত্বের জন্য যুতসই নয়। তাই রিনভী-রাকীনকে বহন করা বেবি-কার্ট হয়ে উঠল আমাদের সাময়িক বাহন। এভাবেই চলতে থাকে কিছুদিন।

মাসখানেক হয়েও গেলো। পুরানো একটি গাড়ি কিনে ফেললাম। নিশান ইনফিনিটি জি-২০। রাশিয়ার এক কলিগের কাছ থেকে। সেই গাড়ি নষ্ট হতো কিছুদিন পর পরই। পরিস্থিতিও এমন ছিল যে, না পারি নতুন গাড়ি কিনতে, না পারি পুরানো গাড়িটি ফেলতে, না পারি সেই নষ্ট গাড়ি রিপেয়ার করতে। এমন এক দেশ আমেরিকা যেখানে গাড়ির পার্টসের চেয়ে শ্রমিকের ঘণ্টার দাম অনেক বেশি, গাড়ি রিপেয়ার যথেষ্ট ব্যয়বহুল এখানে। কথায় আছে, টাইম ইজ মানি, তাই।

যাই হোক, সেই গাড়ি নিয়ে আমরা বালটিমোর শহরটাকে চিনতে শুরু করলাম। ‘ইনার হারবার’ বালটিমোরের প্রাণকেন্দ্র। কারণে অকারণে ইনার হারবার ও এই শহরের শপিং মলগুলোর দিকে আমাদের যাতায়াত বেড়ে গেলো। পাঞ্জাব নামের এক হালাল দোকানের খাসির মাংশ কেনাও বেড়ে গেলো।

আমাদের ঘোরাফেরার পরিধি বেড়ে যেতে লাগলো বালটিমোর থেকে কিছুটা দূরে। ওয়াশিংটন ডিসি ও ভার্জিনিয়া বেশি দূরে নয়। মাত্র ৪৫-৫০ মিনিটের পথ ওয়াশিংটন ডিসি। আমরা প্রায় যেতাম সেখানে। ওয়াশিংটন ডিসি হচ্ছে মিউজিয়ামের শহর। সেখানকার মিউজিয়ামগুলোর নাম-ডাক আছে বিশ্বজুড়ে। স্পেস মিউজিয়ামের কথা এখনো মনে পড়ে। এপোলো-১১ যা নিয়ে মানুষ প্রথম চাঁদে অবতরণ করেছিল সেই স্পেসফ্লাইটটি এই মিউজিয়ামে দর্শকদের জন্য রাখা আছে। একটি গ্রহ থেকে আরেকটি গ্রহের দূরত্ব এবং তাদের রিলেটিভ সাইজ অনুপাতে পাশাপাশি ঝুলিয়ে রাখা আছে এখানে যা দেখলে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, এতো ছোট একটি গ্রহ পৃথিবী যেখানে মানবরা বসবাস করছে, অন্য গ্রহগুলোতে তাহলে কিবা আছে? আমরা কি সেই গ্রহগুলোতে কখনো পৌঁছতে পারবো?

তাছাড়া সাদা প্রলেপে তৈরি বিখ্যাত এক বাড়ি রয়েছে ডিসিতে।। নাম যার হোয়াইট হাউজ। প্রেসিডেন্টের বাসভবন। একজন ঢোকে এক দরজা দিয়ে, আরেকজন বেরিয়ে যায় অপর দরজা দিয়ে। স্বাধীন হবার পর ২৪৩ বছরের ইতিহাসে ৪৫ জন প্রেসিডেন্ট এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। তার মধ্যে ৪৪ জনই বসবাস করেছেন এই সাদা বাড়িতে। ভিজিটররা সারাদিন গিজগিজ করে এর চারপাশে।

পাঠকরা, আজ তাহলে এ পর্যন্তই। আবার দেখা হবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য ফিরিস্তি নিয়ে।

লেখক: বোস্টনের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত

ই মেইল: alamrowshon@gmail.com

(চলবে)

আগের পর্ব

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!