বাসার বিপরীত পাশেই বিশাল রাগবি খেলার মাঠ। সেখানে প্রায় সবসময়ই খেলাধুলা চলে। বড়রা রাগবি খেলতে এলে ছোটরা কি করবে তখন, হয়তো সেটা ভেবেই রাগবি মাঠের পাশেই আরও কিছুটা জায়গা উঁচু করে সেখানে বাচ্চাদের খেলার জায়গা করা হয়েছে।
মাঠের পাশেই রাস্তা বরাবর গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। আমাদের গাড়িটা সেখানেই পার্ক করে রাখা হয়। একদিন আমরা বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ভদ্রলোক ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি ভারতীয়?”
আমি বললাম, “না, আমরা বাংলাদেশি।” উত্তরে সে বলল, “তোমার গিন্নির পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছিল তোমরা ভারতীয়।”
আসলে দেশের বাইরে গেলে বেশিরভাগ বাংলাদেশিকেই এই বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। চেহারা এবং পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে সবাই ভারতীয় বা শ্রীলংকান বা পাকিস্তানি বলে সন্দেহ করে। তখন আমাদেরকে যেচে পড়ে সেই ভুল ভাঙিয়ে দিতে হয়। তখন আবার হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করি, বয়সের একটা আলাদা আধিপত্য আছে।
যেহেতু ভারত, শ্রীলংকা বা পাকিস্তানের জন্ম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের বেশ আগে, তাই সবাই এই ভুলটাই করে। বাংলাদেশের জন্মও যদি একই সময়ে হতো, তাহলে হয়তোবা আমাদেরকে এই বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না।
যাই হোক, পলের সাথে তক্ষুণি বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। পলের পরের প্রশ্ন ছিল, “ও, তোমরা সেই দেশের নাগরিক যারা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দাও না।” আমি এই প্রশ্ন শুনে একইসাথে বিস্মিত ও লজ্জিত হলাম। বিস্মিত হলাম পলের জানার পরিধি দেখে, আর লজ্জা পেলাম ঘটনাটা সত্যি বলে।
তারপর পল রানা প্লাজার ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলল, “তোমরা এমনকি শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তাও দিতে পারো না। ব্যবসায়ীরা সব দেশেই শ্রমিকদের ফাঁকি দেয়, কিন্তু তোমাদের দেশে মনে হয় একটু বেশি।” বলে আমার দিকে তাকালো পল।
আমি বললাম, “কথাটা অপ্রিয় হলেও তুমি সত্যিটাই বলেছো। শ্রমিক সারাজীবন শ্রমিকই থেকে যায়, কিন্তু কারখানার মালিকের কারখানার সংখ্যা এবং বাড়ির তলার সংখ্যা বাড়তেই থাকে।” পল রাগবি মাঠটার মধ্যে দিয়ে কোণাকুণি হেঁটে স্টেশনে আসা-যাওয়া করে। তার দেরি হয়ে যাচ্ছিল দেখে সেদিনের মতো বিদায় নিল।
এরপর থেকেই পলের সাথে বিভিন্ন সময়ে দেখা হয়েছে, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আর সেভাবে আলাপ করা হয়ে ওঠেনি। রায়ানকে নিয়ে একদিন বাইরে বসে আছি, দেখলাম পল কাজ থেকে ফিরছে। সাথে তার একজন বন্ধুও আছে। রায়ানকে দেখে বলে উঠলো, “হাউ আর ইউ লিটল ব্যাম্বিনো?”
উত্তরে আমি জানালাম, সারাক্ষণ তার ঠাণ্ডা লেগে থাকে। শুনে পল আর পলের বন্ধু দু’জনই একসাথে কথা বলা শুরু করলো। তাদের কথার সারমর্ম হচ্ছে, বাইরের দুধ বাচ্চাদেরকে একটু কম খাওয়ানোই ভালো। কারণ, এই দুধে মিউকাস থাকে। আর মিউকাস বাচ্চাদের ঠাণ্ডা সারতে দেয় না।
এছাড়াও রায়ানের পোশাক-আশাকের বিষয়েও মতামত দিল। একটু পরে তাহিয়া আমাদের সাথে এসে যোগ দিলে তারা দু’জনই তাহিয়াকে কুর্নিশ করে জানতে চাইলো, “হাউ আর ইউ প্রিন্সেস?”
