চাঁদের আলোয় প্রবাসীদের চড়ুইভাতি

নতুন প্রজন্মকে চড়ুইভাতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে আমরা আয়োজন করেছিলাম এক চড়ুইভাতি। সেই গল্পই আজকে আমার লেখার বিষয়বস্তু।

মো.ইয়াকুব আলী, অস্ট্রেলিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 July 2018, 06:49 AM
Updated : 4 July 2018, 06:49 AM

অস্ট্রেলিয়াতে সাপ্তাহিক ছুটি শনি ও রোববার। আর সেটার রেশ শুরু হয়ে যায় শুক্রবার বিকেল থেকেই। কারণ, শুক্রবার সবাই অফিস সময়ের একটু আগেই কাজ শেষ করে বাসায় ফেরে। এমনই এক শুক্রবারে একটু আগে বাসায় ফেরার পর মনে হলো, আজকের এই বাড়তি পাওয়া সময়টাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়?

তখনই হঠাৎ করে মাথায় খেলে গেল চড়ুইভাতি করার বুদ্ধিটা। আমার পরিকল্পনার কথা আমার মেয়ের বান্ধবী জেইনার মাকে বলার সাথে সাথেই উনি রাজি হয়ে গেলেন। এরপর আমি আমার গিন্নির সাথে আলাপ করলাম। পরিকল্পনা করতে তো আর কিছুই লাগে না, কিন্তু সেটাকে কাজে পরিণত করতে অনেক কিছুই লাগে।

আমরা দুই পরিবারের মানুষ মিলে আমাদের চাল-ডালের মজুদ দেখে নিলাম। কিন্তু চড়ুইভাতির আসল উপকরণ চুলা, এর জ্বালানি কীভাবে পাওয়া যাবে- সেটা নিয়ে আমরা ভাবতে শুরু করলাম। যেই ভাবা সেই কাজ। আমি তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়লাম জ্বালানির সন্ধানে। 

এখানে প্রত্যেকটা পাম্পেই কাঠ আর বরফ পাওয়া যায়। তাই একটা পাম্পে গিয়ে এক বস্তা কাঠ কিনে ফেললাম। এখন এই কাঠ কীভাবে জ্বালানো যাবে কাউন্টারের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, “তুমি এক লিটার জ্বালানি তেল নিয়ে নাও, তাহলেই হবে। তুমি একটা এক লিটারের খালি বোতলে তেল ভরে নিলেই হয়ে যাবে।”

আমাদের গাড়ির পেছনের ডেকে সাধারণত পানির খালি বোতল থাকে, কিন্তু সেদিন খুঁজতে গিয়ে দেখি একটাও নেই। এরপর আমি সারা মিন্টো শপিং মলের সবগুলো ডাস্টবিন খুঁজেও একটা বোতল জোগাড় করতে পারলাম না। কারণ, ইদানিং সিডনিতে খালি বোতল ফেরত দিয়ে ‘রিটার্ন অ্যান্ড আর্ন স্কিম’ চালু হয়েছে। তাই এক শ্রেণির মানুষ খালি বোতল কুড়িয়ে ফেরত দিয়ে দুটো বাড়তি পয়সা রোজগারে লেগে গেছে।

অবশেষে শপিং মলের ভেতরের একটা বিন থেকে একটা বোতল খুঁজে পেলাম। এরপর পাম্পে ফিরে সেটাতে কীভাবে তেল ভরবো, সেই ভাবনায় পড়লাম! হঠাৎ দেখি আমার পূর্ব পরিচিত রবি দাদা গাড়িতে তেল নিচ্ছেন। আমি দাদার কাছে গিয়ে আমার সমস্যার কথা বলতেই দাদা বললেন, “আপনি বোতল ধরেন, আমি ভরে দিচ্ছি।” 

রবি দাদার সাথে আমার অল্প ক’দিনের পরিচয়। দূর্গা পূজা দেখতে গ্লেনফিল্ডের অস্থায়ী মন্দিরে গেছি। মা দূর্গার সাথে একটা ছবি তুলে রাখার জন্য পাশে রবি দাদাকে আমার ইচ্ছার কথা জানাতেই উনি রাজি হলেন। এরপর অনেক সময় নিয়ে দাদা আমার বেশ কয়েকটা সুন্দর ছবি তুলে দিলেন। এরপর থেকেই এই মানুষটার সাথে আমার অন্তরঙ্গতার শুরু।

আমি শক্ত করে বোতল ধরে থাকলাম, আর দাদা আস্তে আস্তে তেল ঢালতে লাগলেন। কিন্তু তাতে অনেক সময় লাগছিল দেখে দাদা বললেন, “একটু তাড়াতাড়ি ঢালি, কি বলেন?” যেই তাড়াতাড়ি ঢেলেছেন, অমনি সমস্ত তেল বাউন্স করে আমাদের দু’জনকে আধভেজা করে দিল।

তারপর অনেক সময় নিয়ে দু’জন মিলে ধীরে ধীরে বোতল ভরলাম। কিন্তু দাদা কোনভাবেই আমার কাছ থেকে টাকা নিলেন না। উনি বললেন, “এখন আমি আমার গাড়িতে তেল নেব, সেটার সাথেই বিল দিয়ে দেব।”

তেল নিয়ে বাসায় ফিরে দেখি জেইনার মা আর আমার গিন্নি মিলে আমাদের বারান্দায় রান্নার সব উপাদান নিয়ে হাজির। আমি জেইনাদের বাসা থেকে কয়েকটা ইট এনে চুলা তৈরি করে ফেললাম। তারপর মনে হলো, এমন আনন্দ সবার সাথে ভাগাভাগি করলে বহুগুণে বেড়ে যাবে। তাই একে একে বিজয়দা, আশফাক ভাই, মাসুদ মিথুন ভাই, স্বপন ভাই, সাগর ভাই, বাপ্পি ভাই, পুলক ভাই, মোনা ভাবী- সবাইকে কল দিয়ে আমাদের সাথে যোগ দিতে বললাম।

সপ্তাহান্তে সবারই অনেক কাজ থাকে, তাই শেষ পর্যন্ত সপরিবারে বিজয়দা, আশফাক ভাই, মাসুদ মিথুন ভাই আসলেন। রুপা বৌদি একটু পরে এসে আমাদের সাথে যোগ দিলেন আর সাগর ভাই বাসায় না থাকতে আমি গিয়ে রুমানা ভাবী আর বাচ্চাদের নিয়ে এলাম। নীলা ভাবীরও কাজ থাকাতে উনি আসতে পারলেন না।

আমরা বড়রা একত্রিত হলে আমাদের চেয়ে বাচ্চাদের আনন্দ হয় বহুগুণ বেশি। তাই তাসমিয়া, তামজিদ, তৌহিদ, তাহিয়া, রায়ান, জেইন, জাহিয়া, আলিশা, দৃপ্ত, এলভিরা, রেনোর, অর্ণভ এবং ঋষিকা- ওরা যথারীতি হৈ-চৈ করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল। আর সেইসাথে চললো বিভিন্ন প্রকারের খেলাধুলা এবং তারাবাজি পোড়ানো।

কিন্তু আমার খারাপ লাগছিল স্বপন ভাই, বাপ্পি ভাই আর হাসি ভাবী, মোনা ভাবী, ফেরদৌস ভাই, পুলক ভাই আর ইলা ভাবী আর উনাদের বাচ্চাকাচ্চা নুরিন, স্বপ্নিল, স্বাধীন, রাবাব, নওয়া, অবনি আর অর্কর জন্য। কাজ থাকাতে তারা আসতে পারেন নাই।

সবমিলিয়ে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে সিদ্ধান্ত হলো, একসাথে দুইটা চুলা বানালে রান্না তাড়াতাড়ি শেষ করা যাবে। তাই আমি দুটা চুলা বানিয়ে কাঠগুলোকে ফেড়ে আরও একটু সরু করার কাজে লেগে গেলাম। বিজয়দা আর মাসুদ মিথুন ভাই লেগে গেলো রান্নার কাজে।

রুমানা ভাবী আর দিশা ভাবী আমাদেরকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিল। আমি পাশেই রাখা আমাদের গাড়িতে মাইলসের প্রত্যাশা এলবামের সিডিটা চালিয়ে দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে রাখলাম। যাতে করে রান্না করতে করতে আমরা গানও শুনতে পারি।

রান্না শেষ হলে পরিবেশনের পালা যখন আসলো, তখন মাথায় খেলে গেলো আমাদের শৈশবের পাটিতে বসে খাওয়ার স্মৃতি। তাই লনে মাদুর বিছিয়ে সব বাচ্চাকে সারি করে বসিয়ে দেওয়া হলো। তারপর ওয়ান টাইম প্লেটে সবাইকে খাবার পরিবেশন করা হলো।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাচ্চারা অবলীলায় মাদুরে বসে অনেক উৎসাহ নিয়ে আমাদের রান্না করা খিচুড়ি, মুরগি আর ডিমের তরকারি খেল। অন্যান্য দিন বাচ্চাদের খাওয়াতে আমাদের সবারই মোটামুটি প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়, কিন্তু আজ সবাই একসাথে আনন্দ নিয়ে নিজে নিজে খাচ্ছে দেখে আমাদের প্রত্যেকেই কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে গেলাম।

ইতোমধ্যেই রুপা বৌদি এসে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। উনি বললেন, “ওয়ান টাইম প্লেটের পরিবর্তে কলাপাতা হলে আরও ভালো হতো।” উত্তরে আমি বললাম, “এবার তো হুট করে আয়োজন করেছি, পরেরবারের পরিকল্পনায় কলাপাতা রাখা হবে।”

কাকতালীয়ভাবে সেদিন আকাশে ছিল চাঁদ। আমরা যতক্ষণ চড়ুইভাতি করেছি, ততক্ষণ চাঁদ আমাদের পাহারা দিয়েছিল। তাই আমরা এই চড়ুইভাতিটার নাম দিয়েছিলাম- ‘চাঁদের আলোয় চড়ুইভাতি’।

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী

মেইল: yaqub_buet@yahoo.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!