উন্নত দেশগুলোর এই আচরণগুলো আমাকে খুবই আকর্ষণ করে। এরা বাচ্চাদেরকে অনেক বেশি সম্মান দেয়। হয়তোবা এই কারণেই এখনকার বাচ্চারা যখন বড় হয়, তখন তারা বড়দেরকে সম্মান করে এবং গায়ে পড়ে উপকারও করে। আলাপ শেষ করে পল বলল, “এখন তো বাইরে অনেক বাতাস, তুমি ওদেরকে ঘরের ভেতরে নিয়ে যাও।” তাই আমি পল এবং তার বন্ধুকে বিদায় দিয়ে ঘরে ফিরে গেলাম।
এরমধ্যেই বাসা বদলে আমরা নতুন বাসায় গিয়ে উঠেছি। এখানে যেহেতু প্রত্যেক পাড়াতেই একটা করে খেলার জায়গা থাকে, তাই আর খুব বেশি আসা হয় না আগের বাসার সামনের পার্কটাতে। পল ও তার বন্ধুর সাথেও দেখা হয় না আর।
এইবারের স্কুল ছুটিতে গিন্নি এবং রায়ান ও তাহিয়াকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়াতে হাতে বেশ অবসর। তাই একদিন রোববার বিকালে আশফাক ভাই আমার আগের বাসার সামনের পার্কটাতে চলে আসতে বললেন। উনি ভাবীকে স্টেশন থেকে উঠিয়ে নিয়ে আলিশা আর দৃপ্তকে নিয়ে আসবেন। আর বিজয়দাকেও উনি রুপা বৌদি আর তাদের মেয়ে এলভিরা এবং ছেলে রেনোরকে নিয়ে আসতে বলেছেন।
আমার হাতে যেহেতু কোনোই কাজ ছিল না, তাই তক্ষুণি রওয়ানা দিয়ে দিলাম। খেলার মাঠের পার্কিংয়ে গিয়ে দেখি, আশফাক ভাইয়েরাও কেবলই এসেছেন। গাড়ি থেকে নেমে দৃপ্ত বল নিয়ে রাগবি মাঠে চলে গেল। আর আমাদের দু’জনকে বলল, তাকে কিক করে গোল দিতে। সে ইতোমধ্যেই রাগবির গোল পোস্ট দুটোকে ফুটবলের গোল বানিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।
এভাবে কিছুক্ষণ খেলার পর আমরা উপরের পার্কটাতে এসে গল্প শুরু করে দিলাম। বিজয়’দা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তাই আর তারা এলেন না। আমরা ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ দেখি, রাগবি মাঠটাকে কোণাকুণি অতিক্রম করে পল এগিয়ে আসছে।
আমি দৌড়ে গিয়ে পলের সামনে দাঁড়ালাম। পল আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “অনেকদিন পর দেখা।” আমি বললাম, “আমরা বাসা বদলেছি।” শুনে সে বলল, “তাই তো তোমাদের দেখি না আর। যাই হোক। তোমার ব্যাম্বিনো আর প্রিন্সেস কেমন আছে?” শুনে আমি মনে মনে অনেক খুশি হলাম। তার মানে, পল আমাদেরকে মনে রেখেছে।
আমি বললাম, “সে অনেক বড় হয়ে গেছে।” মোবাইলে রায়ান আর তাহিয়ার ছবি দেখিয়ে দিলাম। পল বলল, “তোমার বাচ্চা দুটো ঠিক তোমার মতো।” শুনে আমি আরও খুশি হলাম। এরপর পল আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা প্রশ্ন করলো, “তুমি জর্জ হ্যারিসনকে চেন?” আমি বললাম, “অবশ্যই। উনি আমাদের জন্য যা করেছেন, সেটা আমরা জাতি হিসেবে কখনোই ভুলবো না।”
শুনে পল বলল, “হ্যা, সেই নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারের কনসার্ট আমার এখনও মনে আছে।” বলে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “পরকালে উনি ভালো থাকুন।” এরপর আমরা ধর্মকর্ম নিয়েও বেশ কিছুক্ষণ আলাপ করলাম। দেখলাম, সে পৃথিবীতে বিদ্যমান প্রধান ধর্মগুলোর সবকটা সম্বন্ধেই জ্ঞান রাখে। এমনকি সব ধর্মগুরুদের নাম পর্যন্ত জানে।
আমাদের আলাপ করতে দেখে আশফাক এগিয়ে এলে উনার সাথেও আমার বন্ধু পলের পরিচয় করিয়ে দিলাম। তারপর বললাম, “পলের সাথে আবার কবে দেখা হবে বলা তো যায় না, আমাদের দু’জনের একটা ছবি তুলে দেন।” আশফাক ভাই আমাদের দু’জনের একটা ছবি তুলে দিলেন।
পলের সম্বন্ধে একটু তথ্য দিয়ে রাখি। পলের বাবা ইতালি থেকে এই দেশে এসেছিলেন। তারপর এখানেই বিয়ে করে সংসারি হয়ে যান। আমি অবশ্য কারও ব্যক্তিগত বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করি না যদি না তিনি নিজে থেকে বলেন। কিন্তু দেশের নামটা বললাম যাতে করে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হয়।
পলকে একা দেখে তার বন্ধুর কথা জানতে চাইলাম। পল জানালো যে বন্ধুটি অসুস্থ। আমি তখন তার কুশল জিজ্ঞেস করলাম। এভাবে আলাপ করতে করতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। তখন আবার আমরা দু’জনেই একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবার দেখা হবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করে বিদায় নিলাম।
এই মানুষটার সাথে আমার পরিচয় এখানে আসার প্রায় বছরখানেক পর। এরই মধ্যে আবার প্রায় দেড়-দুই বছর দেখা হয়নি। কিন্তু ঠিকই সে আমাদেরকে মনে রেখেছে। এটা ভাবলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। আবারও আমি পৃথিবীর মানুষদের প্রতি নতুন করে শ্রদ্ধাশীল হই।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী
মেইল: yaqub_buet@yahoo.com
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